প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত দুটি ছােটোগল্পের নাম উল্লেখ করে ছােটোগল্প রচনায় তাঁর বিশিষ্টতা সম্পর্কে আলােচনা করাে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের দুটি উল্লেখযােগ্য ছােটোগল্প হল ‘শুধু কেরানী’ এবং ‘পুন্নাম’।
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন কল্লোল-গােষ্ঠীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছােটোগল্পকার। তাঁর রচিত উল্লেখযােগ্য ছােটোগল্পগ্রন্থগুলি হল ‘বেনামী বন্দর’ (১৯৩০ খ্রি.), ‘পুতুল ও প্রতিমা’ (১৯৩১ খ্রি.), ‘মৃত্তিকা’ (১৯৩৫ খ্রি.), ‘পঞ্চশর’ (১৯৩৪ খ্রি.), ‘সপ্তপদী’ (১৯৫৩ খ্রি.), ‘নানা রঙে বােনা’ (১৯৬০ খ্রি.), ‘ধূলিধূসর’ (১৯৩৮ খ্রি.) এবং ‘মহানগর’ (১৯৪৩ খ্রি.)।
কল্লোল-গােষ্ঠীর অন্যান্য লেখকদের মতাে তাঁর গল্পেও অবশ্য আমরা পেয়ে যাই কঠোর কঠিন বাস্তবতা এবং বুদ্ধির প্রখরতা। তাঁর ‘হয়তাে’ ‘স্টোভ’, ‘শৃঙ্খল’, ‘মহানগর’ ইত্যাদি গল্পে রয়েছে মধ্যবিত্তের মূল্যবােধের ভাঙনের ছবি। ‘শুধু কেরানী’ গল্পে পাই মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতার করুণ ছবি। ‘পুন্নাম’ গল্পে রূপায়িত হয়েছে বিবেকহীনতা ও প্রতারণার বিষাদময় রূপ, ‘বিকৃত ক্ষুধার’ ফাঁদে গল্পে পাই অসহায় বীভৎসতার চিত্র। ‘তেলেনাপােতা আবিষ্কার’ গল্পে পাওয়া যায় মধ্যবিত্ত মানসিকতার এক গল্পকথককে, যিনি এক অদ্ভুত কাপুরুষতা ও স্বার্থপরতার বশবর্তী হয়ে অতি সহজেই ভুলে যেতে পারেন একটি অসহায় মেয়েকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতির কথা। ‘শৃঙ্খল’ গল্পে রয়েছে মৃত দাম্পত্যজীবনের বাধ্যতামূলক ভারবহনের করুণ চিত্র। আশ্চর্য- সহজ এক অনাড়ম্বর ভাষায় প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর গল্পে কঠোর বাস্তবকেই প্রধান অবলম্বন করলেও তাঁর রচনায় আমরা একটি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাক্ষাৎ পেয়ে যাই।
বাংলা ছােটোগল্পে পরশুরামের অবদান
পরশুরাম (১৮৮০-১৯৬০ খ্রি.) ছদ্মনামে বাংলা কথাসাহিত্যে যিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁর আসল নাম রাজশেখর বসু। ৯৭টি গল্প এবং নয়টি গল্পগ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এসব গল্পে চরিত্রের আচার-ব্যবহার, সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে অসাধারণ কৌতুকরস সৃষ্টি করেছেন পরশুরাম। ‘গড্ডলিকা’, ‘কজ্জলী’, ‘হনুমানের স্বপ্ন’ ‘ইত্যাদি গল্প’, ‘ধূস্তরী মায়া ইত্যাদি গল্প’, ‘নীলতারা’ ইত্যাদি গল্প প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযােগ্য গল্পসংকলন।
মানুষের জোচ্চুরি, ভণ্ডামি প্রভৃতির বিরুদ্ধে পরশুরামের কৌতুককর আক্রমণ শানিত হয়েছে ‘বিরিঞ্চিবাবা’, ‘কচি সংসদ:, ‘মহাবিদ্যা’, ‘উলটপুরাণ’ প্রভৃতি গল্পে। ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পে সমাজের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বাসা বেঁধে থাকা ধর্মান্ধতাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ‘কচি সংসদ’-এ তৎকালীন নতুন ধারার কবিদের মেয়েলিপনাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ-এর আচার-আচরণের অসঙ্গতি নিয়ে বৈঠকি মেজাজে পরশুরাম রচনা করেছেন ‘লম্বকর্ণ’, ‘দক্ষিণ রায়’, ‘স্বয়ংবরা’, ‘মহেশের মহাযাত্রা’ গল্প। ‘জাবালি’, ‘পাঞ্চালী’, ‘হনুমানের স্বপ্ন’, ‘তৃতীয় দূতসভা’—প্রভৃতি পুরাণ কাহিনিনির্ভর গল্পে আমরা পাই লেখকের সংস্কারমুক্ত, আধুনিক কৌতুকময়তা।
সূচনাকালে বাংলা শিশুসাহিত্য সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ রচনা
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শিশুপুরাণই হল পৃথিবীর সবচেয়ে আদি পুরাণ এবং তা প্রায় মানুষের সমবয়সী। তাই শিশুমনের উপযােগী করে সাহিত্য রচনার একটি প্রয়াস ছােটো বড়াে সকল সাহিত্যিকের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। চর্যাপদ থেকে বাংলা সাহিত্যের যাত্রাপথ শুরু হয়েছে বলে যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে কিন্তু বলতেই হয় সেই একাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলায় শিশুসাহিত্য প্রায় কিছুই রচিত হয়নি।
অবশ্য, বাংলায় অনূদিত রামায়ণ বা মহাভারতে শিশু মনােরঞ্জনের উপযােগী নানা কাহিনি স্থান পেত। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এদেশে শিশুপাঠ্য লেখার প্রথম প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়ােজন মদনমােহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ গ্রন্থের কথা। শিশুদের অক্ষর পরিচয়ের জন্য বিদ্যাসাগর লিখলেন ‘বর্ণপরিচয়’। তাদের নৈতিক চরিত্র দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার প্রয়ােজনে এরপর তিনি স্কুল-পাঠ্য হিসেবে রচনা করলেন আখ্যানমঞ্জরী, বােধােদয়, কথামালা প্রভৃতি। অক্ষয় দত্তের ‘চারুপাঠ’ও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। শিশুদের অক্ষর পরিচয়কে আরও আনন্দময় করে তুলতে যােগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর বইকে করে তুললেন সচিত্র। তাঁর রচিত কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘হাসিখুশি’, ‘হাসিরাশি’, ‘ছবি ও গল্প’, ‘হাসিখেলা’। লক্ষণীয়, প্রথম পর্যায়ে শিশুদের বইগুলি কিন্তু মােটেও মৌলিক ছিল না, তা ছিল নানা লােককথা বা সংস্কৃত, ইংরেজি বা হিন্দি গ্রন্থের অনুবাদ।
উপেন্দ্রকিশাের থেকে আধুনিক পর্যন্ত শিশুসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
বাংলা শিশুসাহিত্যকে সাবালক করার প্রথম কাণ্ডারি হলেন উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী। ‘টুনটুনির কথা’, ‘পানতাবুড়ি’, ‘সাক্ষীশেয়াল’ প্রভৃতি কালজয়ী শিশুসাহিত্যের রচয়িতা তিনি। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, নানা উপকথা-রূপকথা বা লােককথাকে তিনি বাঙালি শিশু-মনের উপযােগী ভাব-ভাষা দিয়ে লিখতে পেরেছিলেন। তার পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্য রচয়িতা হলেন তাঁর পুত্র সুকুমার রায়।
সুকুমার রায়ের ‘আবােল তাবােল-এর নাম শােনেনি, এমন বাঙালি শিশু নেহাতই বিরল। ননসেন্স ভার্সের এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বসাহিত্যেও তুলনাহীন। রায়চৌধুরী পরিবারের অন্যান্য শিশুসাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় সুখলতা রাও, পুণ্যলতা চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার ও সত্যজিৎ রায়ের কথা। লীলা মজুমদারের ‘পদি পিসির বর্মি বাক্স’ বা সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’ এবং ‘প্রফেসর শঙ্কু’ হল কালজয়ী সৃষ্টি। এ ছাড়া বিখ্যাত শিশুসাহিত্যের মধ্যে উল্লেখ করতে হয় দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’র কথা। রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’, ‘শিশু ভােলানাথ’ বা ‘খাপছাড়া’ কাব্যগ্রন্থগুলিও যথেষ্ট পরিমাণে শিশুমনের উপযােগী করে লেখা। রবীন্দ্রনাথের সে গল্পগ্রন্থের কথাও প্রসঙ্গত উল্লেখ্য।
অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘বুড়াে আংলা’, ‘নালক’, ‘রাজকাহিনী’ প্রভৃতি বইগুলাে বিখ্যাত শিশুসাহিত্য। চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ বাংলা শিশুসাহিত্যের একটি উল্লেখযােগ্য সংযােজন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লালুর গল্পগুলি বাংলা শিশুসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দ্রুত বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিশুসাহিত্য বা কিশােরসাহিত্যের চরিত্রও কিছুটা বদলে গেল। পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিকরা হলেন শিবরাম চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (ডিটেকটিভ গল্প), সুনির্মল বসু, আশাপূর্ণা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় প্রমুখ।