ভারতের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ বা উদ্দেশ্য গুলি কি ছিল? জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব লেখো?

সূচনা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জটিল পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্ত থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা বিভিন্ন দেশে নিজেদের দূরে রেখে জাতীয় স্বার্থ ও নব লব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য ভারত জোট নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি গ্রহণ করে। জোট নিরপেক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশ ছিল ভারত, মিশর, যুগোশ্লাভিয়া, ইন্দ্রোনেশিয়া, ঘানা, শ্রীলংকা প্রভৃতি। এই আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নেতা ছিলেন ভারতের জ‌ওহরলাল নেহেরু, মিশরের গামাল আবদেল নাসের, যুগোশ্লাভিয়া মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়া সুকর্ণ, ঘানার নক্রমা প্রমুখ।

জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের কারণ বা উদ্দেশ্য

ভারতের জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের কারণ গুলি হল –

১. ভৌগোলিক

এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ এমন একটা জায়গা ভারতের অবস্থান যা তাকে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী দেশে পরিণত করেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চীন, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির পরোক্ষ প্রভাব জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণে ভারতকে প্রভাবিত করেছে।

২. জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষা

সুপ্রাচীন কাল থেকে অহিংসা, শান্তি, সহমর্মিতা ও সহনশীলতার আদর্শে ভারত বিশ্বাসী। হিংসা জর্জরিত পৃথিবীতে বুদ্ধ ও অশোকের শান্তির বাণী ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ বিদেশ ছাড়িয়ে পড়েছিল। ক্ষমতার শীর্ষে উঠে ও আকবর ও শিবাজী সহনশীলতার কথা প্রচার করেন। এই সুমহান আদর্শ ও জাতীয় ঐতিহ্য বহন করার উদ্যোগ থেকেই ভারত সরকার জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণে অগ্রসর হয়।

৩. রাজনৈতিক স্বতন্ত্রতা

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত পুঁজিবাদ বা সাম্যবাদ কোন একটিকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেনি। কারণ ভারত গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নিজেই ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্য ও ফ্যাসিবাদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। জহরলাল নেহেরু বলেছেন বিশ্বের পক্ষে ও আমাদের পক্ষে যা ক্ষতিকর্তা আমরা নির্দ্বিধায় নিন্দা করব।

৪. অর্থ-সামাজিক উন্নত

স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরের মুহূর্ত থেকে ভারতে এক গভীরতর আর্থসামাজিক সংকটের মুখে পড়ে। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, বেকারত্ব, খাদ্য ভাব, কালোবাজারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এসব সমস্যার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়লে নেহেরু স্বতন্ত্র আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণের দারা আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে সচেষ্ট হন।

৫. জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ

জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে কোন দেশেরই পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারিত হয় না। তবে এই স্বার্থ সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু কখনোই উপেক্ষিত হতে পারে না। সাম্যবাদী বাগ ধনতন্তবাদী কোন জুটির মধ্যে না গিয়ে নেহেরু মিশ্র অর্থনীতি ও স্বাধীন বিদেশী নীতি গ্রহণের দ্বারা জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে নেহেরু বলেছেন – “স্বাভাবিকভাবেই আমি ভারতের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেছি কারণ এটি আমার প্রধান কর্তব্য”।

৬. আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী ও ধনতন্ত্রবাদী এই দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তি জোটের বিভক্ত বিশ্ব যখন ঠান্ডা লড়াই মত্ত, কখন ভারতে কোন জোটের অংশগ্রহণ না করে নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। কারণ দ্বিমেরও যুক্ত বিষ্ময় কোন এক পক্ষ অবলম্বন করলে ভারতীয় যুদ্ধের দায়ভার নিতে হতো, এতে ভারতের অগ্রগতি ব্যাহত হতো।

৭. তৃতীয় শক্তি জোটের নেতৃত্ব

যে সমস্ত দেশ ঠান্ডা লড়াইয়ের বাইরে থাকতে চাইছিল, কি আয়তন, কি জনসংখ্যা উভয় ব্যাপারেই ভারতের কাছে তারা ছিল নিতান্তই নগণ্য। সুতরাং নিজে নেতৃত্বে বিশ্বে একটি জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠী বা দ্বিতীয় শক্তি জোটে গড়ে তোলার লক্ষ্যেও ভারতের জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে।

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব

১. নবলব্ধ স্বাধীনতার রক্ষা

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন এশিয়া- আফ্রিকা নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগোষ্ঠী নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষা করে তাদের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের প্রয়াসকে অবাহত রাখতে সাহায্য করে।

২. ভারসাম্য রক্ষা

দ্বিমেরওকরণ রাজনীতির মাঝে তৃতীয় বিশ্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. শান্তি প্রতিষ্ঠা

বর্ণ বৈষম্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও অনাবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এই আন্দোলন বিশেষ শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

৪. জঙ্গি আগ্রাসন রোধ

এ আন্দোলনে বিশেষ অভিহিত মার্কিন জঙ্গি আগ্রাসনকে যে কিছু হলেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তাতে সন্দেহ নেই। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের এক এক ব্যক্তিক্রমী সাফল্য।

৫. তৃতীয় বিশ্বের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা

এ আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার আগে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যই ছিল শেষ কথা। কিন্তু এই আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন, দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ ও জাতিগুলিকে নিজেদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment