বাংলা কথাসাহিত্যে ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায়ের অবদান
ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায় উদ্ভট কল্পনাকে আশ্রয় করে বাংলা সাহিত্যে এক অদ্ভুত রসের আমদানি করেন, যা তাঁর আগে তাে ছিলই না, পরবর্তীকালেও যার যথাযথ অনুসরণ ঘটেনি।
ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায় সর্বসাকুল্যে পাঁচটি উপন্যাস রচনা করেছেন। সেগুলি হল ‘কঙ্কাবতী’ (১২৯৯ বঃ), ‘সেকালের কথা’ (১৩০১ বঃ), ‘ফোকলা দিগম্বর’ (১৩০৭ বঃ), ‘ময়না কোথায়’ (১৩১১) ‘ও পাপের পরিণাম’ (১৩১৫)। তাঁর গল্প-সংকলন চারটি—‘ভূত ও মানুষ’ (১৮৯৭), ‘মুক্তামালা’ (১৯০১), ‘মজার গল্প’ (১৯০৪) ও ‘ডমরু চরিত’ (১৯২৩)।
বাস্তব-অবাস্তব, সম্ভব-অসম্ভব সব একাকার করে দেওয়া ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন দিকের সূচনা হয়। ‘ফোকলা দিগম্বর’, ‘ময়না কোথায়’ এবং ‘পাপের পরিণাম’ উপন্যাস তিনটির মধ্যে ‘ফোকলা দিগম্বর’ এ পরিবেশিত হয়েছে একটি সরস কাহিনি। ‘ময়না কোথায়’ এবং ‘পাপের পরিণাম’ উপন্যাস দুটিতে লেখকের বক্তব্য প্রাধান্য পাওয়ায় এদের রসহানি ঘটেছে। ‘ভূত ও মানুষ’ এবং ‘মুক্তামালা’য় সংকলিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের গল্প।
ডমরুধর নামক এক চরিত্রের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাতটি সরস গল্প সংকলিত হয়েছে লেখকের ‘ডমরু চরিত’ (১৯২৩) গ্রন্থে। ত্রৈলােক্যনাথের আশ্চর্য সৃষ্টি ‘ডমরু চরিত’ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ‘মজার গল্প’ গ্রন্থের ‘পূজার ভূত’ রচনায় ভীতিপ্রদ অনুভূতির সঙ্গে কারুণ্য মিলেমিশে গিয়ে গল্পটিকে একেবারে মানবিক করে তুলেছে।
বাংলা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথ বাংলা উপন্যাস রচনায় একটা নতুন প্রবাহ এনেছিলেন। বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথের এই পর্যায়ের দুটি উপন্যাস হল ‘বউ ঠাকুরানির হাট’ (১৮৮৩) ও ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭)। ত্রিপুরা রাজবংশের এক বিশেষ সমস্যা নিয়ে রাজর্ষি আর বাংলাদেশের ধুপঘাটের রাজা প্রতাপাদিত্যের কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে ‘বউ ঠাকুরানির হাট’ উপন্যাসটি।
সামাজিক উপন্যাস: ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘যােগাযােগ’ (১৯২৯) হল রবীন্দ্রনাথের তিনটি সামাজিক উপন্যাস। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলােচনা করেছেন। ‘যােগাযােগ’ উপন্যাসে দুটি মানুষ তথা পরিবারের বিপরীত রুচি, শিক্ষা দীক্ষা, ক্ষমতা ও অহংকারের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বদেশচেতনামূলক উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনা মূলক উপন্যাসগুলি হল- ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬), ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)। মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস ‘গােরা’য় গােরার ভারতজিজ্ঞাসা আসলে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশসম্ধান। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শ খুঁজে পাওয়া যায়।
রােমান্টিক উপন্যাস: ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬), শেষের কবিতা (১৯২৯), ‘দুই বােন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ’ (১৯৩৪) হল রবীন্দ্রনাথের লেখা কয়েকটি রােমান্টিক উপন্যাস। চতুরঙ্গ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ অনেক রূপক বা সংকেতের ব্যবহার করেছেন।
বাংলা ছােটোগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা ছােটোগল্পের প্রকৃত শিল্পরূপটি গড়ে ওঠে। রচনার ক্রম অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্বটিকে বলা যেতে পারে ‘হিতবাদী-সাধনা’ পত্রিকার যুগ ; দ্বিতীয় পর্বটি হল ‘ভারতী-সবুজপত্র’ পত্রিকার যুগ এবং তৃতীয় পর্বটি হল ‘তিনসঙ্গী’র যুগ। কিন্তু বিষয়বস্তু অনুসারে রবীন্দ্রনাথের ছােটোগল্পগুলিকে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়-
প্রেমমূলক গল্প: ‘একরাত্রি’, ‘মাল্যদান’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘মহামায়া’, ‘সমাপ্তি’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘নষ্টনীড়’ প্রভৃতি হল রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য প্রেমমূলক গল্প। এই ধরনের গল্পের ভাষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিরিকধর্মী।
সমাজ-সমস্যামূলক গল্প: তাঁর সমাজ-সমস্যামূলক গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ‘পােস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘মাস্টারমশায়’, ‘দান-প্রতিদান’ প্রভৃতি। এ ছাড়া, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর’, ‘নামঞ্জুর গল্প’, ‘বিচারক’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘দেনাপাওনা’ প্রভৃতি গল্পে পণপ্রথা, নারীর প্রতি অবহেলা প্রভৃতি নানান সামাজিক ব্যাধি ও কুসংস্কার সমালােচিত হয়েছে।
নিসর্গ ও মানব সম্পর্কিত গল্প: ‘অতিথি’, ‘বলাই’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘আপদ’ প্রভৃতি গল্পে তিনি দেখিয়েছেন মানবমনের ওপরে প্রকৃতির গূঢ় ও গভীর প্রভাব।
অতিপ্রাকৃত গল্প: সারা জীবন ধরে রবীন্দ্রনাথ নানা অতিপ্রাকৃত গল্প রচনা করেছেন, যেগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ‘ক্ষুধিত পাযাণ’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘গুপ্তধন’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘কঙ্কাল’ প্রভৃতি।
অন্যান্য ধরনের গল্প: এই ধরনের রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ‘রবিবার’, ‘শেষকথা’, ‘ল্যাবরেটরি’ প্রভৃতি গল্প। সংক্ষিপ্ত পরিসরে ‘লিপিকা’র গল্পগুলিতেও লেখকের শিল্পদক্ষতার অনুপম প্রকাশ ঘটেছে।
ছােটোগল্পের সংজ্ঞা দিয়ে বাংলা ছােটোগল্পের ধারায় রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য
ছােটোগল্প: আয়তনের সংক্ষিপ্ততা ছােটোগল্পের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হলেও তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল জীবনের খণ্ডাংশ তুলে ধরে তার মাধ্যমে সমগ্র জীবনের পরিচয় দান করা। অতিকথন, বহু চরিত্রের সমাবেশ ছােটোগল্পে বর্জনীয় এবং এর ভাষা ও পরিসমাপ্তি হয় ব্যঞ্জনাময়। ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহতের, খণ্ডের মধ্যে সমগ্রের ইঙ্গিত থাকে ছােটোগল্পে।
রবীন্দ্রনাথের ছােটোগল্পের বৈশিষ্ট্য: যথার্থ অর্থে বাংলা ছােটোগল্পের জনক হলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ধরে যে ১৬৪টি ছােটোগল্প লিখেছেন (গল্পগুচ্ছ-এর ৯০), রচনার ক্রম অনুযায়ী সেগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-
- হিতবাদী-সাধনা পর্ব: এই পর্বের উল্লেখযােগ্য গল্পগুলি হল- ‘দেনাপাওনা’, ‘পােস্টমাস্টার’, ‘অতিথি’, ‘ছুটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘নষ্টনীড়’, ‘একরাত্রি’ ইত্যাদি। এই পর্বের গল্পগুলিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের জীবনের পরিচয় ও সামাজিক ও ব্যক্তিগত নানা সমস্যা ফুটে উঠেছে।
- ভারতী-সবুজপত্র পর্ব: এই পর্বের উল্লেখযােগ্য গল্পগুলি হল ‘দুরাশা’, ‘বলাই’, ‘শেষের রাত্রি’, ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’ এবং ‘পয়লা নম্বর’।
- অন্তিম পর্ব: ‘লিপিকা’, ‘সে’, ‘গল্পসল্প এবং ‘তিনসঙ্গী’—এই চারটি বিচিত্র গল্পগ্রন্থের বৈচিত্র্যময় গল্পগুলি এই পর্বের অন্তর্গত।
শুধু সংখ্যাতত্ত্বের দিক দিয়েই নয়, বিষয়-বৈচিত্র্য এবং রচনারীতির দিক থেকেও রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছােটোগল্প-সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার।