১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতির পঞ্চম অধ্যায় মাধ্যমিক শিক্ষার বৃত্তিমুখী করণ ও ষষ্ঠ অধ্যায় কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তথ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে এই বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ১১৮৬-তে উল্লেখিত মাধ্যমিক শিক্ষার বৃত্তিমুখীকরণ
বৃত্তিমুখী শিক্ষা: নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাকে বৃত্তিমুখী করার কথা বলা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমুখী শিক্ষার পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেসকল মেধাবী শিক্ষার্থী বা যারা উচ্চশিক্ষা পেতে চায়, তাদের জন্য সাধারণ ধর্মীয় শিক্ষা এবং সাধারণ মানের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিমুখী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। বৃত্তিমুখী শিক্ষার পরিকল্পনা কে সুপরিকল্পিত ভাবে ও দৃঢ়ভাবে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রূপায়ণ করতে হবে।
উদ্দেশ্য: এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হল জনসংখ্যার চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী বৃত্তির ব্যবস্থা করা, সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত সকল মানুষকে বৃত্তি শিক্ষার সুযোগ দানের, দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষার বদলে বিকল্প শিক্ষার সুযোগ দান প্রভৃতি।
জাতীয় শিক্ষার বৃত্তিমুখী করণ প্রসঙ্গে বক্তব্যসমূহ
মাধ্যমিক শিক্ষার বৃত্তিমুখী করণ প্রসঙ্গে বক্তব্য সমূহ হলো一
(১) পরিবর্ত শিক্ষাপদ্ধতি: প্রস্তাবিত শিক্ষা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বৃত্তিমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা, পরিকল্পনা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে রূপায়িত কর্মসূচি হল একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা। কর্মসূচির এই গুণাবলির অর্থ হল ব্যক্তিগত কর্ম নিযুক্তির সুযোগ বৃদ্ধির দ্বারা জনশক্তির চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণ এবং বিনা উদ্দেশ্যে ও স্বার্থে যারা উচ্চশিক্ষার দিকে ছুটছে তাদের জন্য একটি পরিবর্ত (substitute) উপায় নির্ধারণ।
(২) পেশা নির্বাচন ও দক্ষতা অর্জন: বৃত্তিমুখী শিক্ষা হবে একটি ভিন্নতর শিক্ষা প্রবাহ। কর্মজগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি পেশা নির্বাচনে ও তাতে দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীকে সাহায্য করাই হল এর উদ্দেশ্য। সাধারণত মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর এই কোর্স নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশােনা করতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনাটিকে একটু নমনীয় করলে অষ্টম শ্রেণির পাঠ শেষ করেও শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে Industrial Training Institute-গুলি বৃত্তিমুখী শিক্ষা ধারায় বৈচিত্র্য আনতে পারে।
(৩) পারিবারিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা: Health Planning এবং Health Service Management-এই দুটি কর্মধারাকে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা যায় এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক বৃত্তিমূলক কোর্স প্রবর্তন করে উক্ত দুটি ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর জোগান দেওয়া যেতে পারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যদি স্বাস্থ্য শিক্ষা (Health Education) চালু করা যায় তাহলে পারিবারিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে পারে।
(৪) অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের জন্য কর্মসূচি: বৃত্তিমুখী শিক্ষা কোর্স অথবা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দায়িত্ব থাকবে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রের উপর। সমাজের অবহেলিত নারী, পুরুষ এবং উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারই বিশেষ দায়িত্ব বহন করবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য অনুকূল কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
(৫) ব্রিজ কোর্সের ব্যবস্থা: বৃত্তিমূলক কোর্সের স্নাতকদের পূর্ব নির্ধারিত শর্তে সাধারণ, কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষায় প্রবেশের অধিকার থাকে। তবে এর জন্য একটি অনুকূল ব্রিজ কোর্স-এর ব্যবস্থা থাকবে।
(৬) বিধিমুম্ভ কর্মসূচি: বিধি মুক্ত, নমনীয় এবং প্রয়োজনভিত্তিক বৃত্তিমূলক কর্মসূচিকে নব স্বাক্ষর, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত কারী যুবক, বিদ্যালয়ত্যাগী, কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি এবং বেকার অথবা আংশিক বেকারদের নিকট সহজলভ্য করে তোলা যাবে। নারীদের জন্য এই জাতীয় শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে।
(৭) তৃতীয় পদের (Tertiary) শিক্ষা কোর্স: উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পর যে সমস্ত শিক্ষার্থী academic -এ পাস করেছে তাদের জন্য তৃতীয় পদের (Tertiary) একটি শিক্ষা কোর্স সংগঠন করা হবে। এটির জন্য বৃত্তিমূলক কোর্স চালু করা যেতে পারে।
(৮) বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আকৃষ্ট করার: একটি শিক্ষা প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শতকরা। ১০ জনকে ও ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শতকরা ২৫ জনকে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আকৃষ্ট করা যাবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে যে, উপরোক্ত শিক্ষার্থীদের একটি বৃহত্তম অংশকে চাকরিতে নিয়োগ অথবা স্বনিযুক্তির সুযোগ করে দেওয়া হবে।
কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার শিক্ষা
জাতীয় শিক্ষানীতির ষষ্ঠ অধ্যায়ে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ, শিল্প উৎপাদন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির সঙ্গে সংগতি রেখে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার শিক্ষাকে পুনর্গঠন করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেগুলি হল—
(১) কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষার পুনর্গঠন: সম্পর্কের নিবিড়তা ও পারস্পরিক নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা (Technical & Management) শিক্ষাকে একত্রে বিবেচনা করা অপরিহার্য। নতুন শতাব্দীর আগমনের সঙ্গে অর্থনীতি, সামাজিক পরিবেশ, উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানের অগ্রগতি এবং জ্ঞানের সম্প্রসারণ তথা পরিবর্তনের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে সংগতি রেখে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা পুনর্গঠন করতে হবে।
(২) অনুকূল যৌন শক্তির জোগান : পরিকাঠামো এবং পরিবেশমূলক অংশ-সহ গ্রামীণ অসংগঠিত অংশের প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি এবং কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার অনুকূল জন শক্তির জোগান প্রয়োজন। সরকারকে এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে।
(৩) উন্নত Technical Manpower information : জনশক্তি সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহের উন্নয়নে অদূর অতীতে যে Technical Manpower Information ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেটা কি আরও উন্নত ও শক্তিশালী করতে হবে।
(৪) উন্নত চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা : প্রতিষ্ঠিত ও নব উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নিয়ে যে চলমান শিক্ষা (Continuing Education) ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেটা কি আরও উন্নত ও শক্তিশালী করতে হবে।
(৫) পেশাগত ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার : আধুনিক যুগে যে কম্পিউটার ব্যবস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে তাকে পেশাগত শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে স্থান করে দিতে হবে। বিদ্যালয় স্তর থেকে কম্পিউটার শিক্ষার কর্মসূচিকে ক্রমশ বিস্তৃত আকারে সংগঠিত করতে হবে।
(৬) পত্রযোগে শিক্ষা ও অন্যান্য গণমাধ্যমের ব্যবহার : অধিক সংখ্যক মানুষকে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে অনেক বাধা আছে। তাই পত্রযোগে শিক্ষা ও গণমাধ্যমগুলির যথাযথ ব্যবহার উক্ত শিক্ষার প্রসঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।
(৭) অসংগঠিত অংশের অনুকূল বিধিব্যবস্থা : Management শিক্ষার সঙ্গে বহু অসংগঠিত অংশ, যা এ বিষয়ে Management-এর আওতায় আসেনি এমন অংশের মধ্যে সংগতি বিধানের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভারতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সমন্বয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অংশের অনুকূল বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন করবে।
(৮) Formal ও Non-formal কর্মসূচি : Technical Education এর অনুকূলে Formal এবং Non-formal কর্মসূচিকে এমনভাবে বিন্যাস করা হবে যেন এই কর্মসূচি মহিলা, দুর্বল শ্রেণি (অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিচারে) এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সহায়ক হয়।
(৯) অনুকূল পরিবেশ : বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, পাঠক্রমের উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য বহুসংখ্যক শিক্ষক এবং অনুকূল পেশাগত কর্মী প্রয়োজন।
(১০) ঐচ্ছিক কোর্স : জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে স্বনিযুক্তি করণের (Self-employment) ধারাটি গ্রহণ করতে শিক্ষার্থীরা যাতে উৎসাহিত হয় সেই উদ্দেশ্যে ডিগ্রি অথবা ডিপ্লোমা স্তরে একটি ঐচ্ছিক কোর্স চালু করা হবে, সেখানে নিজ চেষ্টায় ব্যাবসা পরিচালনা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হবে।
(১১) নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন : সর্বাধুনিক পাঠক্রমের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে অপ্রচলিত বিষয়গুলির উচ্ছেদ করে সর্বদা নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তনের জন্য নবীকরণ ব্যবস্থা গৃহীত হবে। উৎপাদনমূলক পেশার উন্নয়নে গুণগত ও সংখ্যাগত মান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গ্রামীণ পলিটেকনিক ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্ব প্রদান করা হবে।
(১২) সুযোগ সুবিধার বাস্তবায়ন : বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে সমন্বয়, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সম্পর্কের নিবিড়তা সৃষ্টির সুযোগ সুবিধা গুলো কে বাস্তবায়িত করতে হবে।
কারিগরি ও ব্যক্তিগত শিক্ষা সম্পর্কে এই জাতীয় শিক্ষানীতির বক্তব্য অনেকটা দায়সাড়া প্রকৃতির। উৎপাদন কাঠামো গড়ে ভােলার দিকে কম গুরুত্ব প্রদান, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, সংযোগ তথা আধুনিকীকরণের অভাব ইত্যাদি রেখে কখনোই সাফল্য লাভ করা যায় না।