বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাবলী-সম্পর্কে একটি ইতিবৃত্তমূলক নিবন্ধ রচনা কর।

বাঙলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তার সম্পাদিত বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশকে লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ ‘রাজবদু-উন্নতধ্বনিঃ’ বলে যে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছেন, তা বস্তুতঃপক্ষে সমগ্রভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব-সম্বন্ধেই প্রযােজ্য। গদ্যসাহিত্যে সে দুটি ধারা প্রচলিত, সৃষ্টিমূলক সৃজনশীল কথাসাহিত্য এবং মননশীল প্রবন্ধ সাহিত্য—এই উভয় ধারাতেই প্রাণসঞ্চার করেছিলেন মনীষী ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, তাঁর সাহিত্য-শুরু হয়েছিল ভিন্ন পথে। তারপর সম্ভবতঃ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আপন মানস প্রবৃত্তির প্রকৃত স্রোতটির সন্ধান লাভ করেই তিনি যথােচিত পন্থা গ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র মাত্র ১৫/১৬ বৎসর বয়সেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর এবং সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সাময়িকপত্রে হাত পাকাতে শুরু করেছিলেন। তিনি প্রথমােক্ত পত্রিকায় ‘কলেজীয় কবিতাযুদ্ধে’ অংশগ্রহণ করে কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। মাত্র আঠারাে বৎসর বয়সে ১৮৫৬ খ্রীঃ। তার দু’খানি কাব্যগ্রন্থ ‘ললিতা পুরাকালিক গল্প তথা মানস’ নামে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া আরও কিছু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কবিতা রচনা করলেও তিনি এ ব্যাপারে অধিক কাল উৎসাহ বােধ করেন নি। এরপর ১৮৬৪ খ্রীঃ তিনি প্রথম গদ্যে উপন্যাস রচনা করেন, এটি কিন্তু ইংরেজী ভাষায় লিখিত, এর নাম ‘Rajmohan’s Wife’ হয়তাে বঙ্কিমচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন, মাতৃভাষাই তার স্বক্ষেত্র— এই বােধে তিনি অতঃপর ইংরেজীতে সাহিত্য রচনা প্রচেষ্টায় ক্ষান্তি দিয়ে মাতৃভাষায় সাহিত্য সাধনায় প্রবৃত্ত হন।

গদ্য সাহিত্যের যে ধারাটি সাধারণভাবে ‘কথাসাহিত্য’ নামে পরিচিত বঙ্কিমচন্দ্রকে সেই ধারার প্রবর্তক রূপে অভিহিত করা সম্ভবপর না হলেও তিনি যে প্রকৃত বাঙলা উপন্যাস সাহিত্যের স্রষ্টা এবং এই ধারার শ্রেষ্ঠ শিল্পী, এ বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করবার কোন অবকাশ নেই। বিষয়-বৈচিত্র্য, উপস্থাপনা, ভাষা ব্যবহার প্রভৃতি ব্যাপারে পরবর্তী কালে বাঙালী ঔপন্যাসিকগণ যথেষ্ট নােতুনত্ব ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন বটে, কিন্তু কেউ বঙ্কিমচন্দ্রকে অতিক্রম করতে পেরেছেন, এমন কথা বােধ হয় আজো বলা যায় না।

মনীষী প্রাবন্ধিক অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্ব বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করেছেন, “বঙ্কিমের হাতে বাঙলা উপন্যাস পূর্ণ যৌবনের শক্তি ও সৌন্দর্য লাভ করিয়াছে।.তাহার সব কয়টি উপন্যাসের মধ্যেই একটা সতেজ ও সমৃদ্ধভাব খেলিয়া যাইতেছে, জীবনের গভীর রস ও বিকাশগুলি ফুটিয়া উঠিয়াছে এবং জীবনের মর্মস্থলে যে বিমূঢ় রহস্য আছে, তাহার আলােকপাত করা হইয়াছে। তিনি জীবনকে বিচিত্র রসে পূর্ণ ও কল্পনার ইন্দ্রজালে বেষ্টন করিয়াছে বটে, কিন্তু সত্যের সূর্যালােকের পথ অবরুদ্ধ করেন নাই, ইহাই তাহার চরম কৃতিত্ব।”

বঙ্কিমচন্দ্র কর্মজীবনে উচ্চ রাজকর্মচারীর পদে অধিষ্ঠিত থেকেও সাহিত্য সাধনায় বিরতি কখনাে দেন নি। তিনি প্রতি বৎসর গড়ে একখানা করে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং তার বিষয়বস্তুতেও ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্য। একদিকে যেমন উপন্যাস রচনা করেছেন আর দিকে তেমনি বহু মননধর্মী প্রবন্ধও রচনা করেছেন। এ ছাড়া সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনার কাজ তাে ছিলই। বঙ্কিমচন্দ্র সর্বসমেত ১৪টি উপন্যাস রচনা করেন। বিষয়ানুযায়ী এদের চারটি পৃথক শ্রেণীতে নিবদ্ধ করা চলে। 

  • (ক) ‘ঐতিহাসিক ও রােমান্স-ধর্মী উপন্যাস’-রূপে অভিহিত করা চলে—’দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’, ও ‘রাজসিংহ’কে; 
  • (খ) সামাজিক ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস-রূপে অভিহিত করা চলে—’বিষবৃক্ষ’, ‘রজনী’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ কে; আর
  • (গ) তাত্ত্বিক ও দেশাত্মবােধক উপন্যাস-রূপে অভিহিত করা চলে—’আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতারাম’কে এবং ‘তার ইন্দিরা’ ও ‘রাধারাণী’কে ‘উপন্যাসিকা’ বা বড় গল্পরূপেই গ্রহণ করা চলে। এই সমস্ত উপন্যাস রচনার ফাকে ফাকে বঙ্কিমচন্দ্র কয়েকটি প্রবন্ধ গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে। বাঙলা ভাষায় রচিত এটিই প্রথম যথার্থ উপন্যাস। এটি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় কিছু কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে রচিত হলেও ঘটনাবাহুল্য ও রােম্যান্টিক মনােভাবে ভারাক্রান্ত এর কাহিনীটির সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক কম বলেই এটিকে ‘রােমান্স’ নামে আখ্যায়িত করাই সঙ্গত। ১৮৬৬ খ্রীঃ রচিত ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে শুধু একটা ঔপন্যাসিক পটভূমিকাই রয়েছে। এটি একটি প্রকৃত রােমান্সধর্মী উপন্যাস—এর চরিত্রসৃষ্টি, মানস-প্রকৃতির গঢ় রহস্য, সুক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, গীতরসােচ্ছাস, নাটকীয় চমৎকারিত্ব প্রভৃতি কাহিনীটিকে খুবই আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

১৮৬৯ খ্রীঃ রচিত ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে তুর্কী-আক্রমণ যুগের বাতাবরণ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। কাহিনী, চরিত্র সবই কল্পিত, এটিও রােমান্সধর্মী। ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ হিন্দুযুগের পটভূমিকায় সৃষ্ট একটি ক্ষুদ্রায়তন উপন্যাস-যথার্থ উপন্যাস-রূপে বিবেচিত হবার যােগ্যতা এর নেই। পলাশীর যুদ্ধাবশেষের পটভূমিকায় ১৮৭৫ খ্রীঃ রচিত ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের কিছু কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র থাকা সত্ত্বেও আসলে এটি একটি পারিবারিক এবং জীবনসমস্যামূলক উপন্যাস। বাঙলা উপন্যাসে এই কাহিনীতেই সর্বপ্রথম অবৈধ প্রেমের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই হিশেবে এটিকে আধুনিক বাঙলা উপন্যাসের প্রধান ধারাটির ‘আদর্শ’-রূপে চিহ্নিত করতে পারি।

১৮৮২ খ্রীঃ রচিত ‘রাজসিংহ’ ই বঙ্কিমচন্দ্রের সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে একদিকে যেমন ইতিহাসধর্ম অক্ষুন্ন রয়েছে, অপরদিকে তেমনি উপন্যাসরসেও সমৃদ্ধ। ১৮৮৭ খ্রীঃ রচিত ‘সীতারাম’ ঐতিহাসিক চরিত্র এবং এর পরিবেশও ইতিহাসসম্মত, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তত্ত্বদর্শিতা এবং প্রচারধর্মিতার যেমন পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি এর গার্স্থা-ধর্মিতাকেও অস্বীকার করা চলে না। ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ‘বিষবৃক্ষ’ ই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সামাজিক ও পারিবারিক উপন্যাস। উপন্যাসে তিনি ‘নিয়তি’ এবং ‘নীতিকে যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়েছেন এবং কোন কোন সমালােচকের মতে ঔপন্যাসিক এতে উদ্দেশ্যপরায়ণতার নিকট শিল্পকে বলি দিয়েছেন।

১৮৭৭ খ্রীঃ রচিত ‘রজনী’ নামক ক্ষুদ্রকায় উপন্যাসটি রচনায় বঙ্কিম একটি ইংরেজি উপন্যাসের ছায়া অনুসরণ করেছেন। এর গঠনরীতি এবং পরীক্ষা-প্রণালীর বিচারে এটি বাঙলা সাহিত্যের একটি অভিনব সৃষ্টি। ১৮৭৮ খ্রীঃ রচিত ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ অনেকের মতেই বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বোৎকৃষ্ট উপন্যাস। এতে যে পারিবারিক সমস্যা প্রদর্শিত হয়েছে, আসলে সেটি সেকালের একটি বিরাটি সমাজসমস্যারই অঙ্গ। এই উপন্যাসেও বঙ্কিমচন্দ্রের নীতিবাগীশ মনােধর্মের পরিচয় পাওয়া যায় বলেই অনেকে অভিযােগ উত্থাপন করেছেন। বঙ্কিমের তাত্ত্বিক ও দেশপ্রেমমূলক উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘আনন্দমঠ (১৮৮২) ও ‘দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৫) এবং অংশতঃ ‘সীতারাম’ও। প্রথমােত্ত গ্রন্থ দুটিই ইংরেজ শাসনের প্রারম্ভ যুগের পটভূমিকায় রচিত এবং উভয় কাহিনীর পিছনেই কিছু কিছু সত্য ঘটনাও রয়েছে বলে মনে করা হয়।

‘আনন্দমঠ’ তত্ত্বভারাক্রান্ত এবং কলাকৌশলে কিছু উন হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিকট এর মূল্য ছিল অপরিসীম। ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসেও একটি ঐতিহাসিক পটভূমি থাকলেও বঙ্কিমচন্দ্র এতে নিষ্কাম কর্মযােগের আদর্শকে গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে এতে সমাজ-জীবনের ও সামাজিক আচার আচরণের একটা বিশ্বাস্য এবং বাস্তব চিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। সমালােচকের ভাষায়, “বঙ্কিমের আকাশচারী কল্পনা এই উপন্যাসে মাধ্যাকর্ষণের টান স্বীকার করিয়া মৃত্তিকায় নামিয়া আসিয়াছে।”

কথাসাহিত্য-ব্যতিরিক্ত গদ্যসাহিত্যের অপর প্রধান ধারা ‘প্রবন্ধ সাহিত্য’। কথাসাহিত্য-রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র যেমন অগ্রণী পুরুষ, প্রবন্ধ সাহিত্যে তেমন অবস্থা নয়। রামমােহন-অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগর প্রভৃতি প্রবন্ধ সাহিত্যের বুনিয়াদ গেঁথে গেলেও প্রবন্ধকে স্বাদু, রসগ্রাহী ও শিল্পসম্মত সাহিত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন বন্ধিমচন্দ্রই।

অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, “তথ্যঋদ্ধ মননশীল প্রবন্ধ এবং ব্যক্তিনির্ভর রসমধুর হৃদয়গ্রাহী প্রবন্ধ—এই দ্বিবিধ ধারাতেই বঙ্কিমচন্দ্রের পারদর্শিতা অনতিক্রান্ত। বস্তুতঃ একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে অপর কোন ব্যক্তিই বিষয়-বৈচিত্র্য, রচনাভঙ্গিতে, স্বাদুতায় কিংবা ব্যক্তিস্পর্শজাত আন্তরিকতায় বন্ধিমচন্দ্রকে অতিক্রম করতে পারেন নি। বঙ্কিমচন্দ্র যখন ভাবগম্ভীর গুরুতর বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন, তখন তাতে তথ্যের সমাহার এবং যুক্তি ব্যবহারে নিশ্ছিদ্র নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন; আবার যখন বিষয়-ভার বর্জন করে লঘুপক্ষে বিহঙ্গের মতাে প্রবন্ধের আকাশে বিচরণ করতে চেয়েছেন, তখন সংযত শুভ্র হাস্যরসে পরিপূর্ণ উচ্ছসিত ভাবরসে সিক্ত গীতিমধুর কাব্যধর্মী প্রবন্ধও রচনা করেছেন।”

বঙ্কিম-রচিত প্রবন্ধগুলিকে বিষয়-বিচারে তিনটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা চলে (১) ‘ব্যঙ্গাত্মক ও সরস প্রবন্ধ’-পর্যায়ভুক্ত করা চলে ‘লােকরহস্য’ (১৮৭৪ খ্রীঃ), ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’ (১৮৮০) এবং ‘কমলাকান্তের দপ্তর’কে (১৮৭৫) (খ) ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৮৬, ১৮৯২) এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৮) গ্রন্থদ্বয় ‘দর্শন ও শাস্ত্রবিষয়ক’ প্রবন্ধ-রূপে অভিহিত হয়; (গ) তৃতীয় পর্যায় ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমালােচনা-বিষয়ক প্রবন্ধ’ শ্রেণীতে পড়ে ‘বিজ্ঞানরহস্য’ (১৮৭৫), ‘বিবিধ সমালােচনা’ (১৮৭৬), ‘প্রবন্ধ পুস্তক’ (১৮৭৯), ‘সাম্য’ (১৮৭৯), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৮৭, ১৮৯২)।

বিভিন্ন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত ১৫টি প্রবন্ধের সংগ্রহরূপে গ্রথিত ‘লােকরহস্য’ সম্বন্ধে সমালােচক অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র দাস মন্তব্য করেছেন, “সামাজিক প্রবন্ধের মধ্যে ‘লোকরহস্য’ ই বঙ্কিমচন্দ্রের অক্ষয়কীর্তি, ইহার অধিকাংশ স্থানে মানবচরিত্র-সম্বন্ধে লঘুকৌতুকের মধ্য দিয়া যে বিদ্রুপবাণ নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, উহা অনেকস্থলে Swift-এর তিক্রমধুর ব্যঙ্গের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়।” ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনাচরিতে’ বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজের মােসাহেব জাতীয় লােকদের তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বাণে জর্জরিত করেছেন। কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অপর দু’টি অংশ ‘কমলাকান্তের পত্র’ এবং ‘কমলাকান্তের জবানবন্দী’।

গ্রন্থের পরিকল্পনায় কোন কোন ইংরেজি গ্রন্থের ছায়াপাত ঘটলেও এর মৌলিকতা অনস্বীকার্য। ভাষার মাধুর্য, ভাবের মনােহারিত্ব, বিষয়ের অভিনবত্ব, শুভ্র সংযত সহজ সরস রসিকতা এবং এমন কি দেশপ্রেমের দিক থেকেও কমলাকান্তের দপ্তর’ এক অনবদ্য রচনা। এ কালে রম্যরচনা বলতে যা বােঝায়, তার সবগুণই এতে আছে, অথচ লঘুতা-তরলতা-আদি কোন দোষ নেই।

‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র স্বীকার করেছেন যে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতারত্বে বিশ্বাসী হলেও আলােচ্য গ্রন্থে তাকে আদর্শ মানবসন্তানরূপেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টভঙ্গি থেকে কৃষ্ণচরিত্র বিচার করেছেন।

‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে যুক্তিবাদী বঙ্কিম নৈয়ায়িক যুক্তিবাদের আশ্রয়ে নিশ্চেষ্ট কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জাড্যদোষগ্রস্ত হিন্দুসমাজে নবজীবন সঞ্চার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু বিচিত্র ধারায় বঙ্কিমচন্দ্রের যে আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা ছিল, তারই পরিচয় পাওয়া যায় ‘জ্ঞানবিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থগুলিতে। সমকালীন যুগের পক্ষে অস্বাভাবিক হলেও তিনি অর্থনীতি, সাম্যবাদ, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়েও অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সাহিত্যের রূপকল্প এবং সাহিত্য সমালােচনা বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র যে কয়টি প্রবন্ধ রচনা করেছেন, তাতে সমালােচনা-সাহিত্যের যে ধারার সৃষ্টি হয়, এটিই পরবর্তীকালে সাধারণভাবে গ্রন্থ সমালােচনার মানদণ্ড-রূপে গৃহীত হয়েছে। সর্বশেষ বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বঙ্গদর্শন’ নামক সাময়িক পত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন যে বঙ্গদর্শনের আবির্ভাব “বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।”

অনার্স বাংলা প্রথম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment