ভারতীয় সমাজের পশ্চিমী ‘স্বাস্থ্য’-এর ধারণায় প্রভাব
ভারতের ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ভারতীয়রা নিজেদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে ব্রিটিশ বা ইউরোপীয়াদের মত সচেতন ছিল না। তখন জনসাস্থ্যের ধারণা ও গড়ে ওঠেনি। এদেশে তখন ওঝা, গুনিনের ঝাড় ফুক, কবিরাজি চিকিৎসা প্রভৃতি ছিল ভারতীয়দের চিকিৎসার প্রধান ভরসা। এসব চিকিৎসা ছিল খুবই নিম্নমানের এবং এই চিকিৎসার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। গুটি বসন্তের মতো ছোঁয়াচে ও মারাত্মক রোগের ক্ষেত্রে ও হিন্দুদের ভরসা ছিল শীতলা পূজা প্রভৃতির মতো ধর্মীয় নিয়ম-কানুন ও আচার-বিচারের উপর। ফলে রোগীর মৃত্যুর হারও ছিল যথেষ্ট বেশি। অষ্টাদশ শতকে দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ দেশে পশ্চিমাচে স্বাস্থ্য এর ধারণা প্রসার ঘটতে থাকে।
১. আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি
ভারতের প্রচলিত পিছিয়ে পড়া চিকিৎসা পদ্ধতির স্থলে ব্রিটিশরা এদেশে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আসে। তারা এ দেশে অ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পদ্ধতির প্রসার ঘটায়। চিকিৎসা ব্যবস্থা বহুলাংশে পাল্টে যায় এবং রোগীর মৃত্যুর হার আগের তুলনায় বহু লাগছে হ্রাস পায়। গুটি বসন্তের মতো রোগ প্রতিরোধের জন্য ইংরেজরা টিকাকরণের ব্যবস্থা করে। আধুনিক এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে সম্পর্কে ভারতীয়রা ক্রমে সচেতন হয়ে ওঠে।
২. জনস্বাস্থ্য
ব্রিটিশ শাসকগণ এদেশে যেন স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ধারণা প্রসার ঘটায়। এদেশের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রয়োজনের দিকে নজর রেখেও ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম স্বাস্থ্য ও সংক্রামণ ব্যাধি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে। কলকাতা সহ বিভিন্ন স্থানে যৌনকর্মীদেরও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পুণ্যস্নানের কেন্দ্রীয় গুলিতেও সেই জল যাতে পুণ্যপ্রার্থী পান না করে তার উদ্যোগ নেয়া হয়। দূষিত ও জীবাণুর মূল খাঁটি বহু কুকুর ও কুয়ো বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
৩. জনগণের জমায়েতের ক্ষেত্র
বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে, পূজা পার্বণ, মেলা, কীর্তন বা যাত্রা গানের আসর, পুণ্য স্নান প্রভৃতি উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে প্রচুর মানুষ একত্রিত হয়। এসব স্থানে বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ, কলেরা, মহামারী প্রাদুর্ভাব প্রবৃত্তির যথেষ্ট আশঙ্কা থাকতো। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে এদেশে জনবহ স্থানগুলিতে এসব রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধের কোন প্রথা গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশরা বিভিন্ন উপলক্ষে জোড় হওয়া এসব জনবহুল স্থানগুলিতে জনসাস্থ্য সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা করে। তারা জনবহুল এসব স্থানে বিশুদ্ধ পানীয় জল, শৌচালয়, মেডিকেল বিভাগ, পুলিশ প্রভৃতি নিয়োগ করে রোগ সংক্রমণ, মহামারি ইত্যাদি প্রতিরোধের উদ্যোগ নিত।
উপসংহার
‘স্বাস্থ্য’ সম্পর্কে ভারতীয় পশ্চিমী ধারণায় প্রসার ঘটলেও তা কখনো অবাধ ছিল না। ১. এদেশীয় অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে উপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিক প্রসার ঘটলেও আধুনিক পশ্চিমী স্বাস্থ্য এর ধারণার এদেশে প্রসার লাভ করতে শুরু করে উনবিংশ শতক থেকে। ২. আর্থিক কারণে সরকার স্বাস্থ্য নীতি মূলত শহর অঞ্চলের সীমাবদ্ধ ছিল। দূর দূরান্তে গ্রামাঞ্চলে এই সুবিধা পৌঁছায়নি। ৩. কুসংস্কার ছন্ন ভারতীয়রা স্বাস্থ্য সম্পর্কে পশ্চিমে ধারণার প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।