সূচনা
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী চরমপন্থী আন্দোলনের পরিস্থিতিতে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার একদিকে যেমন তীব্র দমন নীতি অনুসরণ করে অন্যদিকে তেমন ভারতীয়র কিছু দাবি দাওয়া পূরণ করে তাদের ক্ষোভ প্রশমের উদ্যোগ নেয়। এই সময় সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের দাবিতে ভারতীয়রা আবার সোচ্চার হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের খুব প্রশমির উদ্দেশ্যে সরকার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রবর্তন করে।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের ত্রুটি
ভারতীয়দের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যে মর্লে-মিন্টো আইন পাস হলেও এই আইনের বিভিন্ন ত্রুটি ছিল, যেমন –
১. বড়লাটে চূড়ান্ত ক্ষমতা
মর্লে-মিন্টো আইনের মাধ্যমে বড়লাটের আইনসভার হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই আইনের দ্বারা বড়লাট আইনসভার যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সংশোধন বা বাতিল করার অধিকারী ছিলেন। বড়লার নিজেদের পছন্দের আইনসভার বেসরকারি সদস্যদের মনোনীত করতেন এবং তারা বড়লাটের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতেন। এর ফলের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সরকারি ও মনোনীত সদস্যরা মিলে আইন পরিষদের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশে পরিণত হন। এভাবে প্রকৃতপক্ষে বড়লাটের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।
২. ভোটাধিকার
মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা ভারতীয়দের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃতি হয়নি। এর দাঁড়া মুষ্টি মেয়ে ভারতীয় কে ভোটাধিকার দেওয়া হয় না। তাছাড়া নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোন ক্ষমতা বা তাদের মতামতের কোন গুরুত্ব ছিল না। তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা ছিল সরকারের হাতে।
৩. অধিকারহীনতা
এই আইনের মাধ্যমে দেশীয় রাজ্য, সামরিক বিভাগ, বিদেশ নীতি প্রভৃতি বিষয়ক কোন প্রস্তাব আনার অধিকার আইনসভার হাতে ছিল না।
৪. দায়িত্বশীলতার অভাব
মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা কেন্দ্র এবং প্রদেশে নির্বাচিত ভারতীয় যৌন প্রতিনিধিদের বিশেষ কোন গুরুত্ব স্বীকৃতি হয়নি। ফলে এই আইনের ভারতে কোন দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
৫. সাম্প্রদায়িক নির্বাচন
মর্লে-মিন্টো পাইন দ্বারা সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন দেয়। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র লিখেছেন যে, “মুসলিম স্বতন্ত্র্যের দাবিকে প্রশ্রয় দিয়ে ব্রিটিশ সরকার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কঠিন পথকে আরো কঠিন করে তোলে।” সেই কারণে ঐতিহাসিক প্যাসিভেল স্পিয়ার এই আইনকে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন প্রথম সরকারি উদ্যোগে বলে অবহিত করেছেন।
৬. কংগ্রেসের ক্ষোভ
মর্লে-মিন্টো আইন কংগ্রেসের চরমপন্থী ও নরমপন্থী উভয় গোষ্ঠীকে অসন্তুষ্ট করে। এই আইন চরমপন্থী অংশকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিয়ে চরমপন্থী ক্ষুব্ধ হয়। অন্যদিকে নরমপন্থীদের দাবি দাওয়া এই আইনের দ্বারা পূরণ করা হয়নি।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের গুরুত্ব
বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতির সাথে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, যেমন-
১. বেসরকারি সদস্য বৃদ্ধি
মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারাই ভারতে কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক আইনসভা গুলিতে প্রথম বেসরকারি সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। এর দ্বারা ভারতের প্রগতিশীল শ্রেণীর সরকারের আইন রচনার কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
২. শাসন বিভাগে অংশগ্রহণ
মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা বড়লাটের শাসন পরিষদে একজন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা হয়। এর ফলে সরকারি প্রশাসনে ভারতীয়দের যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়।
৩. স্বয়ত্বশাসনের সোপান
ভারতে স্বয়ত্বশাসনের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে মর্লে-মিন্টো আইন। এই আইনের প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক প্যাসিভেল স্পিয়ার বলেছেন ভারতে স্বয়ত্বশাসনের ব্যবস্থার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্ন ছিল।” বৃটেনের সাংসদ হেনরি কটন এই আইনকে ভারতের স্বয়ত্বশাসনের প্রবর্তনের লক্ষ্যে একটি ধীর পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন।
৪. আইনের শাসন
ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের আগে ভারতের মুঘল যুগ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রচলিত ছিল, তার পরিবর্তে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতের সাংবিধানিক রীতি নীতির প্রচলন ও আইনের শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে।
উপসংহার
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের ধারা সৃষ্ট ভারতীয়দের ক্ষোভ প্রসবের উদ্দেশ্যে পরবর্তী বড়লাট হার্ডিঞ্জ বঙ্গভঙ্গ রদের কথা ঘোষণা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে করে। এর দ্বারা আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা পৃথক প্রদেশের হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে বাংলা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরে বছরেই সরকার কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানীর স্থানান্তর করে। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে সরকার বোঝানোর চেষ্টা করে যে গৌরবময় মোঘল ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা জানাতেই দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হল।