পৌরাণিক কাহিনী বা মিথস এর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য লেখো । ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনীর পার্থক্যগুলি তুলে ধরো?

পৌরাণিক কাহিনী বা মিথস

(১) সংজ্ঞা

সৃষ্টির আদিম কালে অপরিণত বুদ্ধির মানুষ যে সমস্ত ধর্মীয় অলৌকিক গল্প কাহিনী রচনা ও প্রচার করে তাকে পৌরাণিক কাহিনী বা লোকপুরাণ (Myth) বলে। লোক পুরানগুলি লোকসমাজের দ্বারা মৌখিকভাবে সুখ প্রাচীন অতিথ থেকে রচিত হয়ে আসছে। ‘Myth’ শব্দটি এসেছে গিক শব্দ ‘Muthos’ থেকে। সমাজতত্ত্ববিদদের ধারণায় সমাজের চারিদিকে, আকাশে, মাটিতে যে সমস্ত মাটিতে যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর উত্তর খোঁজার তাগিদে এই প্রথম লোক পুরান গড়ে ওঠে। ব্রিটেনের ফোকলোর সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ লরেন্স গোম। তিনি বলেছেন, লোক পূরণ হল ‘দ্য সায়েন্স অফ এ প্রইসআয়এনটইফইক এজ’ । জে. এফ রিয়ারলেইন তার ‘Parallel Myths’ গ্রন্থে লিখেছেন -পৌরাণিক কাহিনী হল আমাদের অবচেতন মনের কাহিনী বিশেষ যা সম্ভবত আমাদের জিনেএ উপলব্ধি থাকে”।

(২) বৈশিষ্ট্য-সাধারণ

(১) চরিত্রগত : লোক পুরানে কেন্দ্রীয় চিত্র হলো অলৌকিক দেব দেবীগণ। এতে কাহিনীর মূল চরিত্র ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপরে আরোপিত। মূল চরিত্রটি স্তরের অলৌকিক লীলা কাহিনী বা কর্মকাণ্ডে রূপকার।

(২) কাহিনীগত : পৌরাণিক কাহিনী গুলির মূলত ধর্মভিত্তিক। ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পুজো-পার্থনা, ধর্মোৎসব-উপচার ইত্যাদি ভিত্তিতে পৌরাণিক কাহিনী গড়ে ওঠে। বিশ্ব সৃষ্টি রহস্য, দেবতা-মানবের জন্ম, মহা-প্লাবন, দেবতা-দানব-মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা-পূর্ণজন-অবতার, স্বর্গ-নরক, পাপ পুণ্য সমস্ত কিছুই হলো এ বিষয়।

(৩) প্রকৃতিগত : পৌরাণিক কাহিনীগুলি ধর্মীয় প্রকৃতির হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পুজো পার্থনা, ধর্মোৎসব-উপাচার ইত্যাদি ভিত্তিতে পৌরাণিক কাহিনী গড়ে ওঠে।

(৪) শ্রেণীবিভাগ : শ্রেণীবিভাগ গত বিচারে পৌরাণিক কাহিনী বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত যথা – (i) দৃষ্টিতত্ত্বমূলক, (ii) মানুষের উদ্ভবমূলক, (iii) দৃষ্টিমূলক, (iv) প্রলয়সূচক, (v) আগুনের অধিকার বিষয়ক, (vi) সংস্কৃতির বিকাশ বিষয়ক, (vii) চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র কেন্দ্রিক, (viii) সামাজিক বিধি-বিধান বিষয়ক, (ix) ধর্মাচার সম্পর্কিত, (x) সংস্কৃতি ধাতা বিষয়ক প্রভৃতি।

(৫) বিশ্বজননীতাগত : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনী গুলোর মধ্যে এক ধরনের বিশ্ব জননীতা রয়েছে। বিশ্ব সৃষ্টিগত ধারণা, মহাপ্লবনগত বর্ণনা, দেবদেবীর সৃষ্টিকর্তর ধারা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনী গুলোর মধ্যে বর্ণনার মিল লক্ষ্য করা যায়।

(৬) মৌখিক ঐতিহ্যানুসারে : পৌরাণিক কাহিনীগুলির সম্পূর্ণভাবে মৌখিক ঐতিহ্যানুসারী। বর্ণমালা সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই মৌখিকভাবে পৌরাণিক কাহিনী গুলো প্রচলিত হয়ে আসছে। মিশে জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনীগুলি মানব সভ্যতার উদ্ভবের পূর্বের ও পরের ঐশ্বরিক জগতে সংঘটিত নানা কাল্পনিক ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে।

(৭) উৎসগত : বিশ্বের অধিকাংশ পৌরাণিক কাহিনী গুলির উৎসের সন্ধান মিলে মহাকাব্য গুলিতে। এমন নিষ্ঠুর পাঁচটি প্রাচীনতম মহাকাব্য হলো গিলগামেশ, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড ও ওডিসি। যদিও মহাকাব্য গুলির বাইরেও পৌরাণিক কাহিনীর সন্ধান মিলে।

(৩) রিয়ারলেইন মত

জে. এফ. রিয়ারলেইন তার ‘Parallel Myths’ গ্রন্থে পৌরাণিক কাহিনী ছয়টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন যথা –

(১) উত্তরাধিকারগ‌ত : রিয়ারলেইনের ধারায় পৌড়ানিক কাহিনী গুলোর সুপ্রাচীন অতীত কাল থেকে উত্তরাধিকার সূত্র মেনে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রচলিত হয়ে আসছে।

(২) প্রাগৈতিহাসিক বিবরণগত : ঐতিহাসিক যুগে রচনা ঘটার আগে কাহিনী গুলো পৌরাণিক ইতিহাসের স্থান পায়।

(৩) ভাষার বৈশিষ্ট্যতা : অতঈন্দ্রইয় ভালো কি জগতে দেব-দেবীর কাহিনী গুলি পৌরাণিক কাহিনীতে স্থান পায়, যেগুলি আমাদের উপলব্ধির বাইরে। বিশিষ্ট মানুষদের পরিশীলিত ভাষা পৌরাণিক কাহিনীতে আমাদের কাছে বোধগম্য করে তোলে। এতে

(৪) পরিচয়ের মাধ্যম : কোন সমাজ বা সম্প্রদায়ের অতীত পরিচয় জানা যায় পৌরাণিক কাহিনীগুলির মাধ্যমে।

(৫) সামাজিক বিধিনিয়মের স্বীকৃতি : প্রচলিত ধর্ম ও সামাজিক বিধি নিয়মগুলি স্বীকৃতি পায় পৌরাণিক কাহিনীগুলির সুবাদে।

(৬) জীবনের অর্থবহতা : পৌরাণিক কাহিনী বা ঘটনাগুলি এক ধরনের বিশ্বাস বা জীবন বোধের পরিচায়ক, যা থেকে জীবনের অর্থবহতা খুঁজে পাওয়া যায়।

ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনীর পার্থক্য সমূহ

ইতিহাস

(১) সংজ্ঞা : অতীত দিনের কোন ঘটনার নিরপেক্ষ, সঠিক, তথ্যপূর্ণ, কালানুক্রমিক ধারাবাহিক বিবরণী হলো ইতিহাস।

(২) চরিত্রসমূহ : মানুষ হলো এর মূল চরিত্র। ইতিহাস মানবিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত। এর মূল চরিত্রটি মানুষের বাস্তব ধর্মী সত্য ঘটনার রূপকার। অন্যান্য চরিত্রগুলি বাস্তব ধর্মীয় হয়ে থাকে।

(৩) বিষয় : এর বিষয় হলো দেশ ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ মানব জীবন বা মানব সমাজের কাহিনী। ইতিহাসের বিষয় হিসেবে স্থান পায় মানব সমাজ, সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের উত্থানপতনের কাহিনী। এছাড়াও ইতিহাসের বিষয় হিসেবে রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান স্থান পায়।

(৪) কালপঞ্জি : ইতিহাসের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কালপঞ্জি। এতে বর্তমানে সময় নিরিখে অতীত ঘটনাবলীর সাল ভিত্তিক ধারাবাহিক বর্ণনা থাকে।

(৫) প্রকৃতি : প্রকৃতিগত বিচারে এর কাহিনী বা ঘটনাবলী বাস্তবধর্মী। অতীত মানব সমাজে নানা গুরুত্বপূর্ণ সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, কর্মকাণ্ডে প্রভৃতি এঁকে ঐতিহাসিক চরিত্র দান করে।

পৌরাণিক কাহিনী

(১) সংজ্ঞা : সৃষ্টির আদিকালের অপরিণত বুদ্ধির মানুষ যে সমস্ত ধর্মীয় অলৌকিক কল্পকাহিনী রচনা ও প্রচার করে, তাকে পৌরাণিক কাহিনী বলে।

(২) চরিত্র সমূহ : অলৌকিক দেবদেবীরা এর মূল চরিত্র। এর কাহিনীর মূল চরিত্র ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপরে আরোপিত। এর মূল চরিত্রটি ঈশ্বরের অলৌকিক লীলা কাহিনী রূপকার। অন্যান্য চরিত্রগুলি ও অলৌকিক বা কাল্পনিক হয়ে থাকে।

(৩) বিষয় : ধর্মভিত্তিক নানা বিষয়ে এতে স্থান পায়। বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য, দেবতা মানবের জন্ম, মহাপ্লাবন, দেবতা-দানব-মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা-পুনর্জন্ম-অবতার, স্বর্গ-নরক-পাপ-পূর্ণ সমস্ত কিছুই হলো এর বিষয়।

(৪) কালপঞ্জি : এতে প্রক্ষীপ্তভাবে বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনার সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে সময়ে নিরিখে এতে পৌরাণিক গল্পকাহিনীর সালভিত্তিক ধারাবাহিক বর্ণনা থাকে না।

(৫) প্রকৃতি : প্রকৃতিগত বিচার এগুলি মূলত ধর্মভিত্ত। এর কাহিনীগুলির মধ্যে অতীত দিনের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার-রীতিনীতি, পূজা-পার্থনা, ধর্মোৎসব-উপাচার প্রবৃদ্ধি এঁকে পৌরাণিক চিত্র দান করে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment