ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপি বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়
২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্রাক্ষ্মীর দুটি আঞ্চলিক রূপ গড়ে ওঠে-উত্তর ভারতীয় রূপ এবং দক্ষিণ ও বহির্ভারতীয় রূপ। দ্বিতীয় রূপটি থেকেই পল্লব লিপি উদ্ভূত হয়, যা গ্রন্থি, মালয়াল, তামিল, তেলুগু কন্নড় ও সিংহলি লিপি এবং ব্রহ্লাদেশ কম্বােজ শ্যামদেশীয় লিপির জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে, ব্রাত্মী লিপির উত্তর ভারতীয় রূপই হল কুষাণ লিপি (২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। চতুর্থ শতাব্দীতে অর্থাৎ গুপ্তযুগে কুষাণ লিপি বিবর্তিত হয়ে গুপ্ত লিপি নাম নেয়। এই গুপ্ত লিপি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ‘সিদ্ধমাতৃকা’ লিপির জন্ম হয়। এই সিদ্ধমাতৃকা লিপি থেকেই সপ্তম শতাব্দীতে কুটিল লিপি উদ্ভূত হয়।
অষ্টম শতাব্দীতে এই কুটিল লিপি ভারতীয় উপমহাদেশে পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। কুটিল লিপির ‘উত্তর-পশ্চিম ভারত’ শাখা অর্থাৎ শারদা লিপি থেকে তিব্বতি, কাশ্মীরি ও গুরুমুখি লিপি, ‘উত্তর ও মধ্যভারত’ শাখা থেকে দেবনাগরী, কায়থী ও গুজরাটি লিপি, ‘মধ্য এশিয়া’ শাখা থেকে খােটানি লিপি এবং ‘যবদ্বীপ-বালিদ্বীপ’ শাখা থেকে যবদ্বীপীয় কুটিল লিপি উদ্ভূত হয়েছে।
কুটিল লিপির পঞ্চম শাখা অর্থাৎ ‘পূর্ব-ভারত’ শাখার লিপি হল প্রত্ন বাংলা লিপি বা গৌড়ী লিপি। নবম শতাব্দীতে নারায়ণ পালের তাম্রশাসনে লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়। এই প্রত্ন বাংলা লিপি থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে নিম্নলিখিত চার প্রকার লিপি উদ্ভূত হয়েছে-
- নেপালি
- ওড়িয়া
- মৈথিলি
- বঙ্গলিপি
এইভাবে ব্রাক্ষ্মী লিপি থেকে ক্রমে ক্রমে বঙ্গলিপি বা বাংলা লিপি উদ্ভূত হয়েছে।
সিন্ধুলিপি ও কীলক লিপি
সিখুলিপি: ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু অববাহিকার হরপ্পা এবং মহেনজোদারােতে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার যে ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল, তার মধ্যে থাকা শিলমােহর ও শিলালিপি থেকে সে যুগের লিপির সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সিধুলিপি ছিল মূলত চিত্রলিপি, যে লিপিতে প্রায় ৪০০ বিভিন্ন চিহ্নের খোঁজ পাওয়া যায়। এ লিপির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। তবে, এই লিপির সঙ্গে সুমেরীয়, প্রােটো-এলমাইট, হিট্টাইট, মিশরীয়, ক্রিট-দেশীয়, চিনা এবং ব্রাক্ষ্মী লিপির কিছু কিছু সাদৃশ্য আছে।
কীলক লিপি: পারস্যদেশীয় সুমেরীয়রা মেসােপটেমিয়ায় এসে তাদের লিপিপদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে কীলক লিপি তৈরি করে। কাঁচা মাটির পাটাতনে বা পাথরের ওপর কীলক বা বাটালি দিয়ে কীলক বা পেরেকের মতাে খোঁচা খোঁচা চেহারার রেখাচিত্র এঁকে এবং রােদে পুড়িয়ে কীলক লিপি তৈরি করা হত। লাতিন ভাষায় যেহেতু ‘Cuneus’ শব্দের অর্থ কীলক এবং ‘Forma’ শব্দের অর্থ ‘আকৃতি’, তাই বিখ্যাত লিপি বিশারদ টমাস হাইড এই লিপির নাম দেন ‘কিউনিফর্ম’ (Cuneiform) অর্থাৎ কীলক লিপি। প্রথম যুগে এটি চিত্রলিপি থাকলেও পরে এটি ভাবলিপি ও ধ্বনিলিপিতে পরিণত হয়। আক্কাদীয় বা আসিরােব্যাবিলনীয় ভাষা এবং প্রাচীন পারসিক ভাষা লেখাতে এই লিপি ব্যবহৃত হত। অধুনালুপ্ত এই লিপির কোনাে উত্তরাধিকারী নেই।
ব্রাহ্মী লিপির উৎস সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মত
ব্রাহ্মী লিপির উৎস সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মত প্রচলিত, সেগুলি নিম্নরূপ-
- Edward Thomas, সুধাংশু কুমার রায়-এর মতে ব্রাত্মী এসেছে প্রাচীন সিন্ধুলিপি থেকে।
- Dowson এবং Cunningham মনে করেন ভারতীয় পুরােহিতরা চিত্রলিপি থেকে ক্রমে ক্রমে ব্রায়ী লিপি রচনা করেন।
- William Jones, Kopler, Buhler, Waber প্রভৃতিরা বলেন যে, ব্রাহ্মী লিপি ফিনিশীয় লিপি থেকে জন্মলাভ করেছে।
- আধুনিক লিপি বিশেষজ্ঞ David Diringer ও James বলেন যে, ব্রাহ্মী লিপি আরামীয় লিপি থেকে জন্মলাভ করেছে।
- Princeep-Rochette বলেন যে, আলেকজান্ডারের আক্রমণ-সূত্রে যে উন্নততর গ্রিকলিপি ভারতে আসে, তা থেকেই ব্রাম্মী লিপি উদ্ভূত।
- কেউ কেউ বলেন যে, আরবীয় লিপি থেকে ব্রাহ্মী উদ্ভূত।
- Davids বলেন, কিউনিফর্ম অর্থাৎ কীলক লিপি থেকে ব্রাম্মী উদ্ভূত।
- Cast বলেন যে, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে পশ্চিম এশিয়াসহ বিভিন্ন বিদেশি লিপির দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে ভারতীয়রা ব্রাহ্মী লিপি তৈরি করেন।
ওপরের মতামতগুলির মধ্যে ভাষাবিজ্ঞানীরা চতুর্থ মতটিকে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযােগ্য বলে মনে করেন। তবে একথাও আমরা বিস্মৃত হতে পারি না যে, আরামীয় লিপি বর্ণলিপি, অথচ ব্রাহ্মী লিপি অংশত দললিপি বা অক্ষরলিপি।