‘বৈষ্ণব কবিতা’ কবিতার কাব্যশৈলী বিচার করো।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী কাব্য’ তাঁর সৌন্দর্য পর্বের ফসল। জমিদারি তদারক করার জন্য রবীন্দ্রনাথ দশ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে পদ্মার জনজীবনের সঙ্গে মিশেছিলেন। এইসময় তাঁর মনে ভীড় করেছিল নিরুদ্দেশ সৌন্দর্য আকাঙ্ক্ষা ও সুখ দুঃখ বিরহমিলন পূর্ণজীবনে প্রবেশের ইচ্ছা। সোনার তরী কাব্যের প্রতিটি কবিতায় এর ইঙ্গিত বর্তমান। তাঁর ‘বৈষ্ণব কবিতা’ এক অপূর্ব প্রেমমনস্তত্ত্ব মূলক কবিতা। এই কবিতায় স্বর্গ ও মর্ত্যকে যেন মিলিয়ে দিয়েছেন। ড. শচীন সেন বলেছেন— ‘রবীন্দ্রনাথ স্বর্গ ও দেবতাকে মর্ত্য হইতে বিচ্ছিন্ন কবিয়া দেখেন নাই। তিনি মানবের প্রেমকে যথার্থ মূল্য দিতে চাহেন বলিয়াই ‘বৈষ্ণব কবিতা’য় জিজ্ঞাসা করিয়াছেন যে, বৈষ্ণবের পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান, অভিসার, প্রেমলীলা, বিরহমিলন, বৃন্দাবনগাথা, ইহা কি শুধু দেবতার? এই গীতি সংগীতে ভক্ত ও দেবতা বিরাজ করেন।

বৈষ্ণব কবিতা সাধারণত হয় ভক্তিভাবের কবিতা। রবীন্দ্রনাথ দেবতার ভক্তি ও মানবের ভালোবাসাকে পৃথক করে দেখেননি। তিনি বৈষ্ণব কবিতায় বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদকে দূরে সরিয়ে মানবপ্রেমের জয়গান ঘোষণা করেছেন। এরজন্য আশ্রয় নিয়েছেন ধ্বনি, বাক্য সজ্জা ও চিত্রকল্পের, যার সার্থক প্রয়োগে এই কবিতা অসাধারণ রূপ পেয়েছে। বৈষ্ণব কবিতা প্রবাহমান পয়ারে বদ্ধ এবং ছয়টি স্তবকে বিন্যস্ত। প্রথম কাব্যে বিস্ময়সূচক চিহ্নের ব্যবহার। বিস্ময় সূচক বাক্য হলেও এর মূলে আছে প্রশ্ন, কবি দ্বিধান্বিত ‘শুধু বৈকুণ্ঠের জন্য বৈবের গান! নিয়ে আরও বিস্মৃতভাবে বললে এখানেই দেবতার সঙ্গে মানবাত্মর সংযোগসূত্র গ্রথিত। প্রথম স্তবকের পরের দুটি বাক্য এই ভাবনাকেই বিস্তৃত দান করেছে। দ্বিতীয় স্তবকে বৈষ্ণবগীতি কবি ও সমাজে বীরূপ প্রভাব ফেলে বলতে গিয়ে দীর্ঘ বাক্য সংযোজন করেছেন। বাক্যে একটি সেমিকোলন (;) ও শেষ হয়েছে জিজ্ঞাসা (?) চিহ্নে। অন্তিমে প্রশ্নচিহ্ন কবিতার ভাবের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। কবি বলেন—

মোর দিকে, বহি নিজ মৌন ভালোবাসা,

ওই গানে যদি বা সে পায় নিজ ভাষা,

যদি তার মুখে ফুটে পূর্ণ প্রেমজ্যোতি— 

তোমার কি তার, বন্ধু, তাহে কার ক্ষতি?

অর্থাৎ বৈষ্ণবের গান বৈকুণ্ঠের নয়। মানবের সংসারের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সেই গানে ভীড় করে। এই গান ভালোবাসাতে শেখায়, মনে জাগায় পুলক। তাই বৈকুণ্ঠ ব্যতীত সাধারণ মানব যদি এই গান শুনে আনন্দ পায় তাতে কারও কোনো ক্ষতি হবে না এই কথাই কবি বলতে চেয়েছেন।

তৃতীয় স্তবকে তাঁর প্রশ্ন—

সত্য বারে কহো মোরে হে বৈষ্ণব কবি, 

কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,

বৃহত্তর মানব সমাজ সমস্ত কবিরই উপাদান। তাকে অস্বীকার কেউ করতে পারেন না। রাধিকার ব্যাকুলতা এই মানব সংসারের কোনো উচ্ছল মানবীর ব্যাকুলতা। এই স্তবকে বেশ কয়েকবার বিস্ময়সূচক (!) চিহ্নের ব্যবহার ঘটেছে; তিনি জিজ্ঞাসা (?) চিহ্নের ব্যবহার করতেও পারতেন। কিন্তু বিস্ময় চিহ্ন কবির বিস্ময়বোধকে তুলে ধরার জন্য ব্যবহার করেছেন। কবি শেষ বলেছেন—

তারি নারী হৃদয় সঞ্চিত

তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্ছিত

চিরদিন !

অর্থাৎ যে মানব সমাজকে কবি ব্যবহার করলেন তারাই এর থেকে বঞ্চিত হবে? অর্থাৎ ? বৈকুণ্ঠের গানকে মানবতাবোধের গান হিসাবে তুলে ধরাই তাঁর লক্ষ্য। চতুর্থ স্তবকেও মর্ত্য প্রেমেই সত্য। এখানে দেবতা ও প্রিয়ের মধ্যে একাত্মতা সাধন করে বলেছেন—

‘দেবতার প্রিয় কবি প্রিয়েরে দেবতা’।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্তবকে মর্ত্যপ্রেমই প্রাধান্য লাভ করেছে। এসেছে যুবক যবুতীর অন্তরের আকুতি, যা মিলিয়েছেন রাধাকৃষ্ণের প্রেম প্রসঙ্গে।

‘যুগে যুগান্তরে

চিরদিন পৃথিবীতে যুবক যুবতী 

নরনারী এমনই চঞ্চল মতিগতি’

রবীন্দ্রনাথ কবি শুধু নন, তিনি লিরিক কবি ; ভাষার আন্তঃগঠনিক সৌন্দর্যে এই প্রতিভার শব্দের ছাপ স্পষ্ট। শব্দের সঙ্গে যোগ ঘটিয়ে ধ্বনিগত মাধুর্যকে বিস্তৃতি দেন। ছন্দনির্মাণেও দেখি তাঁর প্রতিভার স্পর্শ।

ছন্দের পাশাপাশি অলংকার নির্মাণেও কবির স্বাভাবিক স্বকীয়তা লক্ষণীয়। অলংকারগুলি ভাববস্তুর সমৃদ্ধিও ঘটায়। ধ্বনিসাম্য ও অনুপ্রাসের পাশাপাশি অর্থালংকার সৃষ্টি করেছেন।

ছন্দ অলংকারের পাশাপাশি চিত্রকল্পও কবিতার প্রাণ। চিত্রকল্পই আমাদের কল্পনার দুয়ার খুলে দেয়। আলোচ্য কবিতার পার্থিব প্রেমকে তুলে ধরার জন্য কবি অসাধারণ চিত্রকল্পের সৃজন করেছেন।

‘- এ গীত উৎসব মাঝে

শুধু তিনি আর ভক্ত নির্জনে বিরাজে 

দাঁড়ায়ে বাহির দ্বারে মোরা নরনারী 

উৎসুক শ্রবণ পাতি শুনি যদি তারি 

দু একটি জন—দূর হতে তাই শুনে 

তরুণ বসন্তে যদি নবীন ফাল্গুনে 

অন্তর পুলকি উঠে। শুনি সেই সুর

………………

যদি তার মুখে ফুটে পূর্ণ প্রেম জ্যোতি

তোমরা কি তাঁর, বন্ধু, তাহে কার ক্ষতি ?

বৈষ্ণবীয় ভাবের বৈষ্ণব কবিতা এটি নয়। রবীন্দ্রনাথের যুক্তিশীল মনে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে চান, বৈষ্ণবীয় সাহিত্য শুধু ধর্মের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা থাকেন কি না তা সার্বজনীন রসাবেদন সৃষ্টি করতেও সমর্থ। কবিগণ সমাজ থেকেই প্রেরণা পান, তাঁর অন্তরের না বলা কথাও ধরা থাকে সাহিত্যে। বৈষ্ণব কবিগণ ধর্মের আড়ালে মানবপ্রেমকে তাই স্বীকার করেছেন অজ্ঞাতেই। রবীন্দ্রনাথ অপূর্ব ধ্বনি-শব্দ-চিত্রকল্পের সমন্বয়ে এই ভাবনাই ব্যক্ত করেছেন।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment