কবিতাটি ২৬ কার্তিক ১৩০০ বঙ্গাব্দে পদ্মাতীরে বসে লেখা। পদ্মার দুপারের জীবন প্রকৃতি কবির মধ্যে ধরণীর প্রতি ভালোবাসাকে নতুন করে জাগিয়েছে। ‘সোনার তরীতে ঠাঁই না পাওয়া কবি ‘বসুন্ধরাতে’ প্রকৃতি ‘মা’ বলে সম্বোধন করে তার মধ্যে মিশে যেতে চেয়েছেন।–“আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে,/ কোলের সন্তান তব কোলের ভিতরে”/। কবিতার বক্তব্যকে প্রতিধ্বনির রূপকে সংগীতের ব্যঞ্জন৷য় প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য যেমন একটি পুলের মধ্যে রূপ পায় তেমনি কবিও জগৎ ব্যাপী অবিশ্রান্ত অনন্ত সৌন্দর্যকে শব্দ ছন্দ অলংকার সংগীতের মধ্যে আকার দিয়েছেন।
সমিল প্রবহমান পয়ারে লেখা এই দীর্ঘ পরিসরের কবিতাটি ২৮৭ ছত্রে এবং আটটি স্তবকে বিন্যস্ত। কাবতার প্রথম স্তবক থেকেই তরল লিরিকের প্রবাহ শুরু হয়েছে যা একই সঙ্গে বিষাদময়ও। এই বিষাদ ব্যপ্ত হয়ে মধ্যবর্তী পর্যায়ে—“আমার আনন্দ লয়ে হবে নাকি শ্যামতর অরণ্য তোমার” ? কবিতার শেষে এই হতাশা আর তীব্র হয়েছে—“আমারে লইয়া যাও রাখিয়ো না দূরে। তবে দীর্ঘস্তবকে বিস্তৃত গীতিরস কখনো কখনো মাত্রা ছাড়িয়েছে। আবার ‘হিল্লোলিয়া’, ‘মর্মরিয়া’ ‘কম্পিয়া’, ‘স্বলিয়া’, ‘বিচ্ছুরিয়া’ প্রভৃতি শব্দের বাহুল্য কবিতাকে ভারাক্রান্ত করেছে। কবিতার শুরুতে যে তীব্র আমিত্বের আগমন ঘোষিত হয়েছে পরবর্তী স্তবকের ছন্দমিলের পেলবতায়তা অনেক স্তিমিত। সমগ্র কবিতায় সমাসোক্তি অলংকারের প্রয়োগ অর্থপূর্ণ সঙ্গতিরক্ষা করেছে।
কবিতার দ্বিতীয় স্তবক থেকেই ধরণীর প্রতি ভালোবাসা আর সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা গীতিময় চিত্রের মাধ্যমে দ্বন্দ্ব রচনা করেছে। গীতিরসে তিনি স্বর্গকে ধরতে চেয়েছেন আর স্থূলরেখায় অঙ্কিত পদ্মার দুপাশের চিত্রকল্পগুলিতাকে ধরণীতে নামিয়ে এনেছে। প্রথম স্তবকের ঊর্ধ্বগামী লিরিক লক্ষ্য করা যাক—“শৈলশৃঙ্গে বিছাইয়া দিই আপনায়/নিষ্কলঙ্ক নীহারের উত্তুঙ্গ নির্জনে/নিঃশব্দ নিভৃতে।” তৃতীয় স্তবকে কবি এই একাকিত্বের বেড়া ভেঙেছেন—“একখানি গ্রাম, তীরে শুকাইছে জাল/জ্বলে বাসিতেছে তরী, উড়িতেছে পাল/ জেলে ধরিতেছে মাছ।” এর পরেও কবির মনের দ্বন্দ্ব প্রসারিত হয়েছে পরবর্তী স্তবকে। প্রথম স্তবকে চিত্রগীতের মেলবন্ধনের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন—“কোনোদিন আনমনে বসিয়া একাকী/পদ্মাতীরে, সম্মুখে মেলিয়া মুগ্ধআঁখি/…অনুভব করি/ তোমার মৃত্তিকামাঝে কেমনে শিহরি/উঠিতেছে তৃণাঙ্কুর।”
সমগ্র কবিতায় আদিপ্রকৃতি ‘মা’-র সঙ্গে মিশে যাবার বাসনা জলের মতো ঘুরে ফিরে এসেছে। আর কবিতার অলংকার বহুল বাণী বিন্যাস একে সৌন্দর্যময় করেছে। অলংকারগুলো এই কবিতার প্রাণ, তা কবিতার শরীরে অচ্ছেদ্য বন্ধনে মিশে রয়েছে কয়েকটি নমুনা—
- অনুপ্রাস—অনন্ত কল্লোলগীতে, উল্লসিত রঙ্গে ভাষা প্রসারিয়া দিই তরঙ্গে তরঙ্গে।
- উপমা—খণ্ডমেঘগণ মাতৃস্তনপানরত শিশুর মন পড়ে আছে শিখর আঁকড়ি।
- রূপক—বিদারিয়া এ বক্ত পঞ্জর, টুটিয়া পাষাণ বন্ধ সংকীর্ণ প্রাচীর, আপনার নিরানন্দ অন্ধ কারাগার
- উৎপ্রেক্ষা–“হিমরেখা নীলগিরি শ্রেণি-পরে দূরে যায় দেখা দৃষ্টি রোধ করি, যেন নিষ্ফল নিষেধ উঠিয়াছে সারি সারি সর্গ ভেদ করি।”
কবি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতাটি রচনা করেছেন। সমিল প্রবাহমান পয়ারে অর্থকে চরণের বাঁধ ভেঙে প্রসারিত করেছেন। এই ছন্দে যে তার প্রাধান্য রয়েছে তা গানের সুরের চেয়ে মৃদু হলেও ভাষার স্বাভাবিক শব্দধ্বনির চেয়ে চড়া সুরের বলে কবিতাটির মধ্যে একটা সুরেলা আবেশ রয়েছে।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর