ভারতীয় সমাজে ‘সময়’ ও ‘মজুরের জন্য শ্রম’ সম্পর্কে পশ্চিমে ধারণায় কিরূপ প্রভাব পড়েছিল?

সূচনা

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতের ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এদেশে কৃষি ছিল ভারতীয়দের প্রধান জীবিকা। এছাড়া কিছু ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এদেশে পশ্চিমে স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, অফিস আদালত প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। এর ফলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে দেশে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, অফিস আদালতে যাতায়াতকারী ছাত্র, শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, করণিক ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে পাশ্চাত্যের সময় ও মজুরির জন্য শ্রম এর ধারণা গড়ে ওঠে এবং এ বিষয়ে তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

ভারতীয় সমাজে পশ্চিমী ‘সময়ের’ ধারণা প্রভাব

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ পশ্চিমের সময়ের ধারণার প্রথম গ্রহণ করে। পরে তা ক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়। ভারতের পাশ্চাত্যের সময় এর ধারণায় প্রচলিত হওয়ার কয়েকটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। এই পর্যায়ে গুলি হল –

১. প্রাক-ঔপনিবেশিক ‘সময়’-এর ধারণা

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ভারতের অফিস, আদালত, স্কুল ও কলেজ গড়ে ওঠেনি। তাই প্রাশ্চাত্য ধাচে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজের সময় ও এদেশে বাধা ছিল না। কৃষক, মজুর ও শ্রমিকরা সূর্যোদয়ের পর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার সেরে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিত। কাজে থেকে ফেরার সুনির্দিষ্ট কোন সময় থাকতো না। বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে দুপুর বা বিকেল পর্যন্ত বা কোন কোন ক্ষেত্রে বিকেলের পরেও তাদের কাজ করতে হতো। দিনের বেলা অনেকটা অনুমানের দ্বারা আকাশে সূর্যের অবস্থান দেখে কৃষক ও শ্রমিকদের কাজের শুরু ও শেষ হতো।

২. উপনিবেশিক আমলে ‘সময়’-এর ধারা

হটষ্টাদশ ও নবীর শতকে ইউরোপে এর ঘড়ি ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং সেখানকার অফিস আদালতে সকাল ১০ টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করার অভ্যাস চালু হয়। এই সময় ভারতের ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত দলে ব্রিটিশদের অনুকরণে এ দেশের স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে পাশ্চাত্যের সময় এর ধারণা প্রচলিত হয় এবং সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজের সময় চালু হয়। অফিস আদালতে অনুকরণে ক্রমে ভারতে কল কারখানা গুলিতে ও পশ্চিমী সময়সূচি চালু হয়।

৩. ঘড়ির ব্যবহার

পাশ্চাত্যের ধাঁচে ভারতে অফিস আদালতে কাজের সময়সূচি চালু হলে এ দেশে ক্রমে ঘড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। আগে সূর্যের অবস্থান দেখে কাজকর্মের সময়সূচি প্রচলিত ছিল। এর পরিবর্তে এখন ঘড়ির সময় ধরে কাজকর্ম শুরু হয়। রাস্তাতে সময় কাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিনের কার্যাবলী চালাতে গিয়ে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী, সরকারি চাকুরী, স্কুল ও কলেজে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঘড়ির ব্যবহার খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ভারতীয় সমাজে পশ্চিমী ‘মজুরের জন্য শ্রম’ এর ধারণার প্রভাব

ভারতের ব্রিটিশ শাসনের প্রসারে ঘটার আগে এ দেশে দরিদ্র কৃষক ও মজুর শ্রেণীর ধ্বনি ভূস্বামী বা খামার মালিকের অধীনে কাজ করতো। প্রভুর জমি বাখামারের রমজানের বিনিময়ে সুনির্দিষ্ট মজুরি লাভের প্রথা তখনও নিয়মিতভাবে গড়ে ওঠেনি।

১. প্রাক-ব্রিটিশ মজুরি প্রথা

প্রাক-ব্রিটিশ যুগে ভারতের দরিদ্র কৃষক ও মধুর আশ্রমদানের বিনিময়ে শ্রম দাতা বিভিন্ন উপায়ে পারিশ্রমিক পেতো, যেমন-

(১) কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রম দাদারা প্রভুর জমিতে বিনা মজুরিতে শ্রমদান করত। বিনিময় শ্রম দাদারা নিজেদের চাষের জন্য প্রভুর কাছ থেকে এক খন্ড জমি পেত।

(২) ঋণ অর্ধপরিষদে ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ প্রভুর জমি বা খামারে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হত।

(৩) অনেক সময় সন্ধানের বিনিময়ে শ্রম দাতা ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রভুর কাছ থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান পেতো।

২. ব্রিটিশ ধাঁচের মজুরি প্রথা

ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজ শাসকরা এ দেশের স্কুল ও কলেজ, অফিস, আদালত গুলিতে মাসিক বেতন দান শুরু করে। ইংরেজদের শিল্প কারখানা, নীল চাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রমিক ও মজুরদের দৈনিক মজুরি দেওয়ার প্রথা চালু হয়। এর ফলে ইংরেজদের অনুকরণে ভারতের শ্রমের বিনিময়ে মজুরী দানের প্রথার প্রচলিত হয়।

৩. স্বল্পমজুরি

ব্রিটিশ কারিগর, শ্রমিক ও কর্মচারীদের যে হারে মজুরি পেতো ভারতীয় শ্রমিকরা এর চেয়েও যথেষ্ট কম মজুরি পেতো। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের সঙ্গে ভারতীয়দের যুক্ত করা হতো। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরের দাবিতে সরকার ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মজুরি আইন পাস করে।

উপসংহার

ভারতে ‘সময়’ ও ‘মজুরি জন্য শ্রম’-এর ক্ষেত্রে পশ্চিমী ধারণার প্রসার ঘটলে ও তা কখনো ও অবাধ ছিল না। ১. অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে এদেশে উপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিক প্রসার ঘটলেও আধুনিক পশ্চিমী ধারণা এ দেশের প্রসার লাভ করতে শুরু করে উনবিংশ শতক থেকে। ২.’সময়’ সম্পর্কে পশ্চিমে ধারণা প্রধান ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণী’ নামে পরিচিতি আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষার শিক্ষিত ক্ষুদ্র অংশের ভারতীয়দের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভারতের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর এই ধারণা থেকে দূরে ছিল। ৩. ‘মজুরি জন্য শ্রম’ এর ক্ষেত্রে সরকার কিছু কিছু উদ্যোগ নিলেও দেশের বিপুল সংখ্যক ও অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ প্রকৃত বক্ষে এসবের সুবিধা পায়নি।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment