“বাঙালির ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে সমন্বয়ের সুর।”– তোমাদের পঠিত শাক্ত পদাবলির পদগুলি অবলম্বনে উল্লিখিত অভিমতের যৌক্তিকতা নিরূপণ করো।

বৈষ্ণব কবিতার সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করে শাক্ত কবিতাগুলিকে শাক্ত পদাবলি বললেও আসলে এগুলি শাক্তসঙ্গীত। শাক্তসঙ্গীতে আবার সাধনার দিকটিও লক্ষ্য করা যায়। শাক্তসঙ্গীতগুলি দুটি পর্যায়ে বিভক্ত– লীলাগীত ও বিশুদ্ধ সাধন গীতি। আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতগুলি মূলত লীলাগীত। আগমনী ও বিজয়া ছাড়া অন্যান্য শাক্তগীতিগুলি সাধনসঙ্গীতরূপে কথিত আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতে মেনকা উমার বাৎসল্য প্রতিবাৎসল্য রূপটি অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’ অংশে গৃহস্থালীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এবং মাতা কন্যার মিলন ও বিরহের মাধুর্যমণ্ডিত সত্ত্বেও তন্ত্রে ও দশমহাবিদ্যায় বর্ণিত দেবীরূপের বর্ণনা এখানে উপস্থিত।

যা লৌকিক–তাই আবার পরমা শক্তির সঙ্গে যুক্ত। তাই বাংলাদেশের স্নেহের দুলালী উমার ভিতর মহামায়ার আবির্ভাব। ভাঙা কুটীরে সে ভবানী। তাই পদকর্তাগণ বলেছেন –

চঞ্চল চরণে চলে অচলনন্দিনী 

তরুণ অরুণ যেন চরণ দুখানি।

রাত্রির অঘোর ঘুমের মধ্যে কন্যাকে স্নেহের স্পর্শে জাগিয়ে তোলা আর বিশ্বমূলে মায়ের স্থাপন করা একই ব্যাপার।

“কাল উমা আমার এল সন্ধ্যাকালে,

কী জানি কীরূপে ছিল বিল্বমূলে,

বিল্বমূলে স্থিতি করিয়ে পার্বতী

জাগিয়ে যামিনী পোহাল।”

উমা সঙ্গীতগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দেবমহিমার অন্তরালে মর্ত্য জীবনের দুঃখ দারিদ্র্যকে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করা হয়েছে। শাক্ত পদাবলিতে লক্ষ্য করা যায় স্বর্গ মর্তের সমন্বয়। উমার দুঃখদারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন তার রূপের যে কালীবর্ণ হওয়া তা দিগম্বরী কালীমূর্তি ধারণতত্ত্বের সঙ্গে এক হয়ে যায়—

“কুম্বপন দেখেছি গিরি, উমা আমার শ্মশানবাসী;

আসিত বরণা উমা, মুখে অট্ট অট্ট হাসি,

এলোকেশী বিবসনা, উমা আমার শবাসনা,

ঘোরাননা ত্রিনয়না, ভালে শোভে বাল-শশী।”

শিবশক্তির তত্ত্বটিকে নিয়ে লৌকিক সংসারকে সংসারের সকল স্নেহমায়া-প্রীতির বন্ধনকে আস্বাদ করবার একটা মাধুর্য আছে। তাই মেনকা বলতে শোনা যায় –

“গিরিরাজ হে, জামায়ে এনো মেয়ের সঙ্গে।”

বৎসরাস্তে বিবাহিতা কন্যা যখন পিতৃগৃহে গমন করে তখন যেমন মায়ের আনন্দ হয় তেমনই প্রতিবেশিদেরও আনন্দ হয়। মায়ের এই যে পাগলিনী রূপ, পাড়ার মধ্যে এত কোলাহল তাকে শুধু মর্ত্যের অকিঞ্চিৎকর ঘটনা বলে ছোটো করে রাখা উচিত নয়। এত আনন্দ উৎসবের মধ্যে আমরা মহামায়াকে যখন দেখি গণেশজননীরূপে তখন সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় –

“বসিলেন মা হেমবরণী হেরম্বে লয়ে কোলে। 

হেরি গণেশ জননীরূপে, রাণী ভাসেন নয়ন জলে।”

জননীর এই শুভমূর্তি; লৌকিক কালিমাকে ধুয়েমুছে লীলাময়ী মহামায়ার রূপে প্রকাশিত।

বুদ্ধি, তপস্যা, যোগসাধনা দ্বারা যাকে পাওয়া সম্ভব নয় সেই উমা মর্ত্যে নেমে—

“ফিরি এলে গিরি কৈলাসে গিয়ে,

তত্ত্ব না পাইয়ে যারে

তোমার সেই উমা এই এলো, 

সঙ্গে শিব পরিবার।”

মহারাত্রি রূপে ত্রিভুবন আচ্ছন্ন করে রেখেছেন মহামায়া। মহারাত্রির অন্ধকারের অস্তস্থলে নিজের অপরূপ হেমদ্যুতি বিস্তার করে আছেন মহামায়া। এদিকে মা রূপী মেনকা আপন কন্যারূপে আবির্ভূতাকে মহামায়াকে দিতে নারাজ, তাই তার নবমী নিশির উদ্দেশ্যে কাতর প্রার্থনা—

যেও না, যেও না, নবমী রজনী, 

সস্তাপহারিণী লয়ে তরাদলে।

গেলে তুমি দয়াময়ি, উমা আমার যাবে চলে। 

তুমি হলে অবসান, যাবে মেনকার প্রাণ।

শক্তিতত্ত্বের এই সাধনা বহু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী। শাক্তপদাবলি শক্তিতত্ত্বের সাহিত্য রূপ, স্বভাবতই এইসব তান্ত্রিক বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের কথা শাক্তপদাবলিতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রবেশ করেছে। একদিকে জীবনের ঘনায়মান নৈরাশ্যের আভাস অন্যদিকে মাতৃচরণের আপনাকে সমর্পণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ভক্তের আকুতি পদগুলির মূল সুর। জগজ্জননীর নিস্পৃহ ব্যবহারে সত্তানের হৃদয় ক্ষুব্ধ। স্বভাবতই অনুযোগ এখনে সুতীব্র।

কে বলে তিনি ঐশ্বর্যময়ী কে বলে তুমি কৃপাময়ী

তিনি সর্বনাশী, তিনি নিষ্ঠুরা, তিনি কৃপণ।

সুকঠিন তিরস্কারে যখন জ্বালা মেটে না তখন আত্ম ধিক্কার উপস্থিত হয়। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে কবি তখন বলে ওঠেন—

“দোষ কারো নয় গো মা।

আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।”

অতএব শাক্তসঙ্গীতে শাক্তদর্শনের বিভিন্ন সুর-পরম্পরা আভাসিত হলেও এর মূল রস ভক্তি। যার মধ্যে বাঙালি ঐতিহ্য নিহিত। শাক্তপদাবলি ধর্ম-সঙ্গীত হওয়া সত্ত্বেও যথার্থ অর্থে কাব্য গুণান্বিতও হয়েছে। দেবমহিমার অন্তরালে সমাজের অনুপঙ্খ ঘাত প্রতিঘাত মান-অভিমানকে স্থাপন করে বাঙালির আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসাটিকে পাঠকসমক্ষে উপস্থিত করিয়েছেন শাক্তপদকর্তাগণ। শাক্তপদাবলি শ্যাম ও শ্যামার অভিন্নতা প্রতিপাদক পদাবলি। এখানে বৃন্দাবন ও গিরিপুর এক সমতলে অবস্থিত। আর তা সম্ভব হয়েছে রামপ্রসাদের ন্যায় কবি প্রতিভার আবির্ভাবের ফলে।

অনার্স বাংলা তৃতীয় পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment