মা তখনও মেঝেতে পড়ে ডুকরে কাঁদছে | মেয়েমানুষের আর কত আক্কেল হবে | দিনকালই পড়েছে অন্যরকম | কী কপাল নিয়ে এসেছিল

“মা তখনও মেঝেতে পড়ে ডুকরে কাঁদছে।”—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মায়ের ডুকরে কাদার কারণ আলােচনা করাে

সতীনাথ ভাদুড়ীর ডাকাতের মা’ ছােটোগল্পে দেখা যায়, পাঁচ বছর জেল খেটে একদিন রাতে আচমকা সৌখী বাড়ি ফিরে আসে। পরদিন সকালে ছেলেকে কী খেতে দেবে—সেই চিন্তায় অস্থির সৌখীর মা পয়সা জোগাড়ের জন্যই মাঝরাতে মাতাদীন পেশকারের বাড়ি থেকে তাদের দামি ঘটিটা চুরি করে বাসনের দোকানে চোদ্দো আনা পয়সায় বিক্রি করে এবং তা দিয়ে প্রয়ােজনীয় জিনিসগুলি কিনে আনে। সকালে যখন সে আলুচচ্চড়ি রান্না করছিল, তখনই বাসনওয়ালা ও পেশকার সাহেব-সহ দারােগাসাহেব তাদের বাড়িতে তদন্তের জন্য উপস্থিত হলে পুলিশি জেরার হাত থেকে মাকে রক্ষা করার জন্য সৌখী তার মায়ের অপরাধ নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। মায়ের স্বীকারােক্তি এবং কাতর অনুরােধ উপেক্ষা করে দারােগাবাবু তার ছেলেকে নিয়ে চলে যাবার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত তার মা মেঝেতে পড়ে ডুকরে কাঁদতে থাকে।

সৌখীর মা কেঁদেছিল প্রধানত তিনটি কারণে। প্রথমত, পাঁচ বছর ধরে জেল খেটে ছেলে বাড়ি ফিরলেও নিজের স্ত্রী ও তার তখনও-অবধি-না-দেখা পাঁচ বৃছরের পুত্রকে একবারের জন্যও তার দেখা হয় না। দ্বিতীয়ত, ছেলের প্রিয় আলুচচ্চড়ি ও ভাতও তাকে রান্না করে খাওয়ানাের সুযােগ হয় না তার। তৃতীয়ত, সামান্য চোদ্দো আনা পয়সার জন্য ছিচকে চুরি করে সে যে তার ডাকাত বংশের মুখে কালি ছিটিয়েছে—সেই দুঃখও তাকে পীড়িত করে।

“মেয়েমানুষের আর কত আক্কেল হবে?” -বক্তার এ কথা ভাবার কারণ কী?

সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ডাকাতের মা’ ছাটোগল্পে আমরা দেখি যে, ডাকাত সর্দার সৌখী জেল থেকে নির্দিষ্ট দিনের কিছু আগে ছাড়া পেয়ে একদিন বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া করে সে তার বিধবা মাকে নিজের গায়ের নতুন কম্বলটা দিয়ে, মার পুরােনাে কম্বলটা নিয়ে শুয়ে পড়ে। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠবার ইচ্ছা থাকলেও ভােরবেলায় হই-হট্টগােল শুনে সে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে যে, পেশকার সাহেবের লােটা চুরির অপরাধে স্বয়ং মাতাদীন পেশকার ও বাসনওয়ালাকে নিয়ে দারােগাসাহেব তাদের বাড়িতে তদন্ডের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। দারােগাসাহেব একটা লােটা দেখিয়ে যখন লােটাটা বাসনওয়ালার কাছে চোদ্দো আনায় বিক্রি করার কথা সৌখীর মাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন সৌখীর মায়ের মুখ থেকে কোনাে কথা বেরােয় না। শুধু একবার ছেলে সৌখীর দিকে তাকিয়ে মাথা হেঁট করে নেয় সে। ফলে সদ্য-ঘুম-ভাঙা সৌখী সবই বুঝতে পেরে ভাবে যে, তার মা তাকে অনটনের কথা বললেই সে জেলে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে জমানাে নব্বই টাকা দিয়ে মাকে সাহায্য করতে পারত। তা না করে মাত্র চোদ্দো আনার জন্য ছিচকে চুরি করতে গেল সে। এ কারণেই পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী ডাকাত সর্দারের মনে হয়েছে, মেয়ে মানুষ আর কত আক্কেল হবে।

“দিনকালই পড়েছে অন্যরকম!” -বক্তার এ কথা বলার কারণ আলােচনা করাে।

সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ডাকাতের মা’ ছােটোগল্প থেকে গৃহীত এই উদ্ধৃতিটি প্রকৃতপক্ষে ডাকাত সর্দার সৌখীর মায়ের ভাবনা। সৌখীর মা শীতের রাতে বিছানায় একা একা শুয়ে তার মন্দভাগ্যের কথা ভাবছিল। নানা কথা ভাবতে ভাবতে উদ্ধৃত ভাবনাটি তার মনে আসে। সৌখীর অনুচরদের উদ্দেশ করেই ডাকাতের মা এমন ভাবনা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। সৌখীর বাবার আমলের এক ডাকাত যখন আহত হয়ে ধরা পড়ে, তখন সে নিজের হাতেই নিজের জিভ কেটে ফেলেছিল যাতে দলের গােপন কথা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে না যায়। সৌখীর দলে কিন্তু এমন বিশ্বাসী এবং দল-অন্ত-প্রাণ অনুচর নেই। সে কারণেই সৌখীকে বারংবার দরজায় সাংকেতিক টোকা দেওয়ার নিয়মাবলি পালটাতে হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর আগে সৌখী শেষবারের মতাে জেলে গেলে তার অনুচররা প্রথম দুবছর নিয়মমতাে তার মাকে মাসে মাসে টাকা পাঠালেও তারপর থেকে তারা বেপাত্তা হয়ে যায়। সৌখীর বাবার আমলে সেটা ছিল রীতিমতাে কল্পনাতীত। এমনকি সৌখীর আমলেও এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। তখন মাস শেষ হওয়ার আগেই, কখনও বা তিন-চার মাসের আগাম টাকাও দিয়ে যেত তারা। দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জর, একাকী, প্রৌঢ়া, বিধবা তাই হতাশ হয়ে এমন ভাবনায় ভাবিত হয়েছেন।

“কী কপাল নিয়ে এসেছিল।” -বক্তার এরূপ উক্তির কারণ ডাকাতের মা গল্প অবলম্বনে লেখাে।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীর ডাকাতের মা’ ছােটোগল্প থেকে নেওয়া এই উদ্ধৃতিটি প্রকৃতপক্ষে ডাকাত সর্দার সৌখীর প্রৌঢ়া বিধবা মায়ের ভাবনা।

সৌখীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর একমাত্র পুত্রসন্তান যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সৌখী জেলে। সৌখীর অনুচরেরা প্রথম দু বছর ধরে প্রতি মাসে তার পরিবারকে টাকা পাঠালেও পরবর্তীকালে টাকা দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এমনিতেই সৌখীর দ্বিতীয় স্ত্রীর শরীর শীর্ণ ছিল, তার ওপর ছেলে হওয়ার ধকল এবং চরম আর্থিক অনটন তাকে আরও রুণা করে তােলে। এই চরম অর্থকষ্ট ঘােচানাের জন্য সৌখীর বউ যে খেটে অর্থ উপার্জন করবে, তাও সম্ভব নয়। রুগণ শরীর নিয়ে সৌখীর দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষে পরিশ্রম করা কার্যত অসম্ভব। আবার জাতে গােয়ালা বলে সৌখীর মায়ের পক্ষে ঝি-চাকরের কাজ করাও সম্ভব নয়। তা ছাড়া, পরিচারিকার কাজ করতে চাইলেও ডাকাত সর্দার সৌখীর মা-বউকে কেউ বিশ্বাস করত না। তাই বাধ্য হয়েই সৌখীর মা তার নাতি ও পুত্রবধূকে বেয়াইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে খই-মুড়ি ভেজে ও তা বিক্রি করে কোনােমতে পেট চালায়। দারিদ্র্যপীড়িত নাতির মন্দভাগ্যের কথা স্মরণ করে ঠাকুমা ভাবে, “যার বাপের নামে চৌকিদারসাহেব কাপে, দারােগাসাহেব পর্যন্ত যার বাপকে তুইতােকারি করতে সাহস করেননি কোনােদিন, তারই কি না দু’বেলা ভাত জোটে না।” সুতরাং কোনাে দিন বাবাকে না-দেখা, চরম দারিদ্র্যের জন্য মা-সহ দাদুর বাড়িতে থাকা নাতির সম্বন্ধে ঠাকুমার এমন ভাবনা অত্যন্ত স্বাভাবিক।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment