ভারতের সম্প্রদায়িকতার বিকাশ ও প্রসার
প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের সাম্প্রদায়িক সাম্প্রতির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেশের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ সৃষ্টি করে ব্রিটিশ বিরোধী ঐক্যবোধ আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্যোগ নেন। ফলে উনবিংশ শতকে শেষ দিক থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত সময়কালে ভারতে হিন্দু, সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ যথেষ্ট। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের বিভিন্ন কারণ ছিল, যেমন-
১. সরকারের বিভেদ নীতি
সাম্রাজ্যবাদীর ব্রিটিশ সরকার ভারতের নিজেদের শাসনকে নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে হিন্দু মুসলিম সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি করে জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা চালায়। সরকার মহাবিদ্রোহের পর থেকে হিন্দু তোষণ, বঙ্গভঙ্গের পর থেকে মুসলিম তোষণ এবং পরবর্তীকালে অনগ্রসর হিন্দু শ্রেণীকে তোষণ করে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় তার সামাজিক প্রবন্ধে লেখেন যে, ইংরেজরা কৌশল করিয়া কখনো মুসলমান অপেক্ষা হিন্দুদের একটু অধিক আদর করেন এবং যখন হিন্দু আদরে ভুলিয়া যায়, তখনই আবার মুসলমানদের দিকে বিলক্ষণ ঝোঁকে দেন।
২. উন্নয়নে বৈষম্য
ভারতের ব্রিটিশ শাসন প্রসারের পর এদের সুষ্ঠুভাবে শাসন কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে সরকার ইংরেজি জানে না দেশীয় কর্মচারী তৈরীর উদ্যোগ নেয়। এজন্য এজন্য ভারতের প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশ্চাত্য ছিল শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নতি ঘটানো। ব্রিটিশ প্রশাসনে নিম্ন স্তরের বিভিন্ন পদে কাজের জন্য শিক্ষিত হিন্দু ব্রাহ্মণরা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্লাস্টার তো শিক্ষা থেকে মুসলিমরা দূরে থাকায় তারা ক্রমে পিছিয়ে পড়ে। হলে হিন্দুরা অধিকাংশ সরকারি ও সামাজিক সুযোগ সুবিধা লাভ করলেও মুসলিমরা তা থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে হিন্দু মুসলিম মধ্যে মানসিক বিভেদ বৃদ্ধি পায়।
৩. সৈয়দ আহমদের ভূমিকা
স্যার সৈয়দ আহমদ খান এর উদ্যোগে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে আলীগড় আন্দোলন প্রথম থেকে সম্প্রদায়িক মনোভাব প্রচার করতে থাকে। সৈয়দ আহমদ মুসলিমদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি, তাদের স্বার্থ ও পৃথক। এদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। তিনি মুসলিমদের কংগ্রেসের যে ব্রিটিশের প্রতি বেশি ভরসা করার উপদেশ দেন। তাই হিন্দুবিদ্বেষী নীতি ভারতের দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্ম দেয়।
৪. ধর্মীয় বিভেদ
হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে থাকলেও ধর্মীয় বিভেদ ছিল তীব্র। ধর্মীয় কারণে তারা উভয় নিজেদের সম্পূর্ণ পৃথক বলে মনে করত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, হিন্দুর কাজে মুসলমান অশুচি এবং মুসলমানের কাছে হিন্দু কাফের। এই মনোভাব উভয়কে এক হতে দেয়নি। ভারত সচিব ব লর্ড ক্রস ১৮৮৬-১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড ডাফরিনের কে বলেন যে, ভারতীয়দের ধর্মীয় বিভেদ আমাদের পক্ষে লাভজনক হবে।
৫. প্যান ইসলামবাদের আদর্শ
ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় প্যান ইসলাম অর্থাৎ ইসলামের বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শ বিশ্বাসই ছিল। তাদের অনেকেই ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পরিবর্তে আরব, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা নিয়ে বেস্ট চিন্তিত ছিল। তারা ভারতের স্বাধীনতা অপেক্ষার তুরস্কের সুলতান খালিপার মর্যাদা রক্ষার বেশি আন্তরিক ছিল। আগা খাঁ র ম তে মুসলিম নেতা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, আমরা যে জাতির ভেতরে জাতি-তা সরকারকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতে হবে। ভারতীয় মুসলিমদের এই মতাদর্শ সাম্প্রদায়িক যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করে।
৬. উপনিবেশিক অর্থনীতির কুফল
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সমান সুযোগ পাইনি। শিল্পায়নের অভাবের দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হিন্দুরা নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মুসলিম সম্প্রদায় পিছিয়ে পড়ে। এটা অর্থনৈতিক বৈষম্য হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বৃদ্ধি করে।
৭. বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ
অভিজাত মুসলিমরা বাণিজ্য বা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে জমিদার পেশায় যুক্ত হয়। এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভব ঘটে। ফলে জমিদার সম্প্রদায় ভুক্ত অভিজাত মুসলিমরা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। এই শ্রেণীগত বৈষ্ণম্য সাম্প্রদায়িক মনোভাব বৃদ্ধি করে।
৮. হিন্দু জাতীয়তাবাদ
১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে ভারতের প্রাচীন সাহিত্য সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়। দয়া নন্দন সরস্বতী আর্য সমাজ ও শুদ্ধি আন্দোলন, বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সাহিত্য, তিলকের শিবাজী ও গণপতি উৎসব, অরবিন্দ ঘোষ ও বিপিনচন্দ্র পালের আন্দোলনের ভাবধারার কালী ও দুর্গার মাত্রীমুর্তির প্রচার প্রভৃতি ঘটনা মুসলিমরা সুনজরে দেখেনি। হিন্দু মহাসভার নেতা লালা চাঁদ ঘোষণা করেন যে, আমি প্রথম হিন্দু পরে ভারতীয়। এই ধরনের উগ্র হিন্দুত্বের প্রচারে মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে হিন্দুদের ব্যবধান সৃষ্টি করে।
৯. বঙ্গভঙ্গ
বাংলা ছিল জাতীয় কংগ্রেসের এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পীটস্থান। ব্রিটিশ বিরোধী শক্তিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সরকার মুসলিম তোষণ শুরু করে। এজন্য বড়লাট লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে উসকে দিয়ে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা করে এবং এই পরিকল্পনার মুসলিমদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে যথেষ্ট অবনতি ঘটে। বেশিরভাগ মুসলিম স্বদেশী আন্দোলন থেকে দূরে থেকে বঙ্গভঙ্গ কে সমর্থন করে।
১০. মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠান
মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ভারতে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ গঠন করে। লীগের ক্রমিক সারে আতঙ্কিত হয়ে এর পাল্টা হিসেবে গড়ে ওঠে, হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিন্দু মহাসভা ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। উভয় সম্প্রদায়ের প্রধান কর্মসূচির অঙ্গ হয়ে পড়ে বিপক্ষ প্রতিষ্ঠানের দাবিদাওয়া গুলি বিরোধিতা করে। এরফলে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
উপসংহার
হিন্দু মুসলিম বিভেদের ফলে ভারতের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ আব্যাহত থাকে। তাই অধ্যাপক বিপান চন্দ্র বলেছেন যে, সাম্প্রদায়িকতা একটি আধুনিক ব্যাপার, এর শিখা রয়েছে আধুনিক ঔপনিবেশিক এর শিখা রয়েছে আধুনিক ঔপনিবেশিক আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে।