‘বসুন্ধরা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের যে মর্মপ্রীতির চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা কবিতাটি বিশ্লেষণের দ্বারা বুঝিয়ে দাও।

‘বসুন্ধরা’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মর্মপ্রীতির, বিশ্ব বিক্ষণের এক অতুলনীয় কবিতা । কবি নিজেই বিশ্বের সঙ্গে এক হয়ে থাকার কথা বার বার বলেছেন। তাঁর নানা সৃষ্টিতে বিশ্ব বিক্ষণের দিকটি ভাষা পেয়েছে। সুন্দরী বসুন্ধরার রূপ বৈভবে তিনি আনন্দ চিত্ত। ‘ছিন্নপত্রে’ বসুন্ধরার সঙ্গে বিশ্বভুবনের সঙ্গে তাঁর একাত্ম হয়ে থাকার কথা বার বার ব্যক্ত হয়েছে। কারণ, বসুন্ধরা ঐশ্বর্যময়ী। অতুলনীয় তার বৈভব, কবি বসুন্ধরার বৈভবের মধ্যে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে চেয়েছেন। বিশ্বভুবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবনের অন্তহীন প্রাণরসের পিপাসা মিটানোর জন্য তিনি ব্যাকুল, নবনব রসাস্বাদের জন্য কবিচিত্তের দুনির্বার আকাঙ্ক্ষা বারে বারে ব্যক্ত। কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে কবির মর্ত্য প্রেম-প্রীতির দিক। নিঃস্বীম শূন্যতার মাঝে নয়, বসুন্ধরার বিপুল অঞ্চলে পরিব্যপ্ত থাকার অভিপ্রায়ে তাইতো তিনি কবিতার শুরুতেই বলেছেন—

আমারে ফিরায়ে লহো, অয়ি বসুন্ধরে 

কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে

বিপুল অঞ্চল তলে।

সুন্দরী বসুন্ধরার দিকে তাকিয়ে আনন্দে গেয়ে উঠেছে কবি হৃদয়। বহুবর্ষের পরিচিত বসুন্ধরাকে কবি আলিঙ্গনবদ্ধ করতে চেয়েছেন। মর্ত্যপ্রীতির স্নিগ্ধ আলোকে কবি চিত্তের প্রেম ভাবনার উচ্ছ্বাস ফেনিলতার দিকটি এমনভাবে ধরা পড়েছে—

“হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমার পানে চেয়ে 

প্রকাণ্ড উল্লাস ভরে, ইচ্ছা করিয়াছে

সকলে আঁকড়ে ধরি এ বক্ষের মাঝে

সমুদ্র মেঘলা পরা তব কটি দেশ।”

রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যপ্রীতির সাক্ষ্য মেলে ‘বসুন্ধুরা’ কবিতায়। এখানে ‘কবির বিশ্বপ্রীতির নিদর্শন স্পষ্টোজ্জ্বল। রবীন্দ্র কবিতার বিশিষ্টতা বিশ্বপ্রকৃতি বিক্ষণের মধ্যে দেখা যায়। সমালোচক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন—“রবীন্দ্রনাথের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বিশ্বপ্রকৃতির সহিত একাত্মতার অনুভূতি। অর্থাৎ কবি তাঁর আবেগময় অনুভূতিকে কাব্যের ঐশ্বর্য দান করেছেন। এই অনুভূতির রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধের মূল প্রেরণা। বিশ্বের সমস্ত ঐশ্বর্য আর আনন্দকে যে তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে ধরতে পারেন, তার কারণ বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতা ও একদেহ তত্ত্বের অনুভূতি প্রবল। এমনকি বসুন্ধরার বিশ্ববীক্ষণ প্রসারিত মর্ত্যপ্রীতি সম্পর্কে ‘রবিরশ্মি’ গ্রন্থে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ‘বিশ্বপ্রকৃতির সহিত অবিচ্ছিন্ন যোগ এক চিরপুরাতন একাত্মতা কবিকে একান্তভাবে বারংবার আকর্ষণ করিয়াছে।” সামগ্রিক সমীক্ষায় বসুন্ধরা কবিতার কবি মর্ত্যপ্রেম ভাবনার দিকটি মর্মে মর্মে উপলব্ধ হয়। যুগে যুগান্তরে নানারূপে ধরিত্রীর বুকে অবতীর্ণ হয়ে ধরিত্রী জননীর অমৃত স্তন দুগ্ধের পিপাসা মেটেনি কবি। তাইতো অপার বিস্ময়ে কবি তাকিয়ে থাকেন রহস্যময়ী ধরিত্রীর দিকে। কবিতার অন্তিমে কবির মর্ত্যপ্রীতির, ধরিত্রী জননীর প্রতি ভালোবাসার গভীরতায় ব্যক্ত হয়—‘এখনো মেটেনি আশা’ বাক্যের মধ্য দিয়ে।

প্রাণ প্রাচুর্য্যের ঐশ্বর্য আছে বসুন্ধরার মধ্যে। প্রাণৈশ্বর্যকে ধরে আছে বলেই সে বসুন্ধরা। কবি এ বসুন্ধরার প্রাণৈশ্বর্যকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছেন। নিজেকে পরিপূর্ণ সত্তায় মিলিয়ে দেওয়ার দুর্বার আগ্রহ এই কবিতায় আছে, বসুন্ধরাকে মাতৃরূপে সম্বোধন করে একটি বৃহৎ সত্তার সঙ্গে তাকে কল্পনা করা হয়েছে, বিশাল বিস্তৃত বসুন্ধরা, অসীম অনন্ত তার ব্যপ্তি। কবি যেন তারই কোলের সন্তান। সন্তানরূপে কবি বসুন্ধরা জননীর কোলে স্থান লাভ করতে চেয়েছেন। নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের গণ্ডি ছেড়ে অন্ধ কারাগার থেকে বেরিয়ে বসন্তের আনন্দের মতো তিনি সর্বত্র ব্যপ্ত হতে চেয়েছেন। শিবানন্দ পাষাণ কারাগারে নয়—পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে সর্বত্র তিনি পরিব্যপ্ত হতে চেয়েছেন। পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করার মানসিকতা জেগেছে কবির চিত্তে, শৈবাল দাম, ঘাস, বৃক্ষ প্রভৃতির মধ্যে এমনকি শস্যখেত, পুষ্পসম্ভারে, মহাসিন্ধুর তরঙ্গে, শৈলশৃঙ্গের উত্তুঙ্গু নির্জনতায় তিনি বিপুল আনন্দে নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছেন। এ ইচ্ছা তার চিত্তের গোপন ইচ্ছা, বহুদিন ধরে তিনিও হৃদয় বেদনা নিয়ে অপেক্ষমান নিজেকে বসুন্ধরার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তাঁর যেন অনন্তকালের প্রবণতা। প্রকৃতিকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন বলেই এটা সম্ভবপর হয়েছিল।

বসুন্ধরাতে কত না প্রাণীর বসবাস। হিংস্র ব্যঘ্র থেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণীকেও বসুন্ধরা তার বিশাল প্রেক্ষাপটে স্থান দিয়েছে, বিশাল বিস্তৃত হৃদয় না থাকলে এ কাজ সম্ভবপর নয়। কবি বিমুগ্ধ নেত্রে প্রকৃতিকে দেখেছেন, চিত্ত তার সব প্রাণী হয়ে মিশে গেছে জ্বলে স্থলে, পুষ্পে পল্লবে, আকাশে বাতাসে, স্রোতে নীল নীলিমায়। তাদের অব্যক্ত আহ্বান ধ্বনি কবি শুনেছেন। তাইতো কবি বিমুগ্ধ চিত্তে বলেছেন—

“ইচ্ছা করিয়াছে

সবলে আঁকড়ি ধরি এ বৃক্ষের মাঝে 

সমুদ্র মেঘলা পরা ৩০ কোটি দেশ।”

প্রকৃতির বিশাল বিস্তৃত পরিসরে উপলব্ধি করেছেন কবি নদীর। নির্জন বালুকারাশির মধ্যে তিনি দেখেছেন প্রকৃতির নিঃসীম বিরহ যন্ত্রণার পূর্ণ দিকটি, কেঁপে উঠেছে কবির অস্তর। নিজেকে তাঁর মনে হয়েছে একাস্তরূপে নির্বাসিত এক প্রবাসীরূপে। তাই তাঁর চিত্তে তখন প্রকৃতি প্রীতি তথা সত্য প্রীতি ব্যাকুলতা গেছে বেড়ে।

কবি চিত্তের রোমান্টিক সৌন্দর্য এ কবিতায় অভিব্যক্ত, পক্ষর সৌন্দর্য কবির মন ভরিয়ে দিয়েছিল। সেই বস্তুনিষ্ট অভিজ্ঞতা এখানে সুতীব্র ব্যাকুলতার ভাষা পেয়েছে, ছিন্নপত্রে তিনি মর্ত্যের সঙ্গে নিজের মিলে মিশে থাকার কথা ব্যক্ত করেছেন। ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে বিশ্ব প্রকৃতির বৃহৎ সত্তার অচ্ছেদ্য বন্ধন এখানে রক্ষিত, সুখ দুঃখ বিরহ মিলন পূর্ণ সাংসারিক জীবনেও তিনি প্রকৃতির দ্বারা উপলব্ধি করেছেন, কবি চিত্তের প্রগাঢ় প্রকৃতি প্রীতি শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় মর্ত্য প্রীতিতে, প্রকৃতির হাত ধরে এসেছেন তিনি মর্ত্যে আর মাতা বসুন্ধরার কাছে রেখেছেন তাঁর অন্তিম প্রার্থনা। সেখানে কবির লেখনী থেকে বেরিয়ে এসেছে শিশু সুলভ আচরণ—

“এখন তোমার বুকে আছি শিশুপ্ৰায় 

মুখ পানে চেয়ে।”

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ যেন অবিচ্ছেদ্য নাড়ির সংযোগ, বসুন্ধরা তার কাছে জননী সদৃশ। নিজেকে তিনি করেছেন সন্তান প্রতীম, প্রকৃতির নয়ন মনোহর, রূপ সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখেছেন তিনি। সে সৌন্দর্য দর্শনে বিস্ময় বিমুগ্ধ কবিচিত্ত। কবিতাটিকে তাই কবি মননের নিসর্গ প্রেম ভাবনার অত্যুৎকৃষ্ট দান রূপে স্মরণ করা যায়৷

সর্বোপরি, সমালোচকের মন্তব্য উদ্ধৃত করে এমনভাবে উপসংহার টানা যেতে পারে—“বসুন্ধরা কবিতায় বসুন্ধরার প্রতি কবি যে দুর্মর আসক্তি, তা অনেকখানি রোমান্টিকের কল্পনা বিলাস, মোহনা থেকে উৎসে ফেরার টান, যা অনেকখানি স্বপ্নিল কামনার মতো একটা চির অপ্রাপ্য অনন্ত নৈরাশ্যের কাব্যিক হাহাকার-রোমান্টিকতার পরিণাম বিশেষ।” কবির মর্ত্য প্রীতি এখানে প্রাণবস্তু বিশ্বপ্রীতিতে উন্নীত। মিষ্টিক মনোভাবের মধ্যে মিলন মধুর প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে রোমান্টিকতার চূড়ান্ত দিক ফুটিয়ে তুলে কবি এই কবিতার কাব্য সৌন্দর্যের চরম সাফল্যের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছেন।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment