বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান উল্লেখ করো? রামমোহন রায়ের সীমাবদ্ধতা গুলি উল্লেখ করো?

ভূমিকা : ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি পশ্চাৎগামিতা দূর করার উদ্দেশ্যে যারা অসম্মান ও অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২-১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে। ভারতীয় সমাজের মধ্যযুগীয় অন্ধকার দূর করার উদ্দেশ্যে তিনি বহুমুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এইসব সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার অসামান্য ভূমিকা।

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে রামমোহনের ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতিতে রামমোহনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যেমন-

১. অন্যান্য গ্রন্থ

শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি গণ বাংলা গদ্য রচনা এই যে কাঠামো করে তোলেন তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন রামমোহন রায়। রামমোহন রায় বাংলা ভাষা সর্বপ্রথম কমা, সেমিকোলন প্রভৃতি যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। তিনি অলংকার বহুল সংস্কৃত রীতির পর্বে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সহজ শব্দে ব্যবহারের রীতি প্রবর্তন করেন। বাংলা সাহিত্যে তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক ও বলা হয়।

২. উল্লেখযোগ্য রচনা

হিন্দু ধর্মের সংস্কার ও একেশ্বরবাদের প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কয়েকটি বাংলা পুস্তিকা ও বিভিন্ন উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তিনি ১৮১৫-২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২৩ টি গ্রন্থ রচনা করেন। বেদান্ত গ্রন্থ ও গৌড়ীয় ব্যাকরণ ও তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। রামমোহনের লেখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল- বেদান্ত সার ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে, ভট্টাচার্যের সহিত বিচার ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে, মান্ডুক্যোপনিষৎ ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে, মান্ডুকোপনিষৎ ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে, সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে, সুব্রহ্মাণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে, ব্রাহ্মণ সেবধি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে, বজ্রসূচি ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে।

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রামমোহনের ভূমিকা

রামমোহন রায় সাংবাদিকতার এক নতুন দিগন্ত উমোচন করেন। ডক্টর বিপান চন্দ্র মতে, রামমোহন ছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকতার অগ্রদূত।

১. সংবাদপত্র প্রকাশ

রামমোহন রায় বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ও ফরাসি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষার সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। জনগণের মধ্যে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞানের প্রচারক এবং সরকারকে জনগণের দুর্দশা গ্রস্থ অবস্থার কথা জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি সংবাদপত্র গুলি প্রকাশ করেন। তাদের প্রকাশিত সংবাদপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলায় প্রকাশিত সম্বাদ কৌমুদি ১৮০০ ২১ খ্রিস্টাব্দে এবং ফরাসিতে প্রকাশিত মিরাৎ-উল-আকবর ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে।

২. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা

সংবাদপত্র স্বাধীনতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে সরকার প্রেস অর্ডইনআন্স জারি করলে রামমোহন রায় ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট ও ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার কাছে প্রতিবাদ পত্র পাঠান এবং সংবাদপত্রে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবিতে তার আন্দোলনকে অনেককে ভারতের প্রথম নিয়ম তান্ত্রিক আন্দোলন বলে অবহিত করেন।

রামমোহন রায়ের সীমাবদ্ধতা

রামমোহন রায়ের চরিত্রে বিভিন্ন প্রগতিশীল ভাবা দর্শনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও কোন কোন ঐতিহাসিক তার কিছু সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করেন, যেমন –

১. জাতি ভেদে প্রথা সম্পর্কে দুর্বলতা

রামমোহন হিন্দুদের ধর্মীয় কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, সীতা দেওয়া প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র আলোচনা করে তুললে ও জাতিভেদ প্রথা বা বহু বিবাহের বিরুদ্ধে তিনি সেভাবে সক্রিয়তা দেখেননি। তিনি যে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেন এর প্রমাণ মিলে তার উপবিত গ্রহণ, বিলেতে যাত্রার কালে সঙ্গে ব্রাহ্মণ পাচক নেওয়া, ব্রাহ্মণ সমাজে আচার্যের পথটি ব্রাহ্মণদের জন্য নির্ধারিত করা প্রভৃতি ঘটনা থেকে। মৃত্যুর পর তাকে যে খ্রিস্টান মতে সমাহিত না করা হয় সে বিষয়ে তিনি বারবার সতর্ক করেন।

২. স্ববিরোধিতা

রামমোহন হিন্দু ধর্মের সংস্কার করতে গিয়ে যুক্তির পরিবর্তে হিন্দু শাস্ত্র গুলির ওপর নির্ভর করেছেন। বেদান্তের উপর ভিত্তি করে ধর্মীয় সংস্কার করলে ও বেদান্তের ত্যাগ-বাদকে তিনি অনুসরণ করেননি। চরিত্রের স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়।

৩. দেশীয় শিক্ষার প্রতি অশ্রদ্ধা

রামন ইংরেজি ও আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষার পতি অত্যাধিক অনুরাগ দেখাতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষা, দেশীয় শিক্ষা ও মাতৃভাষার প্রসারের প্রতি যথেষ্ট অবহেলা দেখিয়েছেন। ইংরেজি পাশাপাশি তিনি দেশীয় শিক্ষা ও মাতৃভাষার প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

৪. দরিদ্রদের শোষণের উদাসীনতা

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকের দুরবস্থার প্রতি রামমোহন সহানুভূতি দেখালেও তাদের ওপরে জমিদারের শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি মোটেই সরব হননি। কৃষকদের ওপরে নীলকরদের শোষণের বিষয়ে তিনি ছিলেন নিরব।

৫. ব্রিটিশ সংস্কৃতি-প্রীতি

ইংরেজি ভাষা, রাস্তা তো শিক্ষা ও ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি রামমোহনের অত্যাধিক অনুরাগের জন্য অনেকেই তাকে জাতীয়তা বিরোধী বলে অবহিত করেছেন।

৬. অবাধ বাণিজ্যের সমর্থক

রামমোহন অবাধ বাণিজ্যের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু এর ফলে যে দেশের কুঠির শিল্প ধ্বংস হচ্ছে তার প্রতিকারের কোন উপায় তিনি খুঁজে বের করেন নি।

উপসংহার

রামমোহন রায়ের চরিত্রে প্রগতিশীলতা ও কিছু সীমাবদ্ধতায় সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তাই একদিকে যেমন কোন কোন ঐতিহাসিক তার সমালোচনা করেছেন অন্যদিকে তেমনি অনেকে তার প্রশংসা করেছেন। ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ও আধুনিকতার অগ্রদূত হিসেবে তার সকল অবদানকে অস্বীকার করেছেন। ঐতিহাসিক ডেভিড কফ তাকে আধুনিক ভারতের জনক বলতে রাজি নন। তারমধ্যে উনিশ শতকে নবজাগরণের কোন ব্যক্তি বিশেষ অবদান নয়। অনধিকে কিশোরী চাঁদ মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাহাত্মা গান্ধী প্রমুখ তার প্রশংসায় পঞ্চম। প্যাসিভ্যাল স্পিয়ার তাকে আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠা বলে অবহিত করেছেন। ডক্টর বিপানচন্দ্র বলেছেন উনিশ শতকে প্রথমার্ধে ভারত গগনে রামমোহন রায় উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রূপে ভাস্বর ছিলেন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment