‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য চরিত্র হল হানিফ গাজী। নাট্যকার এ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে একটি ক্রমবিকাশ ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটকের প্রথমদিকে দারিদ্র্যের কারণে হানিফকে খুব Submissive বলে মনে হলেও নাটকের অন্তিমে তার বিপরীত চিত্র লক্ষিত হয়। আরম্ভে সে পীর এবং আল্লার প্রসঙ্গ একাধিকবার উচ্চারণ করেছে। দেবতার নামোচ্চারণের মাধ্যমে তাকে একটি নৈতিক দিক থেকে বিশুদ্ধ মানুষ রূপে গড়ে তুলবার প্রয়াস দেখা যায়। সেই বিশুদ্ধতার কারণেই সে পবিত্র শিবের মন্দিরের অশ্বত্থ গাছের ওপর থেকে বজ্রকঠিন স্বরে উচ্চারণ করতে পারে, ‘ভূত’ সেজে নৈতিক শিক্ষাদান করতে পারে।
তবে তার মধ্যে একটি অসঙ্গতিও ধরা পড়ে। প্রারম্ভিক এই নৈতিক বিশুদ্ধতা ও দারিদ্র্যজনিত অসহায়তা তার অভিনয়ে অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে। খাজনার টাকা ট্র্যাকে করে আনলেও সে তা লুকিয়ে রাখে। এতে অবশ্য আর একদিকের সঙ্গতি রক্ষিত হয়েছে : প্রারম্ভেই তার এই অভিনয় বণতাই শেষের অভিনয়ে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। এইদিক থেকে বিচার করলে তার চরিত্রের মধ্যে একটি পূর্ণতার আভাস মেলে। ভূত সেজে সাজা দেবার অব্যবহিত পরেই স্বাভাবিক বেশে ও কণ্ঠস্বরে তার প্রত্যাবর্তন এবং ভক্তপ্রসাদকে বিদ্রুপ ও ব্ল্যাক মেল করা, তার চরিত্রের মধ্যে মাত্রান্তর সৃষ্টি করেছে। হানিফ তখন একজন নিরক্ষর, কৃষক মাত্র নয় বলে মনে হয়েছে।
ন্যায়ের প্রতি কিঞ্চিৎ বিশ্বাস হানিফের মধ্যে জেগে উঠতে দেখা যায়। ভক্তপ্রসাদের লোভ লালসার প্রতি লক্ষ্য রেখে তার সরেস মন্তব্য: “আচ্ছা দেখি, এ কুম্পনির মুলুকে এনছাপ আছে কিনা।’ এই ‘এনছাপ’-এর কারণেই একদিকে সে ক্ষুদ্ধ, অপরদিকে নিজেই সে বিষয়ে সক্রিয় হয়েছে। তার পারিবারিক বিশুদ্ধতার কথা সে সগর্বে উচ্চারণ করে এই কারণেই যে, সেই নৈতিক বিশুদ্ধিই তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় সচেতন হবার শক্তি, সাহস ও অধিকার দিয়েছে।
হানিফ অত্যন্ত ক্ৰোধী পুরুষ। বুদ্ধি তার সেই পরিমাণে নেই। নাট্যকার প্রথমবার তাকে একটু কোমল প্রকৃতির মানুষরূপে প্রদর্শন করেই নাটকের পরিণতির প্রয়োজনে ক্রমে ক্রমেই তাকে ক্রুদ্ধ থেকে ক্রুদ্ধতর একটি চরিত্র করে তুলেছেন। নানাভাবে প্রবঞ্ছিত হয়ে তার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা অত্যন্ত বেশি হয়ে উঠেছিল। আবার ভক্তপ্রসাদের বিরুদ্ধে যে একটি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, হানিফ সেই পরিকল্পনার একজন রূপদানকারী।
এতদ্ সত্ত্বেও হানিফ চরিত্রে মধ্যে মধ্যে কিছুটা অসঙ্গতিও পরিলক্ষিত হয়। যে হানিফ এত অস্থির ও ক্রোধী, ভূত সেজে তিনজনকে প্রহার করবার পরই তার স্বাভাবিক বেশে প্রবেশ করে স্বাভাবিক ভাষায় সংলাপ বলা সত্যিই স্বাভাবিক ঠেকে কিনা, সন্দেহ হয়। হানিফের মতো একরোখা কৃষকের পক্ষে এক মুহূর্তের মধ্যেই এই ধরনের স্বাভাবিকতা অর্জন করে ওঠা হয়তো সম্ভবপর নয়। অর্থাৎ কোমল প্রকৃতির হানিফ ক্রুদ্ধতম হানিফ পরিণত হয়ে শেষে ব্যঙ্গবিদ্রুপ পরায়ণ আর এক তৃতীয় হানিফে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং দেনা পাওনা সব চুকিয়ে চিন্তা ভাবনার কোনো অস্পষ্টতা সংশয় পাঠক-দর্শকের মনে জিইয়ে না রেখে প্রহসনের চরিত্রানুযায়ী তার বিদায় ঘটেছে। কাজেই সামান্য অসঙ্গতি সত্ত্বেও চরিত্রটি সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে।