‘পরিচয়’ পত্রিকাটির প্রকাশকাল, বৈশিষ্ট্য
‘পরিচয়’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে (১৯৩১, জুলাই)। পত্রিকাটি ত্রৈমাসিক। সম্পাদক ছিলেন আধুনিক কালের প্রখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
‘কল্লোল’ পত্রিকার পরবর্তী পর্বে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত ‘পরিচয়’ পত্রিকারই হাত ধরে। বাংলা সাহিত্যে পত্রিকাটি দীর্ঘ আয়ুষ্কালের জন্যও স্মরণীয়। ১৯৩১ থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক নানা পালাবদলের সাক্ষী হয়। দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতার স্মৃতি নিয়ে পত্রিকাটি প্রায় কুড়ি বছর ব্যাপী প্রকাশিত হয়ে এসেছে।
মনে রাখতে হবে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শনে সুপণ্ডিত মননশীল লেখক। আবেগ অপেক্ষা মনন ও বুদ্ধিরই প্রাধান্য তাঁর প্রতিভায়। ফলে প্রায় সমধর্মী বহু কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সুধীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে সমবেত হয়ে একটি আড্ডাগােষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। পরিচয়ের এই আড্ডা থেকেই পরিচয় পত্রিকার জন্ম। এই আড্ডা বা পত্রিকার লেখকগােষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব, বিয়ু দে, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ রায়, গিরিজাপতি ভট্টাচার্য, হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় ইত্যাদি। এছাড়া ‘কল্লোল’ গােষ্ঠীর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্ররাও এখানে যুক্ত ছিলেন কিছুদিন।
‘পরিচয়’ পত্রিকার বিশেষত্ব ছিল মনন প্রাধান্য। সস্তা আবেগ বা জনমনােরঞ্জনের চর্চাকে পরিহার করে ‘পরিচয়’ সাহিত্যক্ষেত্র সচেতন বুদ্ধিবাদের সঞ্চার ঘটাতে চেয়েছিল। সেদিক থেকে ‘পরিচয়’-কে ‘সবুজপত্র’র যথার্থ উত্তরসূরী বলা যেতে পারে।
কিন্তু প্রকৃতিগত দিক থেকে ‘সবুজপত্র’র সঙ্গে ‘পরিচয়’-এর পার্থক্যও স্পষ্ট। ‘সবুজপত্র’র আন্দোলন ছিল বিশুদ্ধ সাহিত্যের আন্দোলন। কিন্তু ‘পরিচয়’-এর সাহিত্য আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে না হলেও সমকালীন প্রগতি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। ‘পরিচয়’-এর অন্যতম লেখক হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় পরিচয় পত্রিকা প্রসঙ্গে লিখেছেন- “বাংলা রচনার তারল্য বর্জন করে গভীর কথা গভীর সুরে শােনাবার আয়ােজন তাতে হচ্ছে, দ্রুত পরিবর্তমান দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞাতব্যকে দেশের মানুষের কাছে তথ্য ও চিন্তার বিশ্লেষণের প্রযত্ন ঘটছে।”
‘পরিচয়’ পত্রিকার সকলে প্রত্যক্ষভাবে মার্কসবাদের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও মুক্ত চিন্তার চর্চায় সেখানে মার্কসবাদও অস্বীকৃত হয়নি। এই পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল এঙ্গেলস-এর ‘অ্যান্টি-ডুরিং’ গ্রন্থের সমালােচনা। প্রেসঙ্গত বলতে হয়, এই পত্রিকার সমালােচনা বিভাগটি ছিল সমৃদ্ধ।
‘পরিচয়’ পত্রিকার উন্নত রুচি ও গভীর ভাবচর্চার কারণেই পত্রিকাটি ‘অভিজাত’ পত্রিকা হিসাবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন গােপাল হালদার ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রগতিশীল সমাজভাবনা, প্রগতিপথী রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে গভীরভাবাত্মক মননধর্মী সাহিত্য আন্দোলনকে যুক্ত করার মধ্যেই ‘পরিচয়’ পত্রিকার বিশেষত্ব।