ভারতের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সংবিধানের প্রাধান্য ব্যাখ্যা করাে। ‘সংবিধানের প্রাধান্য’ বলতে কী বোঝায় | ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করাে।

সংবিধানের প্রাধান্য

ভারতের সংবিধান কেবল সর্বোচ্চ আইন নয়, সমস্ত ক্ষমতা এবং অধিকারের উৎসও বটে। সংবিধান সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে। সংবিধান বিরােধী কোনাে আইন সরকার প্রণয়ন করলে সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করে সংবিধানের পবিত্রতা ও প্রাধান্য রক্ষা করে।

ভারতের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সংবিধানের প্রাধান্য

ভারতের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সংবিধানের প্রাধান্য। সংবিধানের কোথাও সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে বর্ণনা করা না হলেও, পরােক্ষভাবে সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছে | সংবিধান রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকারের উৎসস্থল। সরকারের প্রতিটি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে সংবিধানের নির্দেশ মেনে কাজ করতে হয়। শাসন বিভাগের কোনাে নির্দেশ বা আইন বিভাগ প্রণীত কোনাে আইন সংবিধানবিরােধী হলে, সুপ্রিমকোর্ট সেই আইন বাতিল করে সংবিধানের পবিত্রতা ও প্রাধান্য রক্ষা করে। যেমন一

  • [1] গােলকনাথ মামলায় (১৯৬৭) সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, মৌলিক অধিকারগুলিকে সংকুচিত বা বাতিল করার জন্য কোনােরূপ সংবিধান সংশােধন আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা পার্লামেন্টের থাকবে না। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের এই রায় নাকচ করে পার্লামেন্ট সংবিধান সংশােধন করে (২৪তম সংবিধান সংশােধন, ১৯৭১)। ফলে পার্লামেন্ট পুনরায় মৌলিক অধিকার-সহ সংবিধানের যেকোনাে অংশ সংশােধন করার ক্ষমতা লাভ করে এবং সংবিধানের প্রাধান্য অনেকটাই ক্ষুন্ন হয়।
  • [2] ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় আবার সুপ্রিমকোর্ট রায় দেয় যে, পার্লামেন্ট সংবিধানের মৌল কাঠামাের কোনাে পরিবর্তন সাধন করতে পারে না।
  • [3] আবার, সংবিধান সংশােধন করে (৪২তম সংবিধান সংশােধন, ১৯৭৬) বিচার বিভাগের কাছ থেকে সংবিধান সংশােধনের বৈধতা বিচার করার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হলে মিনার্ভা মিলস মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্ট সংবিধান সংশােধনী আইনের ওই অংশটিকে বাতিল করে দেয়।

এভাবে ভারতে সংবিধানের প্রাধান্য রক্ষিত হয়েছে এবং সুপ্রিমকোর্টও সংবিধানের প্রাধান্য ও পবিত্রতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছে।

ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি

ভারতীয় সংবিধান রচনা করে গণপরিষদ (Constituent Assembly)। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদ গঠিত হয়। প্রায় তিন বছর যাবৎ বিভিন্ন বিষয় আলাপ-আলােচনা, তর্ক-বিতর্কের পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি থেকে ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয়। ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমেই যেসব দিকের কথা বলা যায় সেগুলি হল- 

  • [1] সংবিধানের আকৃতি, 
  • [2] সংবিধান সংশােধনের পদ্ধতিসমূহ এবং 
  • [3] সংবিধানের পর্যালোচনা।

[1] সংবিধানের আকৃতি: ভারতীয় সংবিধানকে সারা বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান যখন কার্যকর সে সময় ৩৯৫টি ধারা এবং ৮টি তপশিল নিয়ে ভারতীয় সংবিধান রচিত হয়েছিল। বর্তমানে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশােধনের পর ভারতীয় সংবিধানের সর্বমােট ধারা প্রায় ৪৫০ এবং তপশিলের সংখ্যা ১২ দাঁড়িয়েছে। বিচারপতি মহাজনের ভাষায় বলা যায়, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সংবিধান ভারতীয় সংবিধানের মতাে এত বেশি বিস্তৃত ও ব্যাপক নয় (“No country in the world has such an elaborate and comprehensive Constitution as we have in his country”)|

তবুও ভারতীয় সংবিধানে কিছু অলিখিত অংশ থেকে গেছে। আসলে কোনাে সংবিধান বাস্তবে পুরােপুরি লিখিত বা পুরোপুরি অলিখিত হয় না। লােকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতারূপে প্রধানমন্ত্রীর নিয়ােগ, প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব, সংসদীয় সুযােগসুবিধা ইত্যাদি আরও অনেক বিষয় অলিখিত থেকে গেছে।

[2] সংবিধান সংশােধনের পদ্ধতিসমূহ: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের সংশােধন পদ্ধতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ভারতীয় সংবিধান যাতে গতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে জাতীয় স্বার্থ ও প্রয়ােজন পূরণের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায় সে ব্যাপারে সংবিধান প্রণেতারা সজাগ ছিলেন।

ভারতের সংবিধানের বিংশতি অধ্যায়ে ৩৬৮ নং ধারায় সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে-

  • সরল পদ্ধতি: সংবিধানের অন্তর্গত কতকগুলি বিষয়ের পরিবর্তন বা সংশােধন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির। সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে সংবিধান সংশােধন করা হয়। এজন্য কোনাে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়ােজন হয় না। যেসব বিষয় এই পদ্ধতির অধীনে সংশােধন করা যায় তার মধ্যে রয়েছে, নতুন রাজ্যের সৃষ্টি বা পুরােনাে রাজ্যের সীমানা বা নাম পরিবর্তন, নাগরিকতা, বিধান পরিষদ সৃষ্টি বা বিলােপসাধন, সংসদ সদস্যের বিশেষ অধিকার এবং বেতন ও ভাতা, সরকারি ভাষা, দেশের নির্বাচন, সুপ্রিমকোর্টের এলাকা সম্প্রসারণ প্রভৃতি।
  • আংশিক জটিল পদ্ধতি: ৩৬৮ নং ধারায় উল্লিখিত সংবিধান সংশােধনের এই পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধানের কিছু নির্দিষ্ট অংশের সংশােধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মােট সদস্যের অর্ধেকের বেশি এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়ােজন হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সংবিধানের তৃতীয় ও চতুর্থ অংশের যথাক্রমে মৌলিক অধিকার ও নির্দেশাত্মক নীতিসমূহের ধারাগুলির পরিবর্তন করা যায়।
  • জটিল পদ্ধতি: সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারায় জটিল পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী প্রথমে সংশােধনী প্রস্তাবটিকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মােট সদস্যদের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ কর্তৃক সমর্থিত হতে হবে। এরপর প্রস্তাবটিকে রাজ্য আইনসভাগুলির অনুমােদনের জন্য পাঠানাে হয়। এক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেক রাজ্য আইনসভার অনুমােদন পাওয়া গেলে প্রস্তাবটিকে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে সমস্ত বিষয় এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত তাদের মধ্যে রয়েছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার বন্টন, কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতার পরিধি, সুপ্রিমকোর্ট এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও রাজ্যগুলির হাইকোর্ট-সংক্রান্ত বিষয়, সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি ইত্যাদি।

[3] সংবিধানের পর্যালােচনা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে অতিমাত্রায় দুষ্পরিবর্তনীয় বা ব্রিটেনের মতাে সুপরিবর্তনীয় এই দুইয়ের মধ্যে ভারতীয় সংবিধানকে ফেলা যায় না। 

  • প্রথমত, ভারতের সংবিধানে সুপরিবর্তনীয়তা এবং দুম্পরিবর্তনীয়তার এক সমন্বয় ঘটেছে।
  • দ্বিতীয়ত, কোনাে সংবিধানসভা আহ্বান করে সংশােধনের ব্যবস্থা এখানে নেই। পার্লামেন্টের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেলে ক্ষমতাসীন দল খুব সহজেই সংবিধান সংশােধন করতে পারে। তা ছাড়া ২৪তম সংশােধন অনুসারে সংবিধান বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতিপ্রদান বাধ্যতামূলক হওয়ায় সংবিধান সংশােধনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কোনাে কার্যকরী ভূমিকা নেই।
  • তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে থেকেও সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির তেমন কোনাে ভূমিকা নেই। রাজ্যগুলিকে সংবিধান সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপনের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তবে রাজ্য বিধানসভা উচ্চকক্ষের সৃষ্টি বা বিলােপের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করে পার্লামেন্টকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরােধ করতে পারে। অবশ্য পার্লামেন্ট এই অনুরােধ রক্ষা করতে বাধ্য নয়।
  • চতুর্থত, রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের ব্যাপারে পার্লামেন্ট একক ক্ষমতা ভােগ করে। এক্ষেত্রে রাজ্য আইনসভার মতামতের কোনাে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধী।
  • পঞ্চমত, কেন্দ্র এবং অর্ধেক রাজ্যে কোনাে একটি রাজনৈতিক দলের গরিষ্ঠতা থাকলে ভারতীয় সংবিধানের সব অংশ সুপরিবর্তনীয় হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন যে, ভারতীয় সংবিধানের এই নমনীয়তা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গতিশীলতা বজায় রাখার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই সুপরিবর্তনীয় প্রবণতা সংবিধানের দুর্বলতা এবং দুটির পরিচয়ও দেয়। ঘন ঘন সংবিধান পরিবর্তনে মৌলিকত্ব অক্ষুন্ন থাকে না। তবে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মিনার্ভা মিলস মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রায়দান প্রসঙ্গে ৪২তম সংশােধনীর ৫৫নং ধারা অবৈধ বলে ঘােষণা করে। এর ফলে পার্লামেন্ট সংবিধানের মৌলিক কাঠামাে সংশােধন করতে পারে না, এ ছাড়া যেকোনাে সংবিধান সংশােধন বিচার বিভাগের সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত বলে জানানাে হয়। কাজেই সুপ্রিমকোর্টের এই রায়দানের পর বর্তমানে পার্লামেন্টের সংবিধান সংশােধন ক্ষমতাকে চরম বা অসীম বলে অভিহিত করা যায় না।

উপসংহার: ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণের শেষে বলা যায় যে, ভারতীয় সংবিধানে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠালাভ করলেও আর্থসামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তা ছাড়া ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি যুক্তরাষ্ট্রীয় হলেও সংবিধানে কেন্দ্রকে যতটা শক্তিশালী করা হয়েছে রাজ্যগুলিকে তা করা হয়নি। সংবিধানে রাজ্যগুলির ক্ষমতা বিশেষভাবে সীমিত। এই কারণে অধ্যাপক কে সি হােয়ার, ড. আম্বেদকর প্রমুখ বিশেষজ্ঞ ভারতকে একটি পূর্ণাঙ্গ যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের দেশ বলে অভিহিত করতে সম্মত হননি। বস্তুত, স্বাভাবিক অবস্থায় ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােকে বজায় রাখার জন্য ব্যবস্থাদি গৃহীত হয়েছে কিন্তু অস্বাভাবিক অবস্থায় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র এককেন্দ্রিক কাঠামােয় রূপান্তরিত হয়। ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পি বি গজেন্দ্র গাদকরের মতে, ভারতের সংবিধান রচয়িতারা দেশের ঐক্যের দিকে তাকিয়ে সংবিধান রচনা করেছিলেন। যদিও এটি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের সংবিধান তবু প্রকৃত অর্থে একে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বলা যায় না।

Political Science (H.S-11) all Questions/Answers here

Leave a Comment