মধ্যভারতীয় আর্যভাষা বিভিন্ন যুগে আত্মপ্রকাশ | প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার রূপ-রূপান্তর

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার রূপ-রূপান্তর

আনুঃ খ্রীঃ পূঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকেই আর্যদের একটি শাখা ঈরান থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল। তারা ভারতবর্ষে এসে যে ভাষা ব্যবহার করতাে, তাকে বলা হয় ‘ভারতীয় আর্যভাষা’ (Indo-Aryan Language)। এই ভাষা মূল ‘ইন্দো-ঈরানীয় ভাষা’র (Indo-Iranian Language) তথা ‘আর্যভাষা’র (Arayan Language) একটি প্রধান শাখা।

ভারতীয় আর্যভাষা সুদীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার বছরের পথ-পরিক্রমায় অন্ততঃ তিনটি সুস্পষ্ট পর্যায়ে বিভক্ত হয়েছে। ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে ঋগ্বেদে। ঋগ্বেদের প্রথমদিককার রচনাকাল সম্ভবতঃ খ্রীঃ পূঃ ত্রয়ােদশ শতক। ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীন যুগের শুরু এ থেকেই। তারপর ধারাবাহিক ক্রমে এসেছে অপর যুগগুলি। অতএব প্রথম যুগ

  • (১) প্রাচীন যুগ বা ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’ (খ্রীঃ পূঃ ত্রয়ােদশ-খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দী) 
  • (২) দ্বিতীয় যুগ বা ‘মধ্যভারতীয় আর্যভাষা’ (খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক—খ্রীঃ দশম শতক) এবং 
  • (৩) তৃতীয় যুগ বা ‘নব্য ভারতীয় আর্যভাষা’ (খ্রীঃ দশম শতক থেকে অদ্যাবধি)।

প্রাচীন ভারতে প্রায় হাজার বছর কাল সারা দেশে ভাষার যে একটি মাত্র রূপই প্রচলিত ছিল। তা নয়, দেশ-কাল-ভেদে তার মধ্যে যথেষ্ট রূপান্তর দেখা দিয়েছিল, এদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য ‘বৈদিক ভাষা’ অর্থাৎ যে ভাষায় বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল। এই ‘বৈদিক ভাষা’ বা ‘বৈদিক সংস্কৃত’ ছিল কথ্যভাষারই একটি মার্জিত রূপ। বৈদিক ভাষা ছাড়াও সম-সময়ে সম্ভবতঃ আর একটি ভাষা প্রচলিত ছিল যার সাহায্যে ‘লৌকিক সাহিত্য’ রচিত হতাে। এই ‘লৌকিক সাহিত্যের ভাষা’ দুর্ভাগ্যক্রমে লুপ্ত হয়ে গেছে। ঐ যুগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কথ্যভাষার মধ্যেও যে বেশ কিছু পার্থক্য ছিল, তা প্রায় সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

কথ্যভাষার অন্ততঃ তিনটি ধারার পরিচয় পাওয়া যায়,- ‘উদীচ্যা’ বা উত্তরাঞ্চলীয় কথ্যভাষা, ‘মধ্যদেশীয়’ বা মধ্যাঞ্চলের কথ্যভাষা এবং ‘প্রাচ্য’ বা পূর্বাঞ্চলের কথ্যভাষা। পূর্বোক্ত ‘লৌকিক সাহিত্যের ভাষা’র সংস্কার সাধন করে অন্ততঃ খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম শতকে কিংবা তার পূর্বেই সৃষ্টি করা হয়েছিল ‘সংস্কৃত’ তথা ‘লৌকিক সংস্কৃত’ ভাষার। এই ভাষা প্রধানতঃ সাহিত্য রচনার কাজেই ব্যবহৃত হতাে এবং ধর্মীয় সাহিত্য এবং ধর্মীয় কৃত্যে এখনও সর্বভারতে এই ভাষা ব্যবহৃত হয়ে চলছে। মহামুনি পাণিনি-কর্তৃক সংস্কারপূত এই সংস্কৃত ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার স্বীকৃতি লাভ করেছে। এবং এই ভাষায় বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থাদি রচিত হয়েছে। এগুলি ছাড়াও প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার আর একটি ধারার স্রষ্টা ছিলেন সেকালের মহাযানপন্থী বৌদ্ধাচার্যগণ। তারা সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে প্রাকৃত ভাষার মিশেল দিয়ে কালােপযােগী সহজবােধ্য যে ভাষা সৃষ্টি করেন, তাকে বলা হয় ‘বৌদ্ধসংস্কৃত’ বা ‘মিশ্র সংস্কৃত’। বৌদ্ধগণ এই ভাষায় অনেক শাস্ত্রীয় গ্রন্থ ও কাহিনী রচনা করেন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার এতগুলি রূপভেদ বর্তমান থাকলেও এদের মধ্যে প্রধান ‘বৈদিক সংস্কৃত’ ও ‘লৌকিক সংস্কৃত’।

মধ্যভারতীয় আর্যভাষা বিভিন্ন যুগে আত্মপ্রকাশ

মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার স্থায়িত্বকাল ছিল মােটামুটি দেড় হাজার বছর- খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীষ্টোত্তর দশম শতক পর্যন্ত। এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা তথা প্রাকৃত ভাষা তিনটি সুস্পষ্ট স্তরে রূপান্তরিত হয়েছে। 

  • (ক) আদিস্তর বা প্রাচীন প্রাকৃত, 
  • (খ) মধ্যস্তর বা সাহিত্যিক প্রাকৃত এবং 
  • (গ) অন্তন্তর বা অপভ্রংশ ও অবহট্ট।

(ক) আদিস্তরের প্রাচীন প্রাকৃত : আনুমানিক খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত এই পর্বের বিস্তৃতি কাল। হীনযানপন্থী বৌদ্ধসম্প্রদায়ের পালিভাষায় লিখিত বিভিন্ন শাস্ত্রে ও সাহিত্যে এবং মহামতি অশােকের অনুশাসন ও সমসাময়িক অপর কিছু কিছু শিলালিপিতে আদিস্তরের প্রাচীন প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া যায়।

বুদ্ধদেবের নির্দেশেই তার শিষ্যগণ সকায় নিরুত্তিয়া বা নিজস্ব মাতৃভাষায় বুদ্ধদেবের নির্দেশাদি এবং ধর্মীয় বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই ভাষাকে বলা হয় পালিভাষা। এই পালিভাষা কোন সমকালীন কথ্যভাষা না হলেও কোন কথ্য প্রাকৃতের আধারে গঠিত একটি মার্জিত সাহিত্যিক ভাষা। হীনযানপন্থী বৌদ্ধগণ তাদের ধর্মীয় ব্যবহারে এই পালিভাষা ব্যবহার করতেন। জাতকাদি-কাহিনী গ্রন্থে পালিভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে।

পালিভাষা ছাড়া প্রাচীন প্রাকৃতের অপর নিদর্শন পাওয়া যায় বিভিন্ন শিলালিপিতে, এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য (ক) অশোক অনুশাসন, (খ) খারবেল অনুশাসন (গ) সুতনুকা প্রত্নলেখ এবং (ঘ) হেলিওদোরের গরুড়স্তম্ভ-লিপি।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে গিরিগাত্রের স্তম্ভে খােদিত অশােকের অনুশাসনে সমকালীন ভারতে প্রচলিত কিছু আঞ্চলিক ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায়। খ্রীঃ পূঃ তৃতীয় শতকে ভারতবর্ষে প্রাচীন প্রাকৃতে অন্ততঃ নিম্নোক্ত আঞ্চলিক রূপগুলি যে প্রচলিত ছিল, সমকালীন বিভিন্ন শিলালিপি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ—উত্তর-পশ্চিমা, দক্ষিণ-পশ্চিমা, মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যা। অশােকের গিরিলিপি প্রস্তরলিপি (Major Rock Edict), ক্ষুদ্র গিরিলিপি (Minor Rock Edict), স্তম্ভলিপি (Pillar Inscription) এবং গুহালিপিতে (Cave Inscription) এই কয়টি আঞ্চলিক ভাষারূপের পরিচয় পাওয়া যায়।

খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতকে উড়িষ্যার খারবেল-কৃত যে অনুশাসন পাওয়া যায় তার ভাষার সঙ্গে অশােক-অনুশাসনের প্রাচ্যাভাষার সাদৃশ্য কম, বরং দক্ষিণা-পশ্চিমা ভাষার সঙ্গেই মিল বেশী। উত্তর প্রদেশের রামগড় পাহাড়ের যােগীমারা গুহায় তিন পংক্তির একটি প্রত্নলিপি পাওয়া গেছে-

‘শুতনুক নাম দেবদশিক্যি। 

তং কময়িথ বলনশেয়ে

দেবদিনে নম লুপদখে।’

অর্থাৎ সুতনুকা নামে দেবদাসী- তাকে কামনা করেছিল বারাণসীবাসী দেবদিগ্ন (দেবদত্ত ?) নাম রূপদক্ষ। এটিকে ‘সুতনুকা প্রত্নলিপি’ নামে অভিহিত করা হয়। এর ভাষাগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে এটিকে বলা হয় ‘পূর্বপ্রাচ্যা’—যার সঙ্গে পরবর্তী কালের ‘মাগধী প্রাকৃতে র যথেষ্ট নিকট সম্বন্ধ রয়েছে।

প্রাচীন প্রাকৃত ছাড়াও এ যুগে ‘গাথা ভাষা’ নামে একটা মিশ্র ভাষা গড়ে উঠেছিল মহাযানপন্থী বৌদ্ধগণ সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাকৃত মিশিয়ে এই ভাষা (এরই নামান্তর ‘মিশ্রসংস্কৃত’ বা ‘বৌদ্ধ সংস্কৃত’) সৃষ্টি করে তাদের শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচনা করেছিলেন।

(খ) মধ্যস্তরের সাহিত্যিক প্রাকৃত: আচার্য সুকুমার সেন খ্রীঃ পূঃ ২০০ অব্দ থেকে খ্রীষ্টোত্তর দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত বিস্তৃত কালকে পৃথক ক্রান্তিকাল বলে স্বীকার না করে এটিকেও মধ্যযুগের অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। ফলতঃ খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে ৬০০ খ্রীঃ কালকেই আমরা প্রাকৃতের মধ্যস্তর তথা ‘সাহিত্যিক প্রাকৃতে’র যুগ বলে অভিহিত করতে পারি। এই স্তরের ভাষাও প্রাচীন প্রাকৃতের বহুধা বিভক্ত ছিল। প্রধানতঃ সংস্কৃত নাটকের বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর মুখে এ জাতীয় প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া যায় বলেই য়ুরােপীয় ভাষাবিজ্ঞানীরা একে Dramatic Prakrit নামে আখ্যায়িত করেছিলেন—আমরা এটিকেই বলি ‘সাহিত্যিক প্রাকৃত’।

প্রাকৃত বৈয়াকরণগণ সাহিত্যিক প্রাকৃতের নিম্নোক্ত শ্রেণীবিভাগ করেছে—মাহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, মাগধী, অর্ধমাগধী, পৈশাচী ও অপভ্রংশ। এ কালের ভাষাবিজ্ঞানীরা অবশ্য অপভ্রংশকে ‘সাহিত্যিক প্রাকৃত’ না বলে সর্বপ্রকার প্রাকৃতের শেষ পরিণতি বলে গ্রহণ করে থাকেন।

  • মাহারাষ্ট্র প্রাকৃত: বৈয়াকরণগণ মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতকেই আদর্শ প্রাকৃতরূপে গ্রহণ করলেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল সম্ভবতঃ অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালেই। সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনতম নাট্যকার অশ্বঘােষের নাটকে অন্যান্য প্রাকৃত থাকলেও মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের ব্যবহার নেই। পরবর্তী সংস্কৃত নাটকে গানের ভাষা মাহারাষ্ট্রী। এ ছাড়া মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে বহু স্বাধীন কাব্য-মহাকাব্যনাটকও রচিত হয়েছে-অপর কোন প্রাকৃতের এ সৌভাগ্য হয় নি। সেদিক থেকে সর্বপ্রকার সাহিত্যিক প্রাকৃতের মধ্যে এর গুরুত্বই সর্বাধিক।
  • শৌরসেনী প্রাকৃত: সংস্কৃত নাটকে সাধারণতঃ নারীর মুখের ভাষা শৌরসেনী প্রাকৃত। এই প্রাকৃতটি শূরসেন বা মথুরা অঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল বলে অনুমান করা চলে। দু একটি স্থল ছাড়া মহারাষ্ট্র প্রাকৃতের সঙ্গে এর বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কারাে কারাে মতে শৌরসেনী প্রাকৃত থেকেই মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের উদ্ভব ঘটে। সংস্কৃত ভাষার প্রভাব শৌরসেনী প্রাকৃতেই সর্বাধিক লক্ষিত হয়।
  • মাগধী প্রাকৃত: নাম থেকে অনুমিত হয় যে মাগধী প্রাকৃতের উদ্ভবস্থল মগধ। কিন্তু সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত মাগধী প্রাকৃত কোন অঞ্চলেরই কথ্যভাষা ছিল না। সংস্কৃত নাটকে সাধারণতঃ অশিক্ষিত নীচ জাতীয় পাত্রের মুখে ব্যবহৃত এই মাগধী প্রাকৃত নাটকে হাস্যরস সৃষ্টির জন্য কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষারূপেই উদ্ভূত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ‘সুতনুকা’ প্রত্নলিপিতে যে সকল ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, সেই সমস্ত লক্ষণ মাগধী প্রাকৃতেও উপস্থিত, যথাতিনটি শিস্ধ্বনির মধ্যে শুধু শ-এর ব্যবহার, ‘র’-স্থলে ‘ল’ এবং পদান্তে বিসর্গ-যুক্ত ‘অ’ স্থলে ‘এ’ ব্যবহার। এ থেকে অনুমান করা চলে যে প্রাচীন প্রাকৃতের পূর্বীপ্রাচ্যাই ক্রমবিবর্তনের ফলে মাগধী প্রাকৃতে রূপান্তরিত হয়েছে। সংস্কৃত নাটকের বাইরে মাগধী প্রাকৃতের কোন ব্যবহার পাওয়া যায় নি। ‘চাণ্ডালী’, ‘শাবরী’, ‘শিকারী’ প্রভৃতিকে মাগধী প্রাকৃতের বিভাষা বলে উল্লেখ করেছেন বৈয়াকরণরা।
  • অর্ধমাগধী: জৈন সাধুগণ তাদের ধর্মশাস্ত্রে অর্ধমাগধী প্রাকৃত ব্যবহার করেছেন, এর নামান্তর আর্যপ্রাকৃত বা জৈনপ্রাকৃত। অশ্বঘােষের নাটকে অর্ধমাগধীর ব্যবহার রয়েছে। এই প্রাকৃতে যেমন মাগধীর লক্ষণ বর্তমান, তেমনি রয়েছে শৌরসেনী এবং মাহারাষ্ট্রীরও কিছু কিছু লক্ষণ। ফলতঃ অর্ধমাগধীকে একটি মিশ্রকৃত বলেই গ্রহণ করা চলে। এতে সংস্কৃত ভাষার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এই ভাষায় বহু জৈনগ্রন্থাদি রচিত হয়েছে।
  • পৈশাচী প্রাকৃত: প্রাচীন বৈয়াকরণগণ পৈশাচী প্রাকৃতের নাম উল্লেখ করলেও কার্যতঃ এর কোন ব্যবহার পাওয়া যায় না। তবে গুণাঢ্য পৈশাচী প্রাকৃতেই তাঁর ‘বড্ডকহা’ (বৃহৎকথা) গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রন্থটির বিলুপ্তির জন্য এই ভাষার নিদর্শন দুর্লভ। কেহ কেহ মনে করেন, পৈশাচী প্রাকৃত মূলতঃ ভারতীয় আর্যভাষার অন্তর্ভুক্ত নয়, এটি দরদীয় ভাষার একটি শাখা। আবার গান্ধারী প্রাকৃতের সঙ্গেও এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
  • অপভ্রংশ: প্রত্যেক সাহিত্যিক প্রাকৃতের শেষ পরিণতিই অপভ্রংশ। এটি পৃথক কোন সাহিত্যিক প্রাকৃত নয়। (পরবর্তী আলােচনা দ্রষ্টব্য)

(গ) অন্ত্যস্তর অপভ্রংশ: প্রাকৃত বৈয়াকরণগণ অন্যতম প্রাকৃত-রূপেই অপভ্রংশের কথা উল্লেখ করেছেন এবং ‘প্রাকৃত’ শব্দটির পূর্বেই পতঞ্জলির মহাভাষ্যে ‘অপভ্রংশ’ শব্দটিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু একালের ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, প্রতিটি সাহিত্যিক প্রাকৃতেরই অস্তযস্তর ছিল তত্তৎ নামীয় অপভ্রংশ। সংস্কৃতে রচিত মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রমাের্বশী’ নাটকেই সর্বপ্রথম অপভ্রংশের ব্যবহার পাওয়া যায়।

প্রাকৃত ব্যাকরণকারগণ ‘নাগরক অপভ্রংশ’কেই শ্রেষ্ঠ অপভ্রংশরূপে অভিহিত করেছে এবং ‘ব্রাচড়ক, উপনাগরক, বৈদর্ভী, লাটী, গৌড়ী চক্কা, পাঞ্চালী, সিংহল’ প্রভৃতি অপভ্রংশকে বলেছেন ‘বিভাষা’। কার্যতঃ আমরা শৌরসেনী অপভ্রংশেরই সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি। সম্ভবতঃ এটিই প্রাকৃত বৈয়াকরণ-কথিত ‘নাগরক অপভ্রংশ’। শৌরসেনী-প্রাকৃতের ক্রমবিবর্তনে শৌরসেনী অপভ্রংশের উদ্ভব, এই সূত্র-অবলম্বনে আমরা মাগধী অপভ্রংশ এবং মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশের সম্ভাব্যতার কথা অনুমান করে থাকি। কিন্তু বাস্তবে এই সমস্ত অপভ্রংশের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না।

অপভ্রংশের স্থিতিকাল ৬০০ খ্রীঃ—১০০০ খ্রীঃ, কিন্তু কার্যতঃ দেখা যায়, সংস্কৃত এবং নবােস্ভূত নব্য ভারতীয় আর্যভাষার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে অপভ্রংশ এবং তার অর্বাচীন রূপ ‘অবহটঠ’ (>অপভ্রষ্ট) অন্ততঃ চতুর্দশ অথবা পঞ্চদশ শতক অবধি অব্যাহতভাবেই বর্তমান ছিল। নব্যভারতীয় আর্যভাষার একজন প্রধান কবি বিদ্যাপতি অবহট্ঠ ভাষার দু’খানি গ্রন্থও রচনা করেছে।

অপভ্রংশ/অবহট্ঠ ভাষায় জৈনগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। আবার ধর্মভাবমুক্ত বহু সাহিত্যও এই ভাষাতেই রচিত হয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য: ধনপালের ‘ভবিসত্তকহা’, আব্দুর রহমানের ‘সংনেহর রাসক’, চাদ্দ বরদাইরচিত ‘পৃথ্বীরাজ রাসৌ’, পিঙ্গলাচার্য রচিত ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ এবং বিদ্যাপতি-রচিত ‘কীর্তিলতা’।

অবহট্ঠ ভাষা থেকেই ‘প্রত্ন নব্য ভারতীয় ভাষা’র মাধ্যমে আনুঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে ‘নব্য ভারতীয় আর্য’ তথা আধুনিক ভারতবর্ষে প্রচলিত বাঙলা, অসমীয়া, হিন্দী, পাঞ্জাবী, মারাঠি প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছে। লক্ষণীয় এই যে এই সকল নানা ভারতীয় আর্যভাষা যখন আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত, তখনও কিন্তু সমগ্র উত্তর ভারতে সাধুভাষা-রূপে অবহট্ঠ ভাষা প্রচলিত ছিল। এমনকি, একই ব্যক্তি একই সঙ্গে অবহট্ঠ ভাষা এবং নব্য ভারতীয় ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন এমন দৃষ্টান্তও দুর্লভ নয়। সরহপাদ বাঙলা ভাষায় ‘চর্যাপদ’ রচনা করেছেন, আবার অবহট্ঠ ভাষায় ‘দোহা’ রচনা করেছেন।

অনার্স বাংলা প্রথম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment