আধুনিককালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কমিশন বলেছেন, স্থানীয় প্রয়োজনের ভিত্তিতে দেশের যেখানে যেভাবে সম্ভব এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন স্বায়ত্ত সাধন প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কিছু অনুদান ও সাহায্য দিয়ে প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে।
বর্তমান ভারতের সকল প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান করে চলেছে সেই সকল প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে আলোচনা করা হইল।
১ ক্লেশ
ক্লেশ হল প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। শিশুর কাছে এটি দ্বিতীয় পরিবারের মতো। এই প্রতিষ্ঠানের শিশু লালন পালনের দিকটি অতি যত্ন সহকারে করা হয়।
এখানে সাধারণত জন্মের পর থেকে দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। শিশুরা প্রায় সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই সকল কেন্দ্রে থাকে।
যে সকল পরিবারের পিতা-মাতা উভয় চাকুরীজীবী সেই সকল পরিবারের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা এখানে লালিত পালিত হয়ে থাকে।
২ নার্সারি বিদ্যালয়
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয় হল নার্সারি বিদ্যালয়। নিম্নে এই বিদ্যালয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
উদ্ভাবক ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের দুই ভগ্নি মার্গারেট মার্কমিলান ও রাচেল ম্যাকমিলান লন্ডনে নার্সারি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
উদ্দেশ্য এই জাতীয় বিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল যে সমস্ত পরিবারের অর্থ সামাজিক মর্যাদা কম সেই সমস্ত পরিবারের শিশুর শিক্ষাদান করে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
সময়কাল দুই থেকে ৩ বৎসরের শিশুরা নার্সারীর ভিতরে ভর্তি হয়। দুপুরে সামান্য কয়েক ঘন্টার জন্য শিশুরা এইসব বিদ্যালয়ের সময় অতিবাহিত করে। এখানে শিশুর ইন্দ্রের মাধ্যমে ব্যাপক জ্ঞান আহরণ করতে পারে ।
পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়
এই সমস্ত বিদ্যালয়ে শিশুদের ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি – খেলাধুলা, সংগীত, ছড়া বলা, ছবি আঁকা, গল্প বলা, নাচ ইত্যাদি। এছাড়া প্রাথমিক কাজ গুলি নিজে যাতে করতে পারে তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এক কথায় এইসব বিদ্যালয়ে শিশুদের দৈহিক, মানসিক বিকাশের উপযোগী কতগুলি কার্যকরী শিক্ষা দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে তারা সমাজের একজন উপযুক্ত নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
৩ মন্তেসরি বিদ্যালয়
প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার যে সকল বিদ্যালয় রয়েছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মন্তেসরি বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের বর্ণনা নির্ণয় আলোচনা করা হলো –
প্রতিষ্ঠাতা: – মন্তেসরি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মাদাম মায়ারি মন্তেসরি। 1967 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত তার বিদ্যালয়ের নাম হলো – শিশু নিকেতন।
বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য:- এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হল শিশুদের ইন্দ্র গুলিকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে শিশুরা ইন্দ্রের মাধ্যমে ব্যাপক জ্ঞান আহরণ করতে পারে।
শিক্ষাদানের বিষয়বস্তু:- এই বিদ্যালয়ের কোন ধরা বাধা পাঠক্রম নেই অর্থাৎ বাধ্যতামূলক কোন পাঠক্রম নেই। সক্রিয়তা ও ইন্দ্রিয় অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে শিশুরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে।
বিভিন্ন প্রকারের শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে শিশু দুটি বস্তুর আকার, বস্তুর ওজন, রং ও তামাচার পার্থক্য বুঝতে পারবে।
শিশুদের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, সংগীত, উদ্যান রচনা, হাতের কাজ ইত্যাদির আয়োজন এই সমস্ত বিদ্যালয় রয়েছে।
শিক্ষাদান পদ্ধতি:- ব্যাক্তি কেন্দ্রিক শিখন পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান প্রদান করা হয়। এখানে ইন্দ্রিয় অনুশীলনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ইন্দ্রিয় অনুশীলনের উপকরণ গুলিকে ডাইবেটিক অপারেটর বলে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল – লাল রঙের ঘনক, পিরামিড, গোলক, সিলিন্ডার, বিভিন্ন ওজনের কাঠের টেবিল এবং ছোট ছোট ঘন্টা ইত্যাদি।
এইসব উপকরণ গুলি নারাজ চড়ার মধ্যে দিয়ে শিশুরা বিভিন্ন বস্তুর গঠন, আকৃতি, রং প্রকৃতির পার্থক্য নির্ণয় করতে শেখে। ভাষা এবং গণিত শেখাতে এই সকল উপকরণ সাহায্য করে।
৪ কিন্ডার গার্ডেন বিদ্যালয়
প্রাথমিক শিক্ষার যে সমস্ত বিদ্যালয় রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো কিন্ডার গার্ডেন বিদ্যালয়। অতএব এই বিদ্যালয়ে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হইল,
প্রবর্তক:- ফ্রেডরিক উইলহেম, আগস্ট আগস্ট ফ্রয়েবেল ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে কিন্ডার গার্ডেন বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
অর্থ:- কিন্ডার গার্টেন কথাটির অর্থ হলো শিশুর দান। বিদ্যালয়ে হল একটি উদ্যান স্বরূপ। এবং শিশুরা হল সেই উদ্যানের চারা গাছ।
উদ্দেশ্য:- এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হলো শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ। শিশুর ইন্দ্রিয় মর্যাদা সাথে সাথে স্বাস্থ্য, শারীরিক ও নানা ধরনের অভ্যাস গঠন করা ও মানসিক মর্যাদার দেওয়ার চেষ্টা করা।
সময়কাল:- কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়ে ৪ থেকে ৫ এবং ৬ থেকে ৭ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়।
পাঠক্রম:- কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়ের পাঠক্রম খেলা, ব্যায়াম, ইন্দ্রের উৎকর্ষ সাধনের উপযোগী কাজ, কাঠের কাজ, গান করা, গল্প করা, ছবি আঁকা, দলগত ভাবে কাজ প্রভৃতি করা হয়।
পদ্ধতি:- কিন্টারগার্টেন বিদ্যালয় গুলিতে বিভিন্ন অদ্ভুত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি মূলত Gift and Occupation – এর সাহায্যে শিক্ষাদান করা হয়ে থাকে।
কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি হলো খেলা-ভিত্তিক পদ্ধতি। খেলার স্বাধীনতা , সক্রিয়তা এই পদ্ধতিতে অনুসরণ করে থাকে।
শিক্ষক:- যদি শিশুরা হয়ে থাকেন শিশু উদ্যানের চারা গাছ, তাহলে শিক্ষকরা হবেন ওই গাছের মালি। মালি যেমন তার পরিচর্যার মাধ্যমে উদ্যানের চারা গাছকে বড় করে তোলে তেমনি মালেরূপ শিক্ষক তার পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেন।
শৃঙ্খলা:- ফ্রয়েবেল তার কিন্টারগার্টেন বিদ্যালয় মুক্ত শৃঙ্খলার কথা বলেছেন। বিভিন্ন কর্ম প্রেরণার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেকে সংযত করতে শিখবে। তবে ফ্রয়েবেল এখানে সামাজিক শৃঙ্খলা কথা বলেছেন।
৫ প্রাক বুনিয়াদি বিদ্যালয়
জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষা দর্শনের দ্বারা প্রবাহিত হয়ে প্রাক বুনিয়াদী বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে।
এই বিকেলে গুলিতে শিশুর চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশের অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস, নিয়মানুবর্তিত ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব অলক করা হয়েছে।
সেই জন্য এ বিদ্যালয়ের পাঠক্রম প্রত্যাহিত জীবনের উপযোগী কর্ম গুলি প্রাথমিক কাজকর্ম, আচার-আচরণ, সিজন মূলক কাজকর্ম, সামাজিক শিক্ষা সংক্রান্ত কাজকর্ম, সু অভ্যাস, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তবে এসব বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কোন পাঠক্রম নেই। সামাজিক বিভিন্ন কারণেই জন্য এই বিদ্যালয়গুলো বেশি স্থায়ী হয়নি।
৬ বালশিক্ষামন্ত্রী
বাল শিক্ষা মন্দির অর্থাৎ এই বিদ্যালয়গুলি বুনিয়াদিও মন্তেসরী বিদ্যালয়ের মাঝামাঝি একটি প্রতিষ্ঠান। বুনিয়াদি শিক্ষার ভালো গুণ এবং মন্তেসরি বিদ্যালয়ের ভালো গুণ গুলির মিশ্রণে এই বিদ্যালয়টি তৈরি হয়েছে।
এখানে বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের পাঠক্রম এবং মন্তেসরি বিদ্যালয় পাঠক্রম কে অনুসরণ করে পাঠ্য বিষয়ের সিদ্ধান্ত করা হয়েছে।
কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে এই সমস্ত বিদ্যালয় গুলি বিশেষভাবে স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি বা দীর্ঘসম্পন্ন হতে পারেনি।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো ভারতবর্ষে ও বিভিন্ন ধরনের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেগুলি অতটা হবে অগ্রগতি হতে পারেনি।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আগাছার মত যেখানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গজে উঠলেও এই শিক্ষার প্রকৃতি উদ্দেশ্যে এখনো বাস্তবায়িত করার সম্ভব হয়নি।
বর্তমানে যে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে উঠেছে সেগুলি গুণগুণের দিক থেকে অন্তত নিম্নমানের।
অর্থাৎ যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে পাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল তাকে বর্জন করে গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা এই সমস্ত বিদ্যালয় গুলিকে প্রদান করা হয়েছে।
এতে শিশু মনের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে তার কোন সন্দেহ নেই।
তাই প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার আদর্শকে অনুসরণ করে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালিত হয় তবে শিশুরা নিজেদের ইচ্ছা মতো যেমন শিক্ষা গ্রহণ হবে, তেমনি তাদের শিক্ষার সঙ্গে একটি মধুর সম্পর্ক স্থাপন হবে।