ভারতের গণপরিষদ
সূচনা
দেশবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে সংবিধান রচনাকারী সংস্থা হল গণপরিষদ। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মতে -“পরিশোধ কর্তৃক রচিত সংবিধানের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামী চিন্তা ও চেতনা এবং জনগণের আশা আশঙ্কা প্রতিফলিত হয়।”
১. গঠন
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে গণপরিষদ গঠনে বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রথম গণপরিষদ গঠনের দাবি তোলে। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মঞ্চে মিশনের পরিকল্পনা অনুসারে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে ভারতীয় গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা হয়। এই চারটি মূলনীতি হলো –
(১) ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশে ও দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে জনসংখ্যার অনুপাত সদস্য নির্বাচিত হয়ে গণপরিষদ আসবেন।
(২) গণপরিষদের সব আসন সাধারন, মুসলমান, শিখ এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভক্ত হবে।
(৩) প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যগণ নিজে নিজে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।
(৪) দেশীয় রাজ্যগুলি ৯৩ জন প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে এদের ৫০ শতাংশ নির্বাচিত ৫০ শতাংশ মনোনীত সদস্য হবেন।
২. উদ্দেশ্য
স্বাধীনতা লাভের মধ্যে দিয়ে জাতীয় বিপ্লবের কাজ সম্পন্ন হলে সামাজিক বিপ্লব সাধনের কাজ বাকি রয়ে যায়। গণপরিষদ গঠনের মধ্যে দিয়ে ভারতের দুঃখ দারিদ্র্যের অবসান ঘটানো, যাবতীয় বৈষম্য লোভ ও শোষণের অবসান ঘটাতে চাওয়া হয়। গণপরিষদের সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেছিলেন -“দুঃখ দারিদ্র্যের অবসান, বৈষম্য ও শোষণের বিরোধ এবং সুন্দর জীবন যাত্রার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করাই হবে গণপরিষদে লক্ষ্য।”
৩. সদস্যদের নির্বাচন
গণপরিষদের মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩৮৯ জন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষভাবে গণপরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের গণপরিষদের ২৯৬ জন সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনের কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। গণপরিষদ বহু গণমান্য ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসেন। তারা হলেন বল্লভ ভাই প্যাটেল, জহরলাল নেহেরু, বি. আর. আম্বেদকর, মৌলোনা আবুল কালাম আজাদ, চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি, কৃষ্ণস্বামী আয়ার প্রমুখ।
৪. কার্যাবলী
(১) সভাপতি নির্বাচন : গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বলে 1946 খ্রিস্টাব্দে ৯ ডিসেম্বর। ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।
(২) বিভিন্ন কমিটি গঠন : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। সেখানে কয়েকটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটির গঠন হয়, যেমন- কার্য নির্বাহ কমিটি, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কিত কমিটি, মৌলিক অধিকার বিষয়ক কমিটি ইত্যাদি। স্বাধীনতা লাভের পর এই গণপরিষদ বিভক্ত হয়ে ভারতীয় গণপরিষদ ও পাকিস্তান গণপরিষদ নামে দুটি স্বতন্ত্র সংস্থার জন্ম হয়।
(৩) খসড়া সংবিধান প্রণয়ন : গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশনে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে মাউন্টব্যাটনের কে স্বাধীন ভারতের প্রথম গর্ভনর জেনারেল নিয়োগ করা হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে জি. ভি. মাভলঙ্কর নির্বাচিত হন। গণপরিষদে প্রথম আইনসভা হিসেবে কাজ শুরু করে। পঞ্চম অধিবেশনের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড. বি. আর. আম্বেদকর খসড়া কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। মোট ১৬৫ দিন ধরে ১১ টি অধিবেশনের খসড়া সংবিধান রচনার কাজ সম্পন্ন করা হয়। বিভিন্ন সংসদীয় প্রস্তাবে আলোচনার পর 1949 খ্রিস্টাব্দে ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়।
(৪) নতুন সংবিধান গ্রহণ : গণপরিষদের শেষে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ জানুয়ারি। এই অধিবেশনে নতুন সংবিধান কার্যকর হয়। ভারতের বৃহত্তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ।
৫. প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য
(১) গণতান্ত্রিক চরিত্র বিশিষ্ট নয় : গণপরিষদের সদস্যরা সাধারণ ভারতবাসী দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত ছিলেন না। অর্থাৎ বলা চলে গণপরিষদের চরিত্র সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ছিল না।
(২) আপসধর্মী : ভারতীয় গণপরিষদ ছিল আসলে ব্রিটিশের সঙ্গে কংগ্রেসের নেতাদের আপসরফার হল।
(৩) একদলীয় : ভারত বিভাজন হয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে মুসলিম লীগের সদস্যরা পাকিস্তানের চলে যায়। ফলে কংগ্রেস একক পরিচালনায় গঠিত হয় গণপরিষদ।
মূল্যায়ন
বহু জাতি, ধর্ম ও ভাষাভাষী অধ্যুষিত ভারতবর্ষের জন্য সর্বজন গ্রাহক শাসনতন্ত্র রচনার কাজটি ছিল খুবই জটিল। স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত দেশীয় রাজ্যের বাসিন্দা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, অনুন্নত জাতীয় উপজাতিসহ সব স্তরের মানুষের আশা আশঙ্কাকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই সংবিধান। সংবিধান অনুসারে ভারতবর্ষে প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভারতীয় গণপরিষদের প্রকৃতি
সূচনা
ভারতীয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত যে সংস্থাটি দেশের সংবিধান রচনা করে, তা হল গণপরিষদ। গণপরিষদের একদলীয়, দক্ষিণপন্থী, পুঁজিবাদী শ্রেণীর প্রতিনিধিবর্গের সমাবেশ ঘটেছিল। শতকরা ১৪ ভাগ নাগরিকদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত প্রাদেশিক আইনসভা গুলি গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট থেকে গণপরিষদ সার্বভৌম পরিষদের মর্যাদা লাভ করে।
গণপরিষদের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়য –
১. জনপ্রতিনিধিত্ব হীন
ভারতীয় গণপরিষদকে কোনভাবেই জনপ্রতিনিধিত্ব মূলক বলা চলে না। কেননা সদস্যগণ ভারতীয়দের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত ছিলেন না। অর্থাৎ গণপরিষদের সদস্য কোন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভারতীয়দের দ্বারা নির্বাচিত হননি। তাই প্রকৃতিগত বিচারে গণপরিষদ জনপ্রতিনিধিত্ব হীন এক পরিষদ।
২. আইনবিদদের প্রাধান্য
গণপরিষদ ছিল আইনবিদদের প্রাধান্য বিশিষ্ট এক পরিষদ। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মূলত যে ২১ জন সদস্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল, তার মধ্যে ১১ জনই ছিল বিশিষ্ট আইনবিদ। এই আইনবিদগণ সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিভিন্ন ধারা-উপধারা গুলির বিচার বিবেচনা কে প্রাধান্য দিয়েছেন। আইভর জেনিংস তাই গণপরিষদ কে আইনজীবীদের স্বর্গ বলে উল্লেখ করেছেন।
৩. একদলীয়
সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি না থাকায় ভারতীয় গণপরিষদ সর্বজনীন চরিত্র লাভ করতে পারেনি। দেশ বিভাগের ফলে লীগের সদস্যরা পাকিস্তানের চলে গেলে ভারতীয় গণপরিষদ সম্পূর্ণরূপ একটি দলীয় সংস্থার পরিণত হয়। সোমনাথ লাহিড়ী কমিউনিস্ট দলের তরফের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও দেশবিভাগ জনিত কারণে তাকে সদস্যপদ খোয়াতে হয়। তাই কোন কোন ঐতিহাসিক গণপরিষদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন -গণপরিষদে ছিল কংগ্রেসের এবং কংগ্রেস ছিল ভারত।
৪. আপস্মুখী
ভারতীয় গণপরিষদ ছিল দেশীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে কংগ্রেসের নেত্রীবৃন্দের আপসরফার ফল। গণপরিষদের দেশের রাজন্যবর্গের তরফে যোগদানকারী প্রতিনিধিবর্গ সর্বদা সমান তান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার প্রয়াস চালাত এছাড়া গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততন্ত্রের আপসরফার প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেশীয় রাজন্যবর্গের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়, যেমন -দেশীয় রাজন্যবর্গের ভাতা, খেতাব, উপাধি প্রভৃতি বজায় রাখার অধিকার দান আপসমুখীতরাই নির্দেশন।
৫. অগণতান্ত্রিক
দেশীয় রাজন বর্গের গণপরিষদে ৯৩ জন সদস্য মনোনয়নের ক্ষমতা দেওয়ার ফলে গণপরিষদ তার গণতান্ত্রিক প্রকৃতি হারায়। দামোদর স্বরূপ শেড সমালোচনার সুরে বলেছেন -দেশবাসীর সতর্ক করা ১৪ ভাগ কর্তৃক পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ কখনোই সকল দেশবাসীর হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।