বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
আর্য সভ্যতার যুগে প্রবর্তিত এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দুহাজার বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব তিনশাে বছর পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের বেদনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাকে বলা হয় বৈদিক শিক্ষা। শ্রবণনির্ভর হওয়ায় বেদের অপর নাম শ্রূতি। বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ一
(১) গুরুকুল: বৈদিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বলতে গুরুকুল বা গুরুর আশ্রমকে বােঝাত। উপনয়নের পর শিক্ষার জন্য শিষ্যরা গুরুগৃহে সমবেত হত। এক-একজন গুরুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত আবাসিক-আশ্রমিক গৃহ-বিদ্যালয়। এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থাকে বলা হত গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থা।
(২) উপনয়ন ও ব্রম্মচর্যাশ্রম: বৈদিক শিক্ষায় গুরুরা উপনয়ন নামক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিষ্যকে ব্রম্মচারী হিসেবে দ্বিতীয় জন্ম দিতেন। গুরুগৃহে থাকাকালে শিষ্যকে ব্রহমচর্য পালন করতে হত। কয়েকটি শারীরিক ও আধ্যাত্মিক নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে মেনে চলতে হত এবং তার মধ্যে দিয়েই শিষ্যের শিক্ষালাভ ঘটত।
(৩) শিক্ষাকাল: উপনয়নের মাধ্যমে বৈদিক শিক্ষা শুরু হত। বারাে বছরের শিক্ষাক্রমটি শেষ হত ‘সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
(৪) সংরক্ষিত শিক্ষা: বৈদিক যুগে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের শিক্ষাধিকার ছিল। শূদ্রদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। তাই বলা যায়, বৈদিক শিক্ষা সর্বজনীন ছিল না।
(৫) শিষ্যের দায়িত্ব: গুরুগৃহে থাকাকালীন শিষ্যকে অনেকগুলি দায়িত্ব পালন করতে হত। যেমন—গুরুর সেবা করা, গুরুগৃহ পরিষ্কার করা, গাে-পালন করা, পূজার জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা, গুরুর পরিবারের জন্য ভিক্ষা করা, গুরুর নির্দেশ পালন করা ইত্যাদি।
(৬) পাঠক্রম: বৈদিক শিক্ষায় গুরুরা শিষ্যকে বেদ পাঠ করার পাশাপাশি শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ছন্দ, তর্ক প্রভৃতি বিষয়েও শিক্ষাদান করতেন পরবর্তীকালে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য সমাজে বর্ণাশ্রম চালু হওয়ায় শূদ্র ছাড়া তিনটি উচ্চবর্ণের জন্য বৃত্তি অনুযায়ী আলাদা আলাদা পাঠক্রমের ব্যবস্থা করা হয়। ব্রাহ্মণদের বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, নক্ষত্রবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ইতিহাস, পুরাণ ইত্যাদি; ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি, দণ্ডনীতি, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি এবং বৈশ্যদের পশুপালন, কৃষিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, বাণিজ্যসংক্রান্ত প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করা হত।
(৭) পদ্ধতি: শ্রবণ, মনন এবং নিবিষ্টচিত্তে ধ্যান বৈদিক শিক্ষাদানের প্রধান পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হত।
(৮) গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক: গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতাে। গুরু শিষ্যকে পুত্রের মতাে স্নেহ করতেন, শাসন করতেন। শিষ্য গুরুকে পিতার মতাে শ্রদ্ধা ও সমীহ করত।
(৯) গুরুকেন্দ্রিকতা: বৈদিক শিক্ষা ছিল গুরুকেন্দ্রিক। গুরুর কথাই ছিল শেষ কথা। কোনাে প্রতিবাদের অবকাশ ছিল না।