বাউল তত্ত্ব ভাবনার উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে লেখাে
বাউল’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘বাতুল’ শব্দ থেকে। শব্দটি ধারাবাহিক সরলীকরণের ফলে অর্থাৎ শব্দ মধ্যস্থিত ব্যঞ্জনলােপের ফলে বাউল পরিণতি লাভ করেছে। কারও কারও মতে ব্যাকুল শব্দ থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি। সহজিয়া দেহতত্ত্বে বিশ্বাসী যে-মানুষ সহজ সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষরূপী ঈশ্বরকে অন্তরে অনুভব করার জন্য ব্যাকুল, সেই ব্যক্তিই হল বাউল। সংসার ধর্ম ত্যাগ করে কিংবা সন্ন্যাস গ্রহণ করে ঈশ্বর লাভে এরা বিশ্বাসী নয়। অতি সাধারণ জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মানুষের সমাজে থেকে লােভ মােহমুক্ত সংযমী মানুষটিকে কাছে পাওয়ার জন্যই এদের আকুলতা।
ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার বিভিন্ন রূপ বর্তমান। কোথাও দেবদেবীর মূর্তি পূজা করা হয়, কোথাও চলে আবার শূন্যতার সাধনা। বিষয়টিকে যথাযথ অনুভব করে ঠাকুর রামকৃয় বলেছিলেন যত মত তত পথ। সাধ্য-সাধন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। ‘ধর্ম শব্দের আক্ষরিক অর্থ ধারণ করা-অর্থাৎ, ধর্ম তাই যা মানুষ ও মানুষের সমাজকে ধারণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। ধর্মের মােহরূপের জন্য এক একটা ধর্ম সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে শুরু হয় সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা। চলতে থাকে জাতপাতের লড়াই। কিন্তু ভারতবর্ষের লােকায়ত মানুষ কখনােই এই ধরনের সংকীর্ণতায় বিশ্বাসী নয়। তারা ধর্ম জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত মানব আত্মার অনুসন্ধান করেছেন। এই অনুসন্ধানের পথ ধরেই জন্ম নিয়েছিলেন বাউল তত্ত্ব ভাবনা।
বাউল সাধক লালন ফকির কীভাবে চিত্ত পরিশুদ্ধির কথা বলেছেন?
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লােকায়ত ব্যক্তিত্ব লালন ফকির বাংলাদেশের বাউলগানের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আত্মদর্শনের মধ্য দিয়েই মানুষ চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে প্রকৃত ধর্ম সাধনা করতে পারে বলে একজন বাউল সাধক হিসেবে তাঁর বিশ্বাস ছিল।
বাউল সাধকেরা মানুষের সমাজে থেকেই মানবমুক্তির পথ খুঁজেছেন। তাঁরা জানেন এ পথ সহজ নয়। মানুষের অসংযমী মন তাকে সত্যের পথ থেকে সর্বদা বিচ্যুত করে রাখে। লােভ-মােহ, কামনা বাসনা নিয়ত চিত্তকে অস্থির করে তােলে। এই অস্থিরতাই সহজ সত্য অনুভবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে লালন মনে করেছেন।
বাউল সাধকদের মতে, কেবল মন্ত্র উচ্চারণ বা আচার আচরণের জাঁকজমকের মধ্যে চিত্তশুদ্ধির কোনাে দিশা কখনােই থাকতে পারে না। নিরাকার পরম পুরুষের সান্নিধ্য লাভের জন্য যে চিত্ত পরিশুদ্ধির প্রয়ােজন, তার জন্য কেবল দরকার আত্মানুসন্ধান বা নিজেকে যথার্থরূপে উপলদ্ধি করা ও বিষয়বাসনা বা লােভ-লালসারূপ অগাধ পানির কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করা। তা হলেই মনের ভেতরে থাকা ‘মনের মানুষ-এর সাক্ষাৎ লাভ সম্ভব হবে।
‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’ ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’ বলতে কী বােঝানাে হয়েছে?
‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’ পাঠ্যাংশটি বাউল গীতিকার লালন ফকিরের লেখা লালনগীতিকা গানের সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। পাঠ্যাংশে আরশিনগরে কবির পড়শি অর্থাৎ তার মনের মানুষের বাড়ি। কবিতায় আরশীনগর হল জলে ঘেরা একটি গ্রাম।
এখানে ‘আরশীনগর’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আরশি শব্দটির অর্থ আয়না বা দর্পণ। সেই সূত্রে আরশিনগর বলতে কবি তার আয়নায় প্রতিম্বিত প্রতিচ্ছবির কথা বলেছেন যার বাস কেবল দর্পণে। এক কথায় ‘আরশীনগর বলতে আত্মাকে বােঝানাে হয়েছে। ‘আরশি’ প্রতিটি মানুষকে তার নিজের প্রতিমূর্তির দর্শন করায়, এর মাধ্যমে সে নিজের অস্তিত্বকে চিনতে পারে এবং তার অন্তরাত্মা বা তার একাত্ম মনের গহনে অবস্থিত মানবসত্তাকে চিনতে পারে। আরশীনগর’কে আনন্দনগর বলেও চিহ্নিত করা যেতে পারে, যেখানে পৌঁছােলে মানুষের মনের জ্বালা যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটে। একজন সাধক সারাজীবন এই আরশীনগর অনুসন্ধান করে ফেরেন। পার্থিব বিষয়বাসনায় নিমজ্জিত প্রতিটি মানুষই তার নিজের অন্তরাত্মা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক জীবনযাপন করে। কিন্তু মনের মানুষের সন্ধান তার লক্ষ্য, কারণ এই মনের মানুষ আসলে তার শুদ্ধসত্তা। বাউল সাধকেরা একেই পরমাত্মা দর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। এই দর্শন না হলে জীবনে তার মােক্ষলাভ বা মুক্তি ঘটবে না।
লালনের মতে যম-যাতনা কীভাবে দূর করা যেতে পারে?
‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’ কবিতাটি লালন ফকিরের লেখা লালন-গীতিকা সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। লালন ফকির তার সাধনার মধ্য দিয়ে মানবমনের অন্তর-আত্মাকে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। তার মতে প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে মনের মানুষ বা অধর মানুষ-এর অবস্থান। আর যে এই মনের মানুষের সন্ধান পেয়েছে সেই প্রকৃত ঈশ্বরকে লাভ করতে পেরেছে। অহং, হিংসা, দ্বেষ, লােভ-লালসা, বিষয়বাসনা ও আমিত্ব-কে বর্জন করলে তবেই এই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। যা মানবজীবনকে মানবতার শীর্ষে উন্নীত করে পরম আনন্দ দান করে। তখন কোনাে পার্থিব সুখ-দুঃখই তাকে আর ছুঁতে পারে না। তার আত্মা তখন স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থানে বিরাজ করে।
ঈশ্বর নিরাকার এবং তিনিই পরম, তাই তাকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এই ঈশ্বরের বাস মানুষের মনেই আর তাই তিনি প্রতিটি মানুষের একান্ত পড়শি। তবু সাংসারিক বা সামাজিক বন্ধন এবং মােহ তার চোখে এমনই আবরণ করে রাখে যে সে তার নিজের মনের মানুষকেই চিনতে পারে না। লেখক এখানে ‘যম- যাতনা বলতে মানুষের জীবনে উপস্থিত পার্থিব সাংসারিক জ্বালাযন্ত্রণার কথা বলেছেন। এই যম-যাতনা দূর হতে পারে যদি পার্থিব জগৎকে অর্থাৎ পার্থিব সুখ-দুঃখ ও বিষয় যন্ত্রণাকে দূরে ফেলে মানুষ আত্মশুদ্ধিতে মনােনিয়ােগ করতে পারে। তখনই স্বর্গসুখ বা ঈশ্বসুখ অনুভূত হয়। পরিবেশের যে-কোনাে বাধা ও দুঃখ-কষ্টকে দূর করে অভিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থাকতে সাহায্য করে।