‘মহাকাব্য’ নামটি সংস্কৃত থেকে গ্রহণ করলেও আমরা ইংরেজিতে এপিক বলতে যা বোঝায় সেই অর্থেই শব্দটিকে ব্যবহার করি। বিখ্যাত ইংরেজ সমালোচক ই. এম. ডব্লু. টিলিয়ার্ডের অনুসরণে আমরা এই কয়েকটি লক্ষণকে মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যরূপে নির্দেশ করতে পারি—প্রথমত, মহাকাব্য জাতীয় রচনায় উন্নত ধরনের ভাবগাম্ভীর্য (high seriousness) থাকা চাই। দ্বিতীয়ত, প্রসার, বিশালতা, ব্যাপকতা (inclusiveness) জাতীয় রচনার বিশেষ গুণ : ট্র্যাজিক নাটকের তুলনায় মহাকাব্য জীবনে আরও অনেক বেশি দিক প্রতিফলিত করতে সক্ষম। তৃতীয়ত, পরিধির বিশালতা বা বিষয়বস্তুর ওপর সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ মহাকাব্যের গৌরবময় আখ্যার দাবি পুরণের অন্যতম শর্ত। চতুর্থত, মহাকাব্যে গ্রীক নাটকের কোরাসের মত কবির সমকালের বা তার কাছাকাছি সময়ের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্ক্ষা বিশ্বাস-প্রত্যয়ের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হওয়া চাই। কিন্তু মহাকাব্য রূপে পরিচিত প্রতিটি রচনায়ই এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ একইভাবে প্রকাশিত হবে এই দাবি বা প্রত্যাশা অযৌক্তিক। একটি জাতির মহাকাব্য রচনার পক্ষে অনুকূল যুগ, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জীবনাচরণ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে মহাকাব্যের ঐ সমস্ত লক্ষণ নিজস্ব রূপ নেয়।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বা আদি মহাকাব্য মহাভারত ও ইলিয়াডের কথাই ধরা যাক। রচয়িতারূপে ব্যাসদেবের নাম মহাভারতে সন্নিবিষ্ট হলেও বিভিন্ন কালের বহু কবির রচনা, গাথা, উপাখ্যান ইতিবৃত্ত প্রভৃতি মূল কাহিনী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বৃত্তান্তের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে তার সমুদ্রের মত বিশাল অবয়ব রচনা করেছে। প্রাচ্যবিদ্যাবিদ পণ্ডিতদের মতে, মহাভারত রচনার একাধিক স্তর আছে। প্রথমটি হল মূল ক্ষত্রিয়কাহিনী, এই আদি ও অকৃত্রিম বীরকাহিনীর নাম ছিল ‘জয়’, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটি কাব্যিক ইতিহাস। পরবর্তীকালে সেই মূল কাহিনীকে জনশিক্ষার বাহন করে তোলার জন্য কতকগুলি শাশ্বত নৈতিক কাহিনী যাতে দয়া, ক্ষমা, অহিংসা, আশ্রিতবাৎসল্য, সত্যনিষ্ঠা, সংযম প্রভৃতি চারিত্রিক গুণ প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলি সংযোজিত হয়। এই কাহিনীগুলি বহু শতাব্দী ধরে প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে গাথা ও আখ্যানরূপে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত মহাভারতের রচনাকাল বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। খ্রিস্টীয় প্রথম ও চতুর্থ শতকের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আর একটি সংযোজন শেষ হয়, এটি ব্রাহ্মণ্য সংযোজন রূপে নির্দেশিত হয়েছে। এই অংশে রুরু-প্রেমদ্বরা, নল-দময়ন্তী, সাবিত্রী-সত্যবান, শকুন্তলা-দুষ্যন্ত প্রভৃতি লোকমুখে প্রচলিত কয়েকটি মনোজ্ঞ কাহিনী স্থান পেয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য অংশে প্রাধান্য পেয়েছে সাম্প্রদায়িক দেবতার মহিমা, তীর্থ মাহাত্ম্য, আচার অনুষ্ঠান, পাতিব্ৰত্য, বর্ণাশ্রম ধর্ম, দার্শনিক তত্ত্ব, দৈব, কর্ম ও জন্মান্তরবাদ ও ব্রাহ্মণের মহিমা-কীর্তন। মহাভারতের একটি স্থানে তার নামের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে যে নির্দেশ আছে সেই সম্পর্কে ডঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের এই ব্যাখ্যা প্রণিধানযোগ্য : “মহত্ত্ব এবং ভারবত্ত্ব থাকার জন্যেই এর নাম মহাভারত।” স্পষ্টতই এ ব্যুৎপত্তি নির্বাচন বা ব্যাকরণশাস্ত্র মতে ভুল, কারণ ভারবত্ত্ব থেকে ‘ভারত’ হতে পারে না। তবে কেন একথা বলা হয়েছে? মহাভারতে ছন্দে, কিছু গদ্যেও, সংলাপে, বর্ণনায়, আখ্যানে নাটকীয় ঘটনার বর্ণনায়, কাহিনীর বিবরণে, তর্কে, উপদেশে, প্রহেলিকায় তত্ত্বালোচনায়, নানা ভঙ্গী ও বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুর সমাবেশ। এ ছাড়া কলেবরগতভাবে, বিষয় মাহাত্ম্যে, স্থানের পরিসরে, কালের ব্যাপ্তিতে, নানাজাতি উপজাতির উপখ্যানে, মহৎ এক যুদ্ধবর্ণনায়, মহৎ এক বংশের অভ্যুত্থান,সমৃদ্ধি ও অবক্ষয় বর্ণনায় এর মহত্ত্ব তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু ভারবত্ত্ব? এও কি সেই বিস্তার ইত্যাদিরই ভার? তা মনে হয় না। মনে হয় এত ভার— গুরুত্বের, গৌরবের, ব্যাপ্তির, গভীরতার—পৃথিবীর আর কোনো মহাকাব্যে নেই। সেইজন্যে ভ্রান্ত বুৎপত্তি দিতেও দ্বিধা নেই কবির। তাঁর এ সাহসের কারণ হল ব্যাকরণে না হোক অন্য এক স্তরে এই ভারবত্ত্ব শব্দটি চুড়ান্ত সার্থকতায় মণ্ডিত।
কাহিনীর পরিধি ও বিষয়বস্তুর বিশাল বিস্তারে ভারতবর্ষের মহাভারত বিশ্বসাহিত্যে সত্যই অতুলনীয়। কৌরবকুলের পূর্বপুরুষদের বৃত্তান্ত থেকে আরম্ভ করে পঞ্চপাণ্ডব ও কৌরবদের জন্ম, বাল্যকাল, যৌবন, পাণ্ডবদের দ্বাদশবর্ষব্যাপী বনবাস, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ও কৌরবকুলের ধ্বংস এবং অবশেষে পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের পথযাত্রায় যুধিষ্ঠির ছাড়া অপর সকলের মৃত্যু—দীর্ঘকালব্যাপ্ত কাহিনীর এই বিপুল বিস্তার অন্য কোনও মহাকাব্যেই দেখা যায় না। যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে—দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত এই প্রবাদের অর্থ হল, মহাভারতে যা নেই ভারতবর্ষেও তা নেই। কিন্তু এই মহাকাব্যে প্রাচীন ভারতবর্ষের পুরাবৃত্ত, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, নৈতিক তত্ত্ব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জনপদজীবন, ভূগোল, জীবতত্ত্ব, পরলোক ইত্যাদি সম্পর্কে ধ্যানধারণা, ক্ষত্রিয় জীবনের আদর্শ ও আচরণ, নাটকীয় ঘটনাসংস্থান, সারল্য ও কুটিল চক্রান্ত, আতিথেয়তা ও দানশীলতা, করুণা ও নিষ্ঠুরতা ক্ষমা ও ক্রুর প্রতিহিংসা, মহত্ত্ব ও নীচতা, নিষ্কামকর্ম ও ভোগলিপ্সা, প্রেম প্রভৃতি বিভিন্ন প্রবৃত্তির বিচিত্র জটিল সমাবেশে মানব চরিত্রের ঘাতপ্রতিঘাত—এসবই মহাভারতের বিশাল অবয়বে স্থান পেয়েছে। বৈদিক যুগে কোনও প্রাচীন কাহিনী বিবৃত করার সময় ‘ইতি হ আস’ অর্থাৎ এই রকম ছিল বলে কাহিনী বা গল্প আরম্ভ করা হত; উপনিষদ ও ব্রাহ্মণের মধ্যে বহু প্রাচীন ইতিহাস বা গল্প মেলে। রামায়ণ ও মহাভারত এই জাতীয় রচনার মধ্যে সর্বপ্রাচীন। আধুনিক কালে ইতিহাস বলতে যা বোঝায়, সেই অর্থে মহাভারতকে আমরা প্রাচীন ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনের ইতিহাস আখ্যা দিতে পারি, এই গৌরব আর কোনও মহাকাব্য-নামাংকিত রচনাকে দেওয়া যেতে পারে বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ মহাভারত সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন : “ইহা কোনও ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাসে নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত ইতিহাস।” সর্বোপরি, পৃথিবীর এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত মহাকাশের মত যে বিশাল ও মহনীয় জীবনজিজ্ঞাসা ও জীবনাদর্শ মহাভারতের সবকিছুকে ধারণ করে আছে তা সত্যই তুলনাহীনঃ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মানুষের শুভ ও অশুভবুদ্ধির শ্রেয় ও প্রেয়র সংঘাতের প্রতীক। পঞ্চপাণ্ডবদের রাজ্যজয়ের মত স্থূল পার্থিব লাভের ঘটনায় এই রক্তক্ষয়ী যন্ত্রণাময় সংগ্রাম শেষ হতে পারে না, তাই বিপুল ঐশ্বর্য ও রাজ্যসুখ ছেড়ে পঞ্চপাণ্ডবদের বেরিয়ে পড়তে হয় জীবনের অমৃত তথা গভীর চিরন্তন সত্য ও মুক্তির সন্ধানে। ধ্রুপদী উপমায় চিত্রকল্পে ও প্রাজ্ঞবচনে মহাভারতের প্রকাশভঙ্গিও উত্তুঙ্গ মহিমা ও মর্যাদায় অতুলনীয়।
হোমারের ‘ইলিয়াড’ চব্বিশটি খণ্ডে বিভক্ত। ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিস গ্রীকরাজ মেনেলিউসের অসামান্যা সুন্দরী স্ত্রী হেলেনকে অপহরণ করার ফলে গ্রীকদের ট্রয় নগরী অবরোধের দশম বর্ষে স্বল্পসময়ের ঘটনাসমূহ নিয়ে ‘ইলিয়াড’ রচিত। গ্রীক সৈন্যবাহিনীর অধিনায়ক আগামেমনন তাঁদের পক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর একিলিসের একজন ক্রীতদাসীকে অধিকার করে নেওয়ায় তার প্রচণ্ড ক্রোধ হয়, সে যুদ্ধ থেকে সরে গিয়ে নিজের শিবিরে আশ্রয় নেয়। তার শক্তিদৃপ্ত সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবার ফলে গ্রীক সৈন্যবাহিনী বিপর্যস্ত হয়। আগামেমনন একজন দূত পাঠিয়ে একিলিসের ক্রোধ শান্তির জন্য তাকে লোভনীয় ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু তার ক্রোধ শান্ত হয় না। ট্রোজানরা গ্রীকদের ছত্রভঙ্গ করে তাদের জাহাজগুলোয় আগুন ধরাতে থাকলে একিলিসের বন্ধু ও সহচর প্যাট্রোক্লাস আর স্থির থাকতে পারে না, একিলিসের অনুমতি নিয়ে সে ট্রোজানদের প্রতিরোধ করতে অগ্রসর হয়, তারা পশ্চাদপসরণ করে, কিন্তু প্যাট্রোক্লাস ট্রোজান পক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হেক্টরের হাতে নিহত হয়। সেই শোকে উন্মাদ হয়ে একিলিস প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুদ্ধে পুনরায় অবতীর্ণ হয়ে হেক্টরকে শুধু হত্যাই করে না, নির্মম প্রতিহিংসায় বীরধর্ম ভুলে গিয়ে তার মৃতদেহের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করে। ট্রয়ের বৃদ্ধ রাজা প্রীয়াম তাঁর পুত্রের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেবার অনুরোধ জানালে একিলিসের ক্রোধ শান্ত হয়, করুণায় আপ্লুত হয়ে সে তাঁর অনুরোধ অনুযায়ী মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়।
এই কাহিনীতে দেখা যায় দেবতারা দুই বিবদমান পক্ষে যোগ দিয়ে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবেই হস্তক্ষেপ করেছেন, চরিত্রগুলি অনেক সময়েই দেবতাদের অলৌকিক শক্তির ক্রীড়নকে পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু মহাভারতের মূল ক্ষত্রিয়কাহিনী—“একান্তভাবে দেবতা-নিরপেক্ষ ও মানবিক সীমার মধ্যেই নিহিত। ফলে দেবতার ভূমিকা মূল কাহিনীর ক্ষেত্রে আগন্তুক বা আপতিক এবং সম্পূর্ণরূপে পরিহার্য। মানুষের চরিত্রের অন্তর্নিহিত শুভ ও অশুভ বুদ্ধি নৈতিক জয় পরাজয়ই কাহিনীকে নিয়ন্ত্রিত করেছে।” ইলিয়াডের কাহিনীর পরিসরও মহাভারতের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র, সীমিত। হোমারের ইলিয়াডে গ্রীকদের জীবনাচরণের কয়েকটি আদর্শ রূপায়িত করেছেন : জাতির মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন, সেই ঐক্যই স্বাধীনতার নীতিকে নিশ্চয়তা দেয়। প্রতিশোধ গ্রহণে নিজের বীরধর্মের সম্মান রক্ষার অধিকার মানুষের নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু শত্রুর মৃতদেহের অবমাননা অনুচিত; তার বৃদ্ধ পিতা ও পারিবারিক জীবনের অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনও বীরধর্মেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রীক জাতির ক্ষাত্র ধর্মের আদর্শই হোমারের ইলিয়াডে রূপায়িত হয়েছে, সুতরাং এই রচনা বীররসাত্মক আখ্যানের—(Heroic Tales) বৈশিষ্ট্য সংবলিত মহাকাব্য বলা যায়। মহাভারতে যে জীবনাদর্শ রূপায়িত তা অনেক বেশী ব্যাপক ও মহত্তর, কিছু আগে আমরা যে কথা বলেছি, তার পুনরাবৃত্তি করে বলতে হয়, সেটি এই মহাকাব্যকে মহাকাশের মতই যে মহিমা ও মর্যাদা দান করেছে, বিশ্বসাহিত্যে তা অতুলনীয়।
জীবনসায়াহ্নে সপ্তদশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি মিল্টন ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (Paradise Lost, 1667) ও ‘প্যারাডাইস রিডে’ (Paradise Regained, 1671) রচনা করেন। দুটি রচনা একই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত, দ্বিতীয়টি প্রথমটির উপসংহাররূপে রচিত হলেও Paradise Lost সর্বশ্রেষ্ঠ, সত্যই মহৎ কাব্যরূপে গণ্য হওয়ার যোগ্য। পৃথিবী সৃষ্টির পর মানবজাতির প্রথম পূর্বপুরুষ আদিমানব আদম ও তার সহচরী ইভ সৃজিত হয়। স্বর্গে তাঁরা অবিমিশ্র আনন্দ উপভোগ করতেন, তাদের জীবন ছিল জাগতিক দুঃখদৈন্য সমস্যা প্রভৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কিন্তু ঈশ্বর-বিদ্রোহী শয়তানের প্ররোচনায় ইভ জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে এবং ইডের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আদমও তা ভক্ষণ করে। সেই প্রথম পাপ তথা ঈশ্বরের বিধান লঙ্ঘন করার ফলে মানুষ স্বর্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়, এই হচ্ছে প্যারাডাইস লস্টের মূল বিষয়বস্তু। কবি তাঁর কাব্যের সূচনায় বলেছেন, মানুষের কাছে ঈশ্বরের বিধানের মহিমা কীর্তনই তাঁর উদ্দেশ্য- ‘to justify the ways of God to man’। কিন্তু কবির সেই সচেতন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে আচ্ছন্ন করে ঈশ্বরদ্রোহী শয়তানের বিদ্রোহই প্যারাডাইস লস্ট কবিতার দৃপ্ত ও প্রাণবন্ত বাণী হয়ে উঠেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি, যাদের মধ্যে ছিলেন রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ হিন্দু কলেজের ছাত্র—তাঁদের কাছে এই কাব্য ছিল অত্যন্ত প্রিয়। Better to reign in Hell than serve in heaven, অথবা To be weak is miserable, doing or suffering—প্রথম সর্গে ঈশ্বরবিদ্রোহী পরাজিত শয়তানের মুখের এই সমস্ত তেজোদীপ্ত উক্তি সেকালের ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিদের কণ্ঠে কণ্ঠে অনুরণিত হত।
প্যারাডাইস লস্টের প্রথম সর্গের বিদ্রোহীদের বর্ণনা, দ্বিতীয় সর্গের নরক-বর্ণনা, ‘কেঅস’ (Chaos) অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিম বিশৃঙ্খলার চিত্র, পাপ ও মৃত্যুর বিবরণ এই সমস্ত অংশে বিশ্বজাগতিক (Cosmo logical) কল্পনার উপযুক্ত উপমারুপক প্রভৃতি অলংকার ও চিত্রকল্প, অমিত্রাক্ষর ছন্দের ওজস্বিতাময় গাম্ভীর্য, প্রবহমান সমুদ্রতরঙ্গের মত তার গতি-বিস্তার ও সমুদ্রকল্লোলের ধ্বনিবৈভব ইত্যাদির সমবায়ে যে বাণী মহিমা ফুটে উঠেছে সেটি নিশ্চিতভাবেই এই রচনাকে মহাকাব্যের গৌরব দান করেছে। খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মানুষের পতনের কাহিনীতে ভাবনার সমুন্নতি (Sublimity) ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা মিল্টনের গাম্ভীর্যমণ্ডিত বাণী-সম্পদের দৌলতে ফুটে উঠেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু পিউরিটান ধর্মমতাবলম্বী কবির এই রচনায় মানবজীবনের ব্যাপকতা ও প্রসারের অভাবও পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। আশা-আকাঙ্ক্ষায়, সাধ-স্বপ্নে, বেদনা-মমতায় প্রেমের আকর্ষণ-বিকর্ষণের দ্বন্দ্বসংঘাতে সজীব মানুষ ও তার জীবন ‘প্যারাডাইস লস্টে’ প্রতিফলিত হয় নি। আদম ইভ যেন ঈশ্বরের পুতুল। তাদের সম্পর্কে নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি প্রেম-প্রীতি-সমবেদনার বিন্দুমাত্র মাধুর্য লক্ষ্য করা যায় না। ইভের মধ্যে বিন্দুমাত্র কমনীয়তা নেই, আদম সর্বদাই পুরুষ হিসেবে তার শ্রেষ্ঠত্বাভিমানে নির্বোধ নারী ইভের প্রতি অবজ্ঞা এবং তাকে সবসময় শাসনাধীনে রাখার প্রভুত্বাভিমানের অহংকারে স্ফীত আর মিল্টনের ঈশ্বরও করুণায় ক্ষমায় মানুষের প্রিয় দেবতা নন, তিনি স্বৈরাচারী, নিজের ন্যায়পরায়ণতার দত্তে প্রমত্ত, নিষ্ঠুর। সেই কারণেই তাঁর তুলনায় পরাজিত শয়তানের সঙ্গেই মানুষ বেশি আত্মীয়তা বোধ করে, তাকে তার নিজের নিকটতর বোধ হয়। মিল্টনের মহাকাব্যে যে হাস্যরসের ছিটেফোঁটাও নেই, সমালোচকেরা তাকে তার ত্রুটি হিসেবেই লক্ষ্য করেছেন। প্যারাডাইস লস্টে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পিউরিটান ধর্মবিশ্বাসগত যে শুষ্ক কঠোর নৈতিক বোধ পরিব্যাপ্ত, সেটি মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যাপকতার পরিপন্থী।
মধুসূদন তাঁর মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য রচনার ভাবগত পটভূমি সম্পর্কে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি পত্রে লিখেছেন—এদেশের পুরাণে গ্রীক পুরাণের অতুলনীয় সৌন্দর্য স্থাপিত করাই তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এই রচনায় তিনি তাঁর উদ্ভাবন শক্তিকে অবাধ গতি দান এবং বাল্মীকি থেকে যত অল্প পারেন ততটুকুই গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। তাঁর কাব্যের চার ভাগের তিন ভাগই গ্রীক, এই স্বীকারোক্তিও কবি করে গেছেন। মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যে ইলিয়াডের প্রভাব যে কত ব্যাপক যে কোনও সাধারণ সমীক্ষায়ই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রাচীরের দ্বারা পরিবেষ্টিত ট্রয় নগরী এবং প্রাচীরের বাইরে অবরোধকারী গ্রীক সৈন্যবাহিনীর চিত্রের অনুসরণেই মেঘনাদবধ কাব্যের রাক্ষসপুরী লংকা এবং তার বাইরে রামচন্দ্র ও বানর সৈন্যবাহিনীর চিত্রটি পরিকল্পিত হয়েছে। ইলিয়াডের যুদ্ধে দেবতাদের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের প্রতিচ্ছবি মেলে মেঘনাদবধ কাব্যে রাম-রাবণের যুদ্ধে দেবতাদের অংশগ্রহণে। ট্রোজান পক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হেক্টরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ইলিয়াডের উপসংহার অনুসরণ করেই মধুসূদন তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যের সমাপ্তি রচনা করেছেন মেঘনাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। এই কাব্যের প্রথম সর্গে যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণরত প্রাসাদশিখরস্থিত সপারিষদ রাবণের চিত্র ‘ইলিয়াডে’র তৃতীয় সর্গের প্রিয়াম ও তাঁর সভাসদদের চিত্রের আদর্শে অংকিত। মধুসূদন তাঁর কাব্যের সপ্তম সর্গের যুদ্ধদৃশ্য মূলত ইলিয়াডের যুদ্ধ বর্ণনা অনুসরণ করেই বর্ণনা করেছেন। এই ধরনের আরও অনেক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণ, মন্দোদরী, প্রমীলা, মহাদেব, পার্বতী, কামদেব, রতিদেবী ও বারুণীর মধ্যে ইলিয়াডের যথাক্রমে প্রিয়াম, হেকুবা, অ্যান্ড্রোম্যাকি, জুপিটার, জুনো, সমনস, ভেনাস ও থেটিসের প্রভাব চোখে পড়ে। মেঘনাদ ইলিয়াডের হেক্টরের চরিত্রের আদর্শেই পরিকল্পিত।
এই সমস্ত প্রভাব সত্ত্বেও হোমারের ইলিয়াডের সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্যের মৌলিক পার্থক্য তথা তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য অত্যন্ত স্পষ্ট, আর সেটি খুবই স্বাভাবিক, সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির পশ্চাদপট থেকে পরাধীন বাঙালি জাতির কবির পক্ষে দ্বিতীয় একখানি ইলিয়াড রচনা সম্ভব ছিল না। হোমারের ইলিয়াডের যুদ্ধের ঘনঘটার প্রাধান্য সম্পর্কে বিতৃয়া প্রকাশ করে মধুসুদন লিখেছিলেন- Homer is nothing but battles’। তিনি ভারতীয় পুরাণ থেকে কাহিনী সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু গ্রীক ইলিয়াড বা প্রাচীন মহাকাব্যের ক্ষাত্র জীবনের আদর্শের সঙ্গে আত্মীয়তাবোধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। বস্তুত মহাভারত, ইলিয়াড বা প্যারাডাইস লস্টের মত কোনও মহাকাব্যিক বিশাল দূরপ্রসারী জীবনচিন্তা মেঘনাদবধ কাব্যে পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই শর্ত পূরণ না করলে কোনও রচনা মহাকাব্যপদবাচ্য হবে না এই দাবিও অযৌক্তিক। মধুসূদনের রচনায় কোনও উচ্চাঙ্গের জীবনাদর্শ প্রত্যক্ষভাবে রূপায়িত না হলেও মেঘনাদ ও রাবণ চরিত্রে বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের যে স্বাদেশিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ আভাসিত, সেটাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের উদাত্ত ধ্বনি-গাম্ভীর্যে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্পের ধ্রুপদী মহিমার আশ্রয়ে মেঘনাদবধ কাব্যকে এক ধরনের মহাকাব্যিক মর্যাদা দান করেছে। ক্ষাত্র জীবনের আদর্শ ও যুদ্ধের বজ্রনির্ঘোষ ছাড়া মহাকাব্যের মহিমা ও গাম্ভীর্য সৃষ্টি করা যায় না—মহাকাব্যের লক্ষণ বিচারে আমরা শুধু এই দিকটিকে একমাত্র চরম মানদণ্ডরূপে নির্দেশ করতে পারি না। রাবণ ও মেঘনাদের স্বাজাত্যবোধে, বিশেষত রাবণের অদৃষ্ট তথা দেবতাদের নির্মম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এবং নিজের ধ্বংস অনিবার্য জেনেও আত্মসমর্পণের চিন্তা মনে স্থান না দিয়ে সংগ্রামে অবিচল থাকার সংকল্প, পৌরুষ ও আত্মমর্যাদাবোধ আধুনিক মূল্যবোধের অভিজ্ঞানরূপেই মেঘনাদবধ কাব্যকে মহাকাব্যের মর্যাদায় মণ্ডিত করেছে।
এই আলোচনায় এটাই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে যে প্রতিটি যুগের মহাকাব্যকেই কয়েকটি অপরিবর্তনীয় সূত্রে বা লক্ষণে বেঁধে দেওয়া যায় না। যে যুগেরই হোক মহাকাব্যের আখ্যা পেতে গেলে রচনার কোনও না কোনও ধরনের ভাবগত সমুন্নতি থাকা প্রয়োজন, আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, বিভিন্ন যুগে তার প্রকাশভঙ্গি যে বিভিন্ন ধরনের হবে, সে বিষয়ে আমাদের অবহিত থাকতেই হয়। এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মহাকাব্যের শ্রেণীভেদের প্রসঙ্গ ওঠে। হোমারের ইলিয়াড, ওডিসি, ভারতবর্ষের রামায়ণ ও মহাভারত কবিদের ব্যক্তিনামের সঙ্গে জড়িত হলেও তারা একটি জাতির জীবন থেকে তার মাটি, জল, গাছপালার মত স্বতঃউদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়। সমালোচকরা এই আদি বা প্রাচীন মহাকাব্যগুলিকে খাঁটি মহাকাব্য (Authentic Epic or Epic of Growth) রূপে চিহ্নিত করেছেন। পরবর্তীকালের ভার্জিলের ঈনিড, দাস্তের ডিভাইন কমেডি, মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট প্রভৃতি মহাকাব্যের আদর্শ ও ঐতিহ্য অনুসারে রচিত শিল্পীদের সচেতন মানুষের সৃষ্টি। পরবর্তীকালের এই রচনাগুলিকে আলংকারিক বা সাহিত্যিক মহাকাব্য (Literary Epic) আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এই শেষোক্ত শ্রেণীভুক্ত। মহাকাব্যের রীতিতে ব্যঙ্গবিদ্রূপাত্মক এক ধরনের প্যারডি-কাব্য রচিত হয়েছে, তাকে বলা হয় বিদ্রূপাত্মক মহাকাব্য (Mock Epic), ইংল্যান্ডের কবি পোপের The Rape of the Lock কিংবা জগবন্ধু ভদ্রের মেঘনাদবধের প্যারডি ‘ছুছুন্দরীবধ কাব্য’ তার উদাহরণ।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর