জনপদের যুগে বিভিন্ন সংগঠনের বিকাশ
বৈদিক সভ্যতার প্রথমদিকে পশুচারণকে কেন্দ্র করে উপজাতীয় আর্যরা যাযাবর জীবনযাপন করলেও পরবর্তীকালে তাদের সমাজে কৃষিব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। ফলে যাযাবর জীবন ছেড়ে তারা নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তােলে। এভাবে বিভিন্ন জনপদের বিকাশ ঘটে। জনপদগুলিতে নতুন কয়েকটি সংগঠনেরও বিকাশ ঘটে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ‘গহপতি”, বণিক, শাসক প্রভৃতি।
[1] গহপতি : জনপদে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তােলার পর আর্যদের পারিবারিক জীবনে সুস্থিতি আসে। এই সময় পৃথক পৃথক আর্য পরিবারগুলির প্রধান ‘গহপতি’ নামে পরিচিত হন। গহপতি তাঁর পরিবারের ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। কৃষিব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আর্যসমাজে সম্পত্তির মধ্যে কৃষিজমি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। গহপতি তার এই কৃষিক্ষেত্র ক্রীতদাস ও শূদ্রদের দিয়ে চাষ করাত। এভাবে বঞ্চিত শ্রমিকদের কাজে নিয়ােজিত করে আর্য সমাজে উদ্বৃত্ত শস্য উৎপাদনের কাজ সচল থাকে।
[2] বণিক: জনপদে কৃষির পাশাপাশি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। পণ্য বিক্রির মাধ্যমে বণিকরা প্রভূত মূলধন অর্জন করে যা তারা তাদের বাণিজ্যের কাজে নিয়ােজিত করে। প্রভূত অর্থসম্পদের মালিক হিসেবে বণিক শ্রেণি জনপদের সমাজজীবনে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়। ব্রাহ্ম্য ঐতিহাসিক উপাদানগুলিতে এই বাণিজ্য এবং বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত বৈশ্য শ্রেণির নিন্দা করা হয়েছে।বাণিজ্যের প্রসারের ফলে জনপদে নগরজীবনেরও প্রসার ঘটে।বণিকরা নগরে বসবাস শুরু করে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাণিজ্য করার সূত্রে বৃহত্তর ভূখণ্ডে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়।
[3] শাসক: জনপদের যুগের শেষদিকে আর্যসমাজে শাসক হিসেবে রাজার ধারণা গড়ে উঠতে থাকে।রাজা বলতে কোনাে একটি গােষ্ঠীর প্রধানকে বােঝাত। উদাহরণস্বরূপ, কিংবদন্তির রামচন্দ্র প্রায়শই রঘুকুলরাজ বলে উল্লিখিত হতেন যার অর্থ হল যিনি রঘু গােষ্ঠীর শাসক। একইভাবে, যুধিষ্ঠিরকে বলা হত কুরুরাজ। রাজাকে গােষ্ঠীর পিতৃতুল্য চরিত্র মনে করা হত, কারণ তিনি গােষ্ঠীর সম্পদ রক্ষা করতেন। তাঁর কোনাে স্বাধীন করব্যবস্থা বা সেনাদল ছিল না।
জনপদ ও মহাজনপদের পার্থক্য
জনপদ
- জনপদ বলতে বৈদিক যুগের (বা লৌহ যুগের) উপজাতীয় আর্যগােষ্ঠীর ক্ষুদ্র আবাসভূমি বা অঞ্চলকে বােঝায়।
- জনপদ ছিল ভারতের লৌহ যুগের রাজনৈতিক ধারণা।
- জনপদ থেকে পরবর্তীকালে মহাজনপদগুলির উত্থান ঘটে।
- মহাকাব্যের যুগে জনপদগুলি তার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে।
- আর্যদের উপজাতীয় জীবনের জনপদগুলির আয়তন ছিল মহাজনপদের আয়তনের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র।
- জনপদগুলির শাসকের ক্ষমতা ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
- জনপদের যুগে ভারতীয়দের রাজনৈতিক বিকাশ ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে আবদ্ধ।
- জনপদের যুগে সুনির্দিষ্ট করব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই সময় নাগরিকরা রাজা বা শাসককে অনিয়মিত স্বেচ্ছা কর ও বিভিন্ন দানসামগ্রী দিত।
- জনপদের যুগে গাে-সম্পদের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। বৈদিক সাহিত্যে ‘গােধন’ সম্পর্কে প্রচুর আলােচনা পাওয়া যায়।
মহাজনপদ
- মহাজনপদ বলতে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের যুগে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত বৃহৎ রাজ্যগুলিকে বােঝায়।
- মহাজনপদ ছিল লৌহ যুগের অনেক পরবর্তীকালের ধারণা।
- মহাজনপদগুলি থেকে পরবর্তীকালে বৃহৎ ও ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
- মহাকাব্যের জনপদগুলি ধারাবাহিক লড়াইয়ের মাধ্যমে বৃহৎ মহাজনপদে পরিণত হয়| খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাজনপদগুলির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে।
- বিভিন্ন জনপদ সংযুক্ত হয়ে এক-একটি মহাজনপদ গড়ে ওঠে বলে মহাজনপদগুলির আয়তন ছিল জনপদের চেয়ে বড়াে।
- মহাজনপদগুলির শাসকের ক্ষমতা ছিল জনপদগুলির শাসকের চেয়ে বেশি।
- মহাজনপদের যুগে ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনা যথেষ্ট বিকশিত ছিল।
- মহাজনপদের যুগে রাজা বা শাসক সুনির্দিষ্ট করব্যবস্থা গড়ে তােলেন এবং নাগরিকরা তাক নিয়মিত কর দিতে বাধ্য ছিলেন৷
- মহাজনপদের যুগে কৃষিপণ্যের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। কৃষিপণ্য হিসেবে এই সময়ে সাহিত্যিক উপাদনগুলিতে বিভিন্ন প্রজাতির ধানের আলােচনা পাওয়া যায়।