শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটির আবিষ্কার পর্ব, নামকরণ ও বিষয়বস্তু
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কার:
১৩১৬ বঙ্গাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বৎবল্লভ কোন এক গ্রামের এক গােশালা থেকে কৃষফলীলা- বিষয়ক একখানি পুঁথি উদ্ধার করেন, যার আদি ও অন্ত্য ছিল খণ্ডিত, মাঝেও কিছু পাতা কীটদষ্ট বা খণ্ডিত ছিল। তিনি সম্পাদনপূর্বক ১৩২৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন। গ্রন্থের ভনিতায় অনন্ত-বড়ু চণ্ডীদাসের উল্লেখ রয়েছে, অতএব তিনিই যে গ্রন্থকর্তা এ বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই। কিন্তু ‘গ্রন্থনাম’ এবং রচনাকাল-বিষয় গ্রন্থে কোন উল্লেখ না থাকায় এ বিষয়ে পণডিতমহলে নানা সংশয়ের উদয় হয়েছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চণ্ডীদাসের পরিচয় নিয়ে বিরাট সমস্যা। চণ্ডীদাস-সমস্যার কারণ—পরিচিত চণ্ডীদাসের পদাবলীতে প্রায় সদা-প্রচলিত ‘দীন’ বা ‘দ্বিজ’ বলে যে পরিচয়-জ্ঞাপক শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়, তার কোনটিই এই গ্রন্থে ব্যবহৃত হয় নি। এইবার এক এক করে সমস্যাগুলি বিচার করা যাক।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের গ্রন্থনাম:
প্রথমেই গ্রন্থনাম। সম্পাদক বসন্তবাবু স্বীকার করেছেন যে গ্রন্থনামটি তাঁরই প্রস্তাবিত। স্বপক্ষে যুক্তি এই যে, তিনি ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছেন যে চণ্ডীদাস কৃষ্ণকীর্তন নামে একখানি কাব্য রচনা করেছিলেন। সম্পাদক অনুমান করেন যে, আলােচ্য গ্রন্থখানিই চণ্ডীদাসের সেই কৃষ্ণকীর্তন। কিন্তু এই জনশ্রুতি-বিষয়ে অপর কেউ জ্ঞাত নন। দ্বিতীয়তঃ, গ্রন্থমধ্যে একখানি চিরকুটে শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ নামটি পাওয়া যায়। কোন এক ব্যক্তি ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভের’ কয়েকটি পত্র ধার নিয়েছিলেন বলে চিরকূটে উল্লেখ থাকায় অনেকেই অনুমান করেন যে এই গ্রন্থটির নামই ছিল শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ। আবার অনেকেই গ্রন্থটিকে ‘কীর্তন’ বলে স্বীকার করেন না, কারাে মতে এটি ‘সন্দর্ভ জাতীয় রচনা; অতএব গ্রন্থের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন না হয়ে শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ হওয়াই সঙ্গত ছিল। যাহােক এ সমস্ত আপত্তি উপেক্ষিত হয়ে সম্পাদক প্রদত্ত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামই গ্রন্থটি শিরােধার্য করে নিয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচনাকাল:
এবার গ্রন্থের রচনাকাল। গ্রন্থে রচনাকাল নিয়ে কোন পুষ্পিকা না থাকায় বহিঃপ্রমাণের উপর নির্ভর করে গ্রন্থটির রচনাকাল নির্ণয় করতে হবে। গ্রন্থকর্তা চণ্ডীদাসের পরিচয় নিয়েই বিস্তর গােলযােগ। এই নামে কয়জন কবি ছিলেন, এ-বিষয়ে এখনও নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভবপর নয়। একটিমাত্র সূত্র-চৈতন্য জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন যে চৈতন্যদেব চণ্ডীদাসের পদের রস আস্বাদন করতেন। অতএব চৈতন্য-পূর্ববর্তীকালে যে অন্ততঃ চণ্ডীদাস নামে একজন কবি বর্তমান ছিলেন, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এখন প্রশ্ন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-রচয়িতা চণ্ডীদাসই কি এই চৈতন্য-পূর্ব চণ্ডীদাস? এর সমর্থনেও অপর একটি সূত্র পাওয়া যায়। সনাতন গােস্বামীর ‘বৈষ্ণবতােষিণী’ গ্রন্থের টীকার ‘চণ্ডীদাসাদি-দর্শিত-দানখণ্ড নৌকাখণ্ডাদি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আলােচ্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ গ্রন্থে ‘দানখণ্ড’ এবং নৌকাখণ্ড ইত্যাদি খণ্ডনামের উল্লেখ আমরা পাচ্ছি। অতএব প্রকারান্তরে স্বীকার করতেই হয় যে, এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রসঙ্গই ‘বৈষ্ণবতােষিণী’তে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব গ্রন্থটি যে চৈতন্য-পূর্ব কালে রচিত, এটি তার দ্বিতীয় প্রমাণ। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ যে ঐশ্বর্যভাব এবং গ্রাম্যতা প্রকাশিত হয়েছে, তা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুমােদিত নয় বলেই এটি যে চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের পূর্বেই লৌকিক কাহিনীরূপে রচিত হয়েছিল, এই পরােক্ষ প্রমাণটি স্বীকার করে নিতে। হয়। এরপর আসা যাক পুথির কথায়। পুথিটি তুলট কাগজে লেখা। এতে তিনজনের হাতের লেখা রয়েছে। লিপিবিশেষজ্ঞ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমান করেছিলেন যে পুথিটি চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধে এবং ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই রচিত হয়েছিল। নলিনীকান্ত ভট্টশালী মনে করেন যে ১৪৫০-১৫০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে গ্রন্থটি লিখিত হয়েছিল। ডঃ সুকুমার সেন মনে। করেন যে পুথিটি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি কালে লিখিত হয়েছিল, তবে গ্রন্থটির সঙ্কলন-কাল তার মতে যােড়শ শতকের মধ্যভাগ; কিন্তু গ্রন্থটির রচনাকাল এটি নয়। অতএব পুথিটির লিপিকাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কিন্তু পুথিটি যে গ্রন্থকর্তারই হাতের লেখা, এমন কথা বলা যায় না। গ্রন্থের লিপিকাল থেকে আমরা লিপিকারের জীবকাল জানতে পারি, গ্রন্থকারের নয়। তবে পুথির লিপির প্রাচীনত্ব সকলেই স্বীকার করেন। অতএব পূর্ববর্তী প্রমাণগুলির সহায়তায় অনায়াসেই সিদ্ধান্ত করা চলে যে মূল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি চৈতন্য-পূর্ববর্তী কালে চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতকের কোন সময় রচিত হয়ে থাকবে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গ্রন্থের বিষয়বস্তু:
বড়ু চণ্ডীদাস-রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাঙলা সাহিত্যে প্রথম কাহিনীকাব্য। দ্বিজ চণ্ডীদাস-রচিত বিভিন্ন পদাবলীতে গােষ্ঠ, মান, মাথুর-আদি বিভিন্ন বিষয়াত্মক বহু বিচ্ছিন্ন পদ রয়েছে; কিন্তু আলােচ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-কাব্যে ধারাবাহিকভাবে একটি কাহিনী রচিত হয়েছে। জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড , নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবন খণ্ড, কালিয়দমন খণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড এবং রাধাবিরহ—এই তেরােটি খণ্ডে বিন্যস্ত কাহিনীটি স্বরূপেও পদাবলী সাহিত্য থেকে পৃথক্।
কংসের অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করবার জন্য নারায়ণ কৃষ্ণ-বলরাম রূপে মর্ত্যভূমিতে অবতীর্ণ হলেন—পিতা বসুদেব, কৃষ্ণের মাতা দেবকী, বলরামের মাতা রােহিণী। দেবী লক্ষ্মীও রাধারূপে সাগরের ঘরে মাতা পদুমার গর্ভ্ভ জন্মগ্রহণ করেন। আইহনের সঙ্গে রাধা বিবাহিতা নন। গােয়ালা ঘরের বৌ রাধাকেনাবেচার জন্য তাকে বাইরে বেরুতেই হয়, তাই তার চারিত্রিক বিশুদ্ধিতা রক্ষার জন্য পদুমার পিসি বড়াই বুড়িকে তার রক্ষক নিযুক্ত করা হলাে। একদিন রাধার সন্ধানে বেরিয়ে বড়াই বুড়ি শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ লাভ করে। বুড়ির মুখে রাধার রূপগুণের বর্ণনা শুনে শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে তার মিলন ঘটিয়ে দেবার জন্য বড়াইকেই দূতী নিযুক্ত করলেন। অতএব রক্ষকই হলাে ভক্ষক। বড়াই বুড়ির সহায়তাতে মাঝে মাঝেই রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটতে লাগলাে। রাধার সাক্ষাৎলাভের জন্য শ্রীকৃষ্ণ কখনাে সাজেন ‘দানী’, কখনাে নৌকার পারানী’, আবার কখনাে বা ভারী সেজে রাধার দধিদুধের পশরা মথুরার হাটে নিয়ে যান। রাধাকে রৌদ্রতাপ থেকে রক্ষা করবার জন্য কৃষ্ণ কখন কখন তার মাথায় ছাতাও ধরেন। পুষ্পকুঞ্জ রচনা করে কৃষ্ণ কখন কখন শ্রীমতী রাধার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করেন; তিনিই আবার কালীয়দমন’ ও বস্ত্রহরণাদি লীলায় মত্ত হন। রাধা কৃষ্ণের ছল-চাতুরীতে ধরা পড়েই কখন কখন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তার কোন আসক্তি জন্মে নি, কিংবা তার কাণ্ডকারখানায় রাধার সায়ও নেই। বরং রাধা কৃষ্ণের পাঠানাে পান ছুঁড়ে ফেলেছেন, অন্যায় প্রস্তাব নিয়ে আসার জন্য বড়াইকে প্রহার করেছেন, কৃষ্ণকে কটুকাটব্য করেছেন, এমন কি কৃষ্ণের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে তিনি কৃষ্ণ জননী যশােদার কাছে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অভিযােগও করেছেন। পরের দিকে ধীরে ধীরে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্ৰীমতীর আকর্ষণের সৃষ্টি হয়। বাণখণ্ডে রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি শ্ৰীমতীকে উতলা করে তুলেছে; কিন্তু কৃষ্ণকে না পেয়ে রাধা তার বাঁশী চুরি করে লুকিয়ে রাখলেন। পরিণামে অবশ্য তাদের মিলন ঘটলাে। এরপর থেকেই রাধা কৃষ্ণসমর্পিতপ্রাণ—কিন্তু এ অবস্থাতেই নিদ্রিতা রাধাকে ফেলে রেখে কৃষ্ণ পালিয়ে গেলেন। ‘রাধাবিরহ’ খণ্ডে রাধা পদাবলীর রাধার মতই বিরহাতুরাকৃষ্ণ বিনে জগৎ সংসার তার নিকট মিথ্যা বলে মনে হয়। কৃষ্ণবিরহসন্তপ্তা রাধা কৃষ্ণের নিকট বড়াইকে পাঠালে কৃষ্ণ জানিয়ে দিলেন, তিনি আর ফিরবেন না, কংসকে ধ্বংস করবার জন্য তিনি মথুরা যাচ্ছেন। গ্রন্থখানি এখানেই খণ্ডিত।
