সংবিধানের মূল কাঠামাে
গােলকনাথ মামলায় (১৯৬৭) সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের প্রাধান্য, সরকারের সাধারণতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক কাঠামাে, ধর্মনিরপেক্ষতা, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতিই সংবিধানের মূল কাঠামাে হিসেবে চিহ্নিত।
ভারত-সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র
মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র বলে ঘােষণা করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে ‘সমাজতান্ত্রিক ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’—এই দুটি শব্দ সংযােজনের পর ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র’ বলে ঘােষিত হয়েছে।
সার্বভৌম: সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম বলা হয়েছে৷ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক—উভয় দিক থেকে ভারত সার্বভৌম। দেশের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভারত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত রাষ্ট্র বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারত সরকার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে সক্ষম। কোনাে কোনাে সমালােচক মনে করেন যে, ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ ভারতের সার্বভৌমিকতাকে ক্ষুন্ন করেছে। এই অভিযােগ সমর্থনযােগ্য নয়। কারণ ভারত ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে না।
সমাজতান্ত্রিক: প্রস্তাবনা অনুসারে, ভারত রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক। বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক আদর্শ কার্যকর করার জন্য সংবিধানে প্রয়ােজনীয় সংস্থান রয়েছে। একথা সঠিক যে, পরিপূর্ণ সমাজতন্ত্র ভারতে প্রতিষ্ঠিত না হলেও মিশ্র অর্থনীতির আদর্শ গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শকে রূপায়ণের চেষ্টা করা হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষ: ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল ভারতে কোনাে ধর্মই রাষ্ট্রীয় ধর্ম নয়।রাষ্ট্র কোনাে ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা বিদ্বেষ ভাব পােষণ করে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে ধর্মীয় ব্যাপারে স্বাধীনতা ভােগ করেন।
গণতান্ত্রিক: সংবিধান অনুসারে ভারত রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক। এখানে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করেন। সমালােচকেরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, শােষণ ও দারিদ্র্যের অবস্থান এবং এসমা, নাসা প্রভৃতি আইনের অস্তিত্ব গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছে বলে মনে করেন। তবে, নিঃসন্দেহে বলা যায়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বিদ্যমান।
সাধারণতন্ত্র: প্রস্তাবনায় ভারত সাধারণতন্ত্র হিসেবে বর্ণিত। ভারতের শাসনব্যবস্থার শীর্ষে আছেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর পদটি বংশানুক্রমিক নয়, নির্বাচনমূলক। কোনাে কোনাে সমালােচক এই প্রসঙ্গে ভারতের কমনওয়েলথের সদস্যপদের কথা উল্লেখ করে তার ‘সাধারণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু, এই সদস্যপদ বাধ্যতামূলক নয়, স্বেচ্ছামূলক এবং ভারতের শাসন-কাঠামােয় ইংল্যান্ডের রাজা বা রানির কোনাে স্থান নেই।
তাই, ভারত নিঃসন্দেহে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র।
সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটির অন্তর্ভুক্তি
১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশােধনক্রমে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র
যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষে বহু ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। তাই ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতারা ভারতকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত না করে ধর্মনিরপেক্ষরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ভারতের সংবিধানের অন্যতম রূপকার অনন্তসায়ন আয়েঙ্গার বলেছিলেন, আমরা ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে, কোনাে ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস বা দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা বােঝায় না। ধর্মনিরপেক্ষ কথাটির অর্থ হল, রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মকে সাহায্য করবে না বা এক ধর্ম অপেক্ষা অন্য ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দেওয়াকে বােঝায়। ড. রাধাকৃষ়্ণ-এর মতে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে, অধার্মিক, ধর্মবিরােধী কিংবা ধর্ম বিষয়ে উদাসীন রাষ্ট্রকে বােঝায় না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যক্তি বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ধর্মীয় স্বাধীনতাকে স্বীকার করে, সকল ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেয়, কোনাে বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা বিরুদ্ধ মনোভাব পােষণ করে না। এককথায়, ধর্ম বিষয়ে রাষ্ট্র সার্বিকভাবে নিরপেক্ষ থাকে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সকল নাগরিকের ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। মূল সংবিধানে না হলেও ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ঘােষিত হয়েছে। সর্বোপরি, ভারতের সংবিধানের ২৫, ২৬, ২৭ ও ২৮—এই চারটি ধারায় মৌলিক অধিকার হিসেবে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দিয়েই ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।