মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্মকে বা পৌরাণিক দেবদেবীকে কেন্দ্র করে তথাকার কবিরা তাঁদের জীবনকথাই ব্যক্ত করেছেন। মধ্যযুগের অন্য সব সাহিত্যের মতো শাক্তপদেও মানবিক আবেদন দেবতার অন্তরালে কীর্তিত হয়েছে। সেখানে দেবতারা তাদের দেবত্ব বিসর্জন দিয়ে মর্ত্য মানবের আত্মার নিগূঢ় মনস্তাত্ত্বিকতাতে পর্যবসিত হয়েছে। বাঙালি মনের “দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা” এই সমন্বয়ধর্মী মানসিকতা শাক্তপদে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাঙালি ঘরের মাতা-পিতা-কন্যা জামাতার অবয়বে মানবিক অনুভূতি ফুটে উঠেছে। আগমনী বিজয়া পদের মধ্যে মেনকা হিমালয় শিব-উমাকে নিয়ে আলোচনা করলে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হয়ে উঠবে।
শাক্ত পদাবলিতে মাতা মেনকার মধ্যে যে স্নেহময়ী, করুণাময়ী, মমতাময়ী রূপটি প্রকাশিত তা সত্যিই বাঙালি মাতার মানবিক অনুভূতির অনির্বচনীয় রূপমূর্তিটি প্রকাশ পেয়েছে। বাঙালি মাতৃহৃদয়ে সন্তানের প্রতি যে আকুল উদ্বেগ, কল্যাণচিন্তায় মগ্ন, মেনকার আচার আচরণে সেই মাতৃহৃদয়ের অভিব্যক্তি লক্ষ্যণীয়। অপ্রাপ্তবয়স্কা, সংসার অনভিজ্ঞা বিবাহিতা নাবালিকা উমা পতিগৃহে আছে বহুদিন মা কোনো খবর পান না। মাতৃহৃদয় আর স্থির থাকতে পারে না।-
“আছে কন্যাসন্তান যার, দেখতে হয়, আনতে হয়।
সদাই দয়ামায়া ভাবতে হয় যে অন্তরে।”
দিনের চিন্তা রাতে স্বপ্নাকারে মা মেনকা স্মৃতিপটে এসে হাজির হয়। স্বপ্নে দেখতে পায় মেয়ে উমার হেমাঙ্গি বরণ কালীবর্ণ হয়ে গেছে। পতিগৃহে শ্মশানবাসিনী হয়ে বড়োই দুঃখে-কষ্টে আছে। স্বামী গিরিরাজকে তাই বারবার কাকুতি মিনতি করেছে মেয়েকে পিত্রালয়ে আনার জন্য। কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না। অবশেষে মাতৃহৃদয়ের অসীম বেদনা উত্থিত হয় – ‘মা হতে বুঝিতে চিতে, ছলিতে না দিলেনে।’
‘আগমনী-বিজয়া’ পদে গিরিরাজের যে চিত্র আমরা পাই সেখানেও আছে মানবিক আবেদন। নারীর মতো তিনি আবেগ প্রবণতাকে স্থান দেন নি। তিনি সংযত থেকে স্থির থেকে কন্যার প্রতি স্নেহপরায়ণ পিতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিবেশীর সমালোচনায় মেনকা যখন ধৈর্যহারা তিনি তখন পর্বতের ন্যায় প্রশাস্ত ও কঠিন। গিরিরাজ কৈলাসে গমন করে জামাতার সঙ্গে সাক্ষাত না করেই একেবারে শয়নমন্দিরে গিয়ে উপস্থিত। উমাকে বলে—
“চল মা, চল মা গৌরি, গিরিপুরী শূন্যাগার,
মা হলে জানিতে উহা, মমতা পিতা-মাতার
তব মুখামৃত বিনে, আছে রাণী ধরাসনে,
অবিলম্বে চল অম্বে, বিলম্ব সহে না আর।”
এখানে যে আকুলতা প্রকাশিত তা মানবিক আবেদনকে ফুটিয়ে তুলেছে। কন্যার মুখ দেখে মাতার সুখ বর্ধিত হল। মনের অন্ধকার বিদূরিত হল।
গিরিরাজ উমাকে নিয়ে গিরিপুরীতে আগমন করলেন। কন্যাকে দেখামাত্র মেনকা ছুটে গেলেন। উমার মুখমণ্ডল দেখে মেনকার নয়নযুগল তৃপ্ত। আগমনী বিজয়ার প্রতিটি পদই মাতা-কন্যার মিলন-বিচ্ছেদের মানবীয় রসে সিক্ত।
“গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাবো না।
বলে বলবে, লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।”
মাতৃহৃদয়ের সুপ্ত বাসনাটি এখানে অপরূপ কাব্যের ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বিজয়ার পর্বে উমাকে যেতে না দেওয়ার জন্য মেনকার উক্তি—
বুঝবি তুই মায়ের জ্বালা গণেশকে তোর আটকে রেখে।
তারপর নবমী নিশিকে অস্ত যেতে না দেওয়ার অনুরোধ।—
“যেয়ো না রজনী আজি লয়ে তারাদলে
গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।
উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে।”
এমন সুন্দর মানবিক আবেদন আর কোথায় পাওয়া যাবে?
উমা-শিব বাঙালি কন্যা জামাতারূপে মানবিক সম্পর্কে চিত্রিত। উমা পিতৃগৃহে গমনের আগে পতি হরের কাছে অনুমতি চাইতে গেলে চিন্তিত হর বলেন –
“জনক জানে যাবে, ভাবনা কি তার?
আমি তব সঙ্গে যাব কেন ভাব আর।”
মেনকা গিরিকে কন্যার আনার প্রসঙ্গে বেশ লৌকিকতা প্রকাশ করেছেন। কীভাবে জামাতার অনুমতি নিয়ে জামাতা কন্যাকে এবং নাতি নাতনীদের আনতে হবে। অন্যদিকে উমা-শিবকে বলে–
“গঙ্গাধর হে শিবশঙ্কর, করো অনুমতি হর,
যাইতে জনক ভবনে।”
শিব উমার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে বলেছেন–
“হৃদয়েশি, অহরহ আমার হৃদয়ে রহ
নিদয় হৃদয় কহ, কি দোষ আমার।
যখন অনুমতি করো তুমি ভগবতি
কখনো কি করি আমি অন্যথা তাহার।”
এর মধ্যে স্পষ্টত প্রকাশিত শিবের মানবিক অনুভূতি। দেবতা হয়েও মানবিক আবেদনে ভরপুর। উমাকে ছেড়ে শিব কখনই একমুহূর্ত থাকতে পারেন না। উমা যে তাঁর হৃদয়েশ্বরী, প্রাণের অধিক। ভগবতী যখন যা অনুমতি করে শিব কখনও তা অনথ্য করেন না।
অতএব একথা পরিশেষে বলা যায় বাঙালির জীবনের বেদনামুখর মমত্ব এবং আবেগের কলতান আগমনী বিজয়ার সঙ্গীতে বেজে উঠেছে। দেবী চারদিনের জন্য বঙ্গ প্রাঙ্গনে পদার্পণ করে বাঙালির হৃদয়খানিতে চিরকালীন মানবিক অনুভূতির ক্ষেত্রটি কর্ষণ করেছেন। শাক্ত কবিগণ আগমনী বিজয়া পদগুলিতে মানবিক অনুভূতির মানসিকতাকে মুখ্য বিষয় হিসাবে উপস্থাপনা করে সার্থকতায় পর্যবসিত হয়েছেন।