বাঙলা ভাষায় বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ই কৃষ্ণকাহিনী-বিষয়ক প্রথম কাব্য। অবশ্য বড়ু চণ্ডীদাসের পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় কবিরাজ গােস্বামী জয়দেব তার অমৃত মধুর ‘গীতগােবিন্দ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী অবলম্বন করেই প্রথম এজাতীয় কাব্য রচনা করেন। এছাড়া মৈথিল কবি বিদ্যাপতি এবং সম্ভবতঃ দ্বিজ চণ্ডীদাস-রচিত বৈষ্ণব পদে রাধা কৃষ্ণপ্রমের বিভিন্ন দিক বিচ্ছিন্নভাবে রচিত হয়েছে। কুলীন গ্রামবাসী মালাধর বসু শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের দশম একাদশ স্কন্ধ-অনুসরণে কৃষ্ণ-কাহিনী অবলম্বন করে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনা করেন। কিন্তু এঁরা সবাই বড়ু চণ্ডীদাসের পূর্ববর্তী, সমকালীন অথবা পরবর্তী ছিলেন, এ বিষয়ে কিছুই জানা না গেলেও প্রায় নিশ্চিতভাবেই অনুমান করা চলে এঁরা সকলেই চৈতন্য-পূর্ববর্তী ছিলেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনাকালে বড়ু চণ্ডীদাসের আদর্শ ছিল জয়দেব গােস্বামী রচিত গীতগােবিন্দ। চণ্ডীদাস সচেতনভাবেই গীতগােবিন্দের আঙ্গিক অনুসরণ করে তার গ্রন্থ রচনা করেছেন। উভয় ক্ষেত্রেই শ্রীকৃষ্ণ, রাধিকা এবং অপর একজন (গীতগােবিন্দে এক সখী শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বড়াই বুড়ি)এই তিনজনের কথােপকথনচ্ছলে কাহিনীটি পরিবেশিত হয়েছে। দু’টিই নাট্যগীতি- দুটিতেই রাগরাগিণী এবং তালের উল্লেখ রয়েছে। সাগর নন্দীর নাটকলক্ষণ। রত্নকোষে ‘বীথী’ জাতীয় নাটক সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘ত্রিভিঃ পাত্রেঃ প্রয়ােক্ত ব্যা’। অর্থাৎ বীর্থী নাটক তিনজন পাত্র (বা পাত্রী) দ্বারা প্রযুক্ত হয়। সেদিক থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কে নাটগীতি বা বীরথী-নাটক বলা চলে। রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা গীতগােবিন্দের বিষয়, তবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বিষয়ের অনেকটা ব্যাপ্তি ঘটেছে। চণ্ডীদাস জয়দেবের গ্রন্থ থেকে অনেকে শব্দই শুধু গ্রহণ করেন নি, গীতগােবিন্দের বহু পদই তিনি আক্ষরিক অনুবাদ করে স্বীয় গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে উভয়ের মধ্যে বড় পার্থক্য এই—জয়দেব ছিলেন রাজসভার কবি এবং কাব্যটি তদুপযােগী করেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন। পক্ষান্তরে চণ্ডীদাস ছিলেন গ্রাম্য কবি, তাই তাঁর কাব্যে রাজসভার অলঙ্কৃতি নেই; যা আছে, তা গ্রাম্যতা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অশ্লীলতাও বটে। কৃষ্ণ-কাহিনীর আবরণে সমকালীন গ্রাম্য-জীবনই এর বর্ণনীয় বিষয়। দেশে তখন একটা অরাজক অবস্থা চলছিল, তারই পটভূমিকায় অসহায়ের উপর প্রবলের নির্যাতন কাহিনীই এতে পরিবেশিত হয়েছে। কোন কোন সমালােচক ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে বাঙলা সাহিত্যে প্রথম ট্র্যাজেডির মর্যাদা দিতে চান।
রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী-ভিত্তিক এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যকে অনেকেই পৌরাণিক এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়-অনুমােদিত সাহিত্যরূপে বিবেচনা করেন এবং কবি চণ্ডীদাস এর বিকৃতি সাধন করেছেন বলে কবির উপর দোষারােপ করে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে অভিযােগটি সত্য বলে মনে হলেও এই আপাতদৃষ্টিটি সত্য দৃষ্টি নয়। কারণ, এই কাহিনী মাত্র অংশতঃই পৌরাণিক। এতে কৃষ্ণের জন্ম, কালীয়দমন, বস্ত্রহরণ এবং রাসলীলাই শুধু পুরাণ-সম্মত। কাহিনীর অবশিষ্ট অংশ, যাকে কাহিনীর অংশ বলা চলে, যথা—তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, হারখণ্ড, যমুনাথণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড এবং রাধাবিরহখণ্ডে বর্ণিত বিষয়-সমূহ জনমনােরঞ্জনার্থে স্বয়ং কবি দ্বারা কল্পিত অথবা অপর কোন লৌকিক সূত্র থেকে সমাহৃত। রাধাকৃষ্ণের মিলনে বড়াই বুড়ির ভূমিকাও কবিকল্পিত। অতএব কবির বিরুদ্ধে আরােপিত অভিযােগের কোন ভিত্তি নেই। শুধু কাহিনীর দিক থেকেও কবি যে পুরাণমুখী ছিলেন না, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূ-ভার হরণের জন্য কৃষ্ণের আবির্ভাবের কথা বলা হলেও কবি যে কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না, কৃষ্ণচরিত্র বিশ্লেষণে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবির কৃষ্ণভক্তি থাকলে তিনি কখনই তাঁকে এমন ইন্দ্রিযপরায়ণ, পরদারলােলুপ, ক্রোধী, মিথ্যাচারী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ-রূপে চিত্রিত করতেন না। তাই যে সমস্ত সমালােচক মনে করেন যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যকে ‘আদিরসাত্মক পুরাণকেন্দ্রিক আখ্যানকাব্য হিসাবে গ্রহণ করাই অধিকতর সমীচীন’-তাদের এই মতবাদকে গ্রহণ করা চলে না।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে লৌকিক প্রেমকাহিনীর আধারে পরিবেষিত সমসাময়িক যুগের জীবনের একটি বস্তুনিষ্ঠ চিত্রায়ণ বলে গ্রহণ করলেই সম্ভবতঃ বড়ু চণ্ডীদাসের প্রতি যথার্থ সুবিচার করা হবে। কবির সত্যসন্ধানী দৃষ্টির আলাে সমাজের বহিরাবরণ ভেদ করে অনাবৃত বীভৎস রূপটিকেই এখানে স্পষ্ট করে তুলেছে। এই রূপ দেখে আমরা নাসিকা কুঞ্চন করতে পারি, এমন কি আতঙ্কগ্রভ হাতে পারি, কিন্তু সমকালীনতার প্রেক্ষাপটে কবির এই অতি বাস্তবতাবােধকে অস্বীকার করতে পারিনে। রূঢ় বাস্তবের ভিত্তিভূমিতে কি আধ্যাত্মিক মহিমার প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর?
অধ্যাপক তারাপদ ভট্টাচার্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র স্বরূপ উদঘাটন করে যথার্থই মন্তব্য করেছে। আসলে বড়ু চণ্ডীদাস সৌন্দর্যরসিক গীতিকবি নহেন, সত্যনিষ্ঠ ঔপন্যাসিক। চরিত্র-চিত্ৰণই তাহার মুখ্য কাজ। তিনি সাহিত্যধর্মে আধুনিক যুগের ঔপন্যাসিকদের পূর্বপুরুষ। তাহার দৃষ্টি বাস্তবপস্থী ও মিস্টিসিজমের বিরােধী। তিনি নারীচরিত্রের রহস্যবেত্তা ও লম্পট চরিত্রাঙ্কনে সুনিপুণ। তিনি দরদীও বটেন, অসহায় ধর্ষিতা নারীর মর্মভেদী হাহাকার প্রকাশ ও তদ্দ্বারা পাঠকচিত্তে করুণা উৎপাদন তাহার হৃদয়বত্তার পরিচায়ক। এই হৃদয়বত্তার জন্যই গ্রন্থমধ্যে তিনি জনতার দাবি কতকটা অগ্রাহ্য করিয়া কামায়ন-বিরােধী রাধাবিরহ না লিখিয়া পারেন নাই। হৃদয়বন্তার জন্যই তিনি তৎকালিক নারীধর্ষণের চিত্রকে সকলের সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। রাধার জন্ম প্রসঙ্গে এই গ্রন্থে চণ্ডীদাস জানিয়েছেন- ‘কাহ্নায়ির সম্ভোগ কারণে।/লক্ষ্মীক বুলিলা দেবগণে’। অর্থাৎ মর্তাধামে কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ নারায়ণের সম্ভোগের প্রয়ােজনেই দেবগণ লক্ষ্মীদেবীকে রাধারূপে মর্ত্যে জন্ম নেবার আহ্বান জানিয়েছেন। এই জন্মসূত্রেই নিহিত নারীধর্ষণের অঙ্কুর। শ্রী ভট্টাচার্য তাই লিখেছেন- “জনতার কবি হইয়া জনতার মনােরঞ্জন করিয়া তাহাকে চলিতে হইয়াছিল এবং বারংবার কাহিনীকে লালসার সুরায় সিক্ত করিতে হইয়াছিল—ইহা তাহার অদৃষ্টের বিড়ম্বনা। এ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন বলিয়াই তিনি পৌরাণিকতার তুলসীপত্রে কামায়নের কদর্যতাকে কথঞ্চিত ঢাকা দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।”
কাহিনীর বিষয়বস্তু ছাড়াও অন্য বিভিন্ন দিক থেকেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কৃতিত্ব বিশেষভাবেই স্বীকার করে নিতে হয়। তিনটি মাত্র চরিত্রের সাহায্যে গ্রন্থকার মাঝে মাঝেই উৎকৃষ্ট নাটকীয়তা- সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষতঃ রাধা-চরিত্র সৃষ্টিতে কবির দক্ষতা ও চাতুর্য অনস্বীকার্য। সংসারানভিজ্ঞা, অশিক্ষিত গ্রাম্য বালিকা কীভাবে স্তরে স্তরে বিবর্তিত হয়ে প্রৌঢ়পারাবতী শ্রীরাধায় পরিণত হয়েছেন, তা যথার্থই উপভােগের বিষয়। ডঃ সুকুমার সেন বলেন, “চণ্ডীদাস এই নাম অথবা বড়ু চণ্ডীদাস এই উপাধির অন্তরালে আত্মগােপন করিয়া যিনি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে প্রকাশিত এই নাট্যগীতি কাব্যটি রচনা করিয়াছিলেন তিনি মহাকবি এবং অলঙ্কার শাস্ত্রোক্ত মহাকাব্য লক্ষণের কিছুই ইহাতে না থাকিলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মহাকাব্য।”
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যেই বস্তুতঃ পরবর্তী কালের বাঙলা কাব্যসাহিত্যের আদল গড়ে উঠেছিল। এই কাব্যে যে পয়ার ও ত্রিপদীর ভিত্তিতে পদ্যচ্ছন্দের ও পংক্তিবিন্যাস গড়ে ওঠে, আধুনিক যুগ পর্যন্তই এই আদর্শটি অক্ষুন্নভাবে চলে আসছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অপর বিশিষ্ট মূল্য এর ভাষা। বস্তুতঃ আদিমধ্যযুগের বাঙলা ভাষার অক্ষত নিদর্শন শুধু এই গ্রন্থেই লভ্য—তাই ভাষাবিজ্ঞানীর নিকট এর মূল্য অপরিসীম।
সমকালীন ধর্মীয় জীবন এবং ধর্ম-বিবর্তনের ইতিহাস-বিষয়েও এই গ্রন্থ থেকে বেশ কিছু ইঙ্গিত লাভ করা যায়। তখনাে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটেনি, সমাজ-জীবনে যে অবসাদ দেখা দিয়েছিল, তখনাে তার রেশ চলছে। এর অব্যবহিত পূর্ববর্তীকালে চর্যাপদে যে ধর্মর্জীবনে অনাচারের, ব্যভিচারের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, এখানেও তা বর্তমান। আধ্যাত্মিকতা-বর্জিত রাধাকৃষ্ণের এই লৌকিক প্রেম ভক্তহৃদয়কে কখনাে উদ্বেল করে তুলতে পারে না বলেই চৈতন্যদেব-প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে রাধাকৃষ্ণের প্রেমই আদর্শরূপে গৃহীত হলেও বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কখনাে তাদের নিকট স্বীকৃতি লাভ করেনি এবং সম্ভবতঃ এই কারণেই গ্রন্থটি দীর্ঘদিন লােকলােচনের অগােচরে থেকে নির্বাসন জীবনযাপন করতে বাধ্য হ’য়েছিল। তবে, সমগ্র কাব্যটিতে স্থলরুচি ও কামরসের আতিশয্য থাকলেও গ্রন্থের শেষখণ্ড ‘রাধাবিরহ-তে রাধাপ্রেম যেন যন্ত্রণার বিষামৃত পান করে স্থূলতার পঙ্ক থেকে পবিত্র প্রেমের শতদলরূপে বিকশিত হয়েছে। রাধাপ্রেমের গভীরতা ও আর্তি যথার্থই ধ্বনিত হয়েছে শেষ খণ্ডটিতে। তাই বলা যেতে পারে বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ গ্রন্থ যেখানে সমাপ্ত করেছেন, সেখান থেকেই যথার্থ সূচনা ঘটেছে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের। বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনালগ্নের আখ্যানকাব্য হিসাবে তাই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ গ্রন্থের এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।
Or / Answer 2
বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ হল প্রাকচৈতন্যযুগের কৃষ্মলীলা বিষয়ক কাব্য। কাব্যটি আবিষ্কারের পর সমালোচক মহলে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। কাব্যটিকে নিয়ে নানান সমস্যার সৃষ্টি হয় যেমন—বিষয়বস্তুকে নিয়ে তেমনি চন্ডীদাসকে নিয়ে। প্রায় সত্তর বছর ধরে এই বিতর্ক চলে আসছে। নতুন কোনও তথ্য আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এ আলোচনা চলতেই থাকবে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচনাকালঃ
পুঁথিটি যে আকারে পাওয়া গেছে তাতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. নলিনীকান্ত ভট্টাশালী, ড. সুকুমার সেন ও যোগেশ চন্দ্র বিদ্যানিধি মহাশয় জানিয়েছেন ১৫০০ শতাব্দীতে পুঁথিটি লেখা হয়েছিল। পুঁথিটিতে দুতিন রকমের হাতের লেখার সংমিশ্রণ রয়েছে। কিন্তু প্রধান হস্তাক্ষর বিচার করে বলা যেতে পারে যে কাব্য পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে, চৈতন্য আবির্ভাবের পূর্বে রচিত হয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচনাবৈশিষ্ট্য :
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালি সাহিত্য রসিকরা চন্ডীদাসকে এক ও অদ্বিতীয় বলে মনে করতে। চৈতন্যদেবও ভাবাবেশে দিবারাত্র চণ্ডীদাসের পদ পাঠ করতেন এবং আনন্দ উপভোগ করতেন। কাব্যখানির গঠনরীতি, মণ্ডনকলা প্রভৃতির বিচার করে দেখা যায় চন্ডীদাসের রচনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে যা পাঠকদেরকে আকৃষ্ট করে।
(১) বাস্তবধর্মী: কাব্যখানি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রণয়োপাখ্যান। রাধা কৃষ্ণ দৈবলোকের বাসিন্দা হলেও তাঁদের যে প্রেম কাহিনি তা কবি বাঙালির সমাজ জীবন থেকেই আহরণ করেছেন। কৃষ্ম এখানে ভগবান নয়, গোয়ালা বালক, যাকে সবাই গ্রাম্য ভঙ্গিতে কানাই বলে ডাকে। রাধা বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী নয়, গোপরমণী। মানব রস সৃষ্টিই কবির প্রতিভার পরিচয়।
(২) গ্রাম্যতা লক্ষণ: কাব্যের অধিকাংশ অংশ গ্রাম্য প্রাণোচ্ছলতায় পূর্ণ। রাধার দেহ কামনায় কৃষ্ণের যে আকাঙ্ক্ষা ও কার্যকলাপ প্রকাশ পেয়েছে তাতে গ্রাম্য পরিবেশের ইঙ্গিত বহন করে। নৌকা বানিয়ে মাঝি সাজা, ভারীর বেশ ধারণ, তাম্বুল প্রেরণ, রাখাল বালকের সঙ্গে ত্রীড়া ইত্যাদি প্রাণোচ্ছলতা বৈদগ্ধের অভাব পূর্ণ করেছে।
(৩) অশ্লীতা নয়, শিল্পত্ব: ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কিছু স্থূল হস্তাবলেপ আছে যাকে অলংকার শাস্ত্রমতে ‘রসাভাস’ বলে। এই কাব্যের অশ্লীলতা দেখে কোনও কোনও সমালোচক বিস্মিত হয়েছেন। আবার কোন কোন সমালোচক গ্রাম্য স্থূলরুচির অতিশয় নিন্দা করেছেন। কারণ তিনি আদি রসঘটিত বর্ণনা দিতে পিছু পা হননি। তবে এর জন্য তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ এটি যখন লেখা হয়েছে তখন পরিবেশ কিছুটা স্থূল ছিল।
(৪) রচনাধর্মিতা: কাব্যটি মূলত আখ্যান কাব্য। নাট্যধর্মিতা, গীতিধর্মিতা স্পষ্ট।
সর্বোপরি বলতে হয় ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব :
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিকেরা মন্তব্য করেছেন যে এতদিনে মধ্যযুগের বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন মিলল। বাস্তবধর্মী সমালোচকেরা রাধাকৃষ্ণের উদ্দাম-কাম-ক্রীড়ার মধ্যে বাঙালি সমাজের যথার্থ পরিচয় পেয়ে এটিকে মাটির কাছাকাছি কাব্য বলে মন্তব্য করেছেন। এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে নানাভাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে।
(ক) বাংলা সাহিত্যে প্রভাব: বাংলা সাহিত্যে এই কাব্যের প্রভাব সীমাহীন। বিশেষ করে বৈষ্ণবপদাবলীর ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। দুটি সাহিত্যের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। সেটি হল, উভয় সাহিত্যই রাধাকৃষ্ণ বিষয়কে নিয়ে। তবে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে যেখানে রাধাকৃষ্ণ চরিত্রর পরিণতি লাভ করেছে সেখানে বৈষ্ণবপদাবলীর রাধাকৃষ্ণের কাহিনি শুরু। কৃষ্ণ বিরহে রাধার অবস্থা ‘রাধা বিরহে’ আছে—
“যোগিনী রূপ ধরি লইবো দেশাত্তর।”
বৈষ্ণুবপদাবলীর রাধার অবস্থা এইরূপ।
“সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে
না চলে নয়ান তারা।
বিরতি আহারে রাঙ্গাবাস পরে
যেমত যোগিনী পারা।।”
এছাড়াও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি চৈতন্যদেব কর্তৃক আস্বাদিত হয়েছিল বলে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
(খ) আখ্যান কাব্য হিসাবে গুরুত্ব: ‘শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন মূলত আখ্যান কাব্য। কিন্তু নানা স্থানে নাট্য ও গীতিকাব্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট। কবি প্রায়ই যবনিকার অন্তরালে রয়ে গেছেন কিন্তু সংগতি রক্ষা করেছেন পাত্রপাত্রীর সংলাপের মধ্যে দিয়ে। তাই সবদিক দিয়ে বিচার করে এটিকে গীতি ও সংলাপ মূলক আখ্যান কাব্য বলা যেতে পারে।
(গ) ছন্দ ও আলঙ্কারিক গুরুত্ব: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ছন্দের বৈচিত্রও বিশেষ লক্ষণীয়।
এখানে দিগক্ষরা—
“একদিনে মনের উল্লাসে।
সখী মনে রস পরিহাসে।।”
একাবলী—
“আয়ি লা দেবের সুমতি গুণি
কংসের আগেক নারদমুনি।।”
ত্রিপদী, পয়ার প্রভৃতি ছন্দের মাধুর্য লক্ষণীয়। তাঁর অলংকারাদি বিশেষ উপভোগ্য। যেমন—কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার রূপ বর্ণনা—“লবলী দল কোমল”, “জুডু আ দেখি আঁ যেহ্ন রুচিক অম্বল।”
(ঘ) সমাজ ও ধর্মর্গত গুরুত্ব: এই কাব্য থেকে তৎকালীন সামাজ, রাজনীতি, মানুষের আচার আচরণ প্রভৃতির সঙ্গে মানুষের ধার্মিকতার বিশদ পরিচয় পাওয়া যায়।
সর্বোপরি বলতে হয় বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যখানি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হলেও এর অশ্লীলতা সম্পর্কে কোনও কোনও সমালোচক তিক্ত মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এর জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তিনি যে সময়ে এটি রচনা করেছেন সে সময়ের পরিবেশ কিছুটা স্থূল রুচির পরিচয় বহন করে। কিন্তু এই সামান্য ত্রুটিটুকু বাদ দিলে সাহিত্যের ইতিহাসে এটি অনবদ্য।