সূচনা : ঐতিহাসিক ই. এইচ. কারের ধারণা ইতিহাস থেকে যে সমস্ত সাধারণ সূত্র গড়ে ওঠে সেগুলি মানুষের খুব কাজে লাগে। আসলে ইতিহাস মানুষের অতীতকে জানতে সাহায্য করে। তাই বলা হয় ইতিহাস হল মানব জাতির অতীত কর্মকান্ডের কালানুক্রমিক ও ধারাবাহিক লিখিত বিবরণ। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকিডিডিস ইতিহাসের গুরুত্ব প্রসঙ্গে, অতীতকালে চা ঘটেছে তার সঠিক জ্ঞান ভবিষ্যতে প্রয়োজনে আসবে, কারোর মানুষের কর্মখান্ডের সম্ভাব্যতার নিরিখে ভবিষ্যতেও একই ধরনের ঘটনা পুনরায় সংঘটিত হবে।
ইতিহাসের গুরুত্ব
১. ঐতিহাসিকদের মত
ঐতিহাসিকদের এডওয়ার্ড হ্যালেট কার (ই. এইচ. কার) মনে করেন ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। আর. জি. কলিংউড-এর ধারণা ইতিহাসের সর্বপ্রধান গুরুত্ব হল যে আমাদের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। শিশেরও লিখেছেন জন্মের আগে পৃথিবী কেমন ছিল তা জানতে হলে ইতিহাস পাঠ অপরিহার্য, তা না হলে মানুষকে চিরকাল শিশু হয়ে থাকতে হবে। ফ্রান্সিস বেকন এর ধারণায় ঐতিহাসিকরা ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে মানুষকে জ্ঞানী করে তোলেন।
২. গুরুত্ব
পেশাদারী শাখা হিসেবে ইতিহাসের বেশ কিছু গুরুত্ব রয়েছে-
(১) অতীতের ধারণাদানে : আর. জি. কলিংউড তার দা আইডিয়া অফ হিস্ট্রি গ্রন্থে লিখেছেন ঐতিহাসিকের মস্তিষ্ক থেকে অতীতে যে ছবি বেরিয়ে আসে তা হলো ইতিহাস। ঐতিহাসিক তার মনের আয়নায় অতীতকে দেখেন এবং তা প্রকাশ করেন। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব, মানুষের সভ্য দশা, বন্যদশা, সভ্যতার উদয় ও অগ্রগতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্ম নীতি সমস্ত কিছুর ধারণা দেয় ইতিহাস। আসলে বিভিন্ন সভ্যতার ক্রমবিকাশ, বিশ্বের বিভিন্ন জাতির উত্থান পতন, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনায়কদের কর্মকান্ড, সংস্কৃতির বিবর্তন, রাজনৈতিক বৈচিত্র, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, ধর্মীয় রূপরেখা এর সমস্ত কিছুর বিবরণ আমরা ইতিহাসে খুঁজে পাই। তাই অঁরি পারেন বলেছেন, “ইতিহাস মানুষের অতীত জীবনের গবেষণা ও অনুসন্ধান বিষয়ক একটি অনুষঙ্গ।” জে. বি. বিউরি এবং লিওপোল্ড ভন রাঙ্কের মতো ঐতিহাসিকগণ তাই বলেছেন- “ঐতিহাসিকের কাজ হলো শুধুমাত্র অতীত পূর্ণ গঠন করা এবং অতীত ঘটনাগুলোকে পরিবর্তন বা বিক্রি না করে উপস্থাপিত করা।
(২) জ্ঞানের সুষম বিকাশে : ইতিহাসের সঙ্গে অনেকগুলি বিষয় সংশ্লিষ্ট থাকায় তা হয়ে উঠেছে এক বিশাল জন ভান্ডার। ইতিহাসের সঙ্গে পুরা তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, দর্শন, ভূগোল, বিজ্ঞান, সাহিত্য ভাষাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতির প্রভৃতির সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাস পাঠের দ্বারা এই সমস্ত বিষয়গুলি বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ও সাধারণ ধারণা লাভ করা যায়। জ্ঞানের একটি শাখা রূপে ইতিহাস জ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জ্ঞানের ভান্ডারে পরিণত হয়।
ইতিহাসে আমরা খুঁজে পাই পুরা তাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নির্দেশ সমূহ, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভৌগলিক অবস্থান, সাহিত্যিক বিবর্তন, ভাষার বৈচিত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনো বিজ্ঞানের তত্ত্ব, সমাজ বিজ্ঞানের মানব ক্রিয়া এবং অর্থনীতির নানা রূপ। এছাড়াও মানব বিবর্তন, সভ্যতার উত্থান পতন, সাম্রাজ্যের উত্থান পতন, সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সংস্কার কাজ, মহাপুরুষদের উদ্যোগ, বিদ্রোহ, বিপ্লব, আন্দোলন প্রগতি সম্পর্কে ও জ্ঞানলাভ করা যায় ইতিহাস থেকে। আর. জি. কলিংউড তার ‘The Idea of History ‘ গ্রন্থে লিখেছেন, ইতিহাসে সর্বপ্রধান গুরুত্ব হল তা আমাদের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
(৩) ঘটনা ধারাবাহিকতার অনুধাবনে : শুভ্রাচী নদীর থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনা বা কাহিনী ধারাবাহিকভাবে ভুল ধরে ইতিহাস। আধুনিক ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসের যে ধারাবাহিকতা ও প্রগতির ধারণার ওপরে অধিক জোড় দেওয়া হয়। ইতিহাসের এই নতুন ধারণাই বলা হয় মানুষ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছে। তুর্গো, কনডারসেট প্রমুখ ধারনা ইতিহাস অনুন্নত থেকে ধীরে ধীরে উন্নত সভ্যতায় গিয়ে পৌঁছয়। ঐতিহাসিক জীবন বলেন প্রত্যেক যুগেই মানুষের সম্পদ, শক্তি, জ্ঞান বাড়ছে। ইতিহাস এই সমস্ত কিছুকেই ধারাবাহিক ভাবে বর্ণনা করে থাকে।
প্রাগৈতিহাসিক পর্ব থেকে শুরু করে প্রাগৈতিহাসিক পর্ব থেকে শুরু করে প্রায় ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক পর্বের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি ইতিহাসের ধারাবাহিক ভাবে উঠে আসে। ইতিহাস প্রাচীন যুগের নির্দেশগুলি মধ্যযুগ এবং মধ্যযুগের নির্দেশগুলি আধুনিক যুগের মানুষের কাছে উপস্থাপন করে। ইতিহাস পাঠের দ্বারা বর্তমান প্রজন্ম অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা যুগের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন ঘটনাগুলি সম্যক ধারণা লাভ করে। তাই এডমন্ড বার্ক বলেছেন- “ইতিহাস সদা প্রবাহমান, বহমান নদীর মত, থেমে থাকে না।
(৪) বর্তমানের মধ্যে সম্পর্কস্থাপনে : ইতিহাস অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ করে। তাই ঐতিহাসিক এডওয়ার্ল্ড হ্যালেট কার বলেছেন, “ইতিহাস ও বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তহীন সংলাপ।” ঐতিহাসিক কার আরো বলেছেন, বর্তমান যেমন অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। তেমনি অতীত কেউ দেখা হয় বর্তমানের আলোকে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস অতীত ও বর্তমানে মধ্যে দেওয়া নেওয়া চলতে থাকে। অর্থাৎ ইতিহাস শুধু অতীতকে নয় অতীতের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্ক যুক্ত করি ইতিহাসের মূল সত্যকে বুঝতে সাহায্য করে থাকে।
অতীতের বহু জিনিস আজও নতুন রূপে, নতুন আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়ে চলেছে, এই সত্য আমরা ইতিহাস পাঠের দাঁড়ায় জানতে পারি। বলা যায় ইতিহাস অতীতের কঙ্কাল নয়, সমাধারে পাঁচ হাজার বছর ধরে বন্ধ করে মেমোরির মতো রেখে দেওয়া বিষয় নয়, তাহলে অতীত থেকে বর্তমানের দিকে এগিয়ে চলার বিষয়। তাই ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও তথ্যের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া অতীত বর্তমানে পারস্পরিক সম্পর্ককে নিবিড় করে।
(৫) বর্তমানে ভিত্তি নির্মাণ : অতীতের ভীতের ওপর বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে। এই বর্তমান কে জানা ও বোঝার জন্য অতীতের ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে। আসলে ঐতিহাসিক বর্তমানে চোখে অতীতকে দেখে থাকেন। তিনি বর্তমানে চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা অতীতের ওপর প্রয়োগ করে থাকেন। ফলশ্রুতি হিসেবে অতীত বর্তমান রূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় তথ্যের দ্বারা ঐতিহাসিক অনুসন্ধান কালে বর্তমানে প্রভাবে প্রভাবিত হন। ফলে ঐতিহাসিকদের সত্য বর্তমানে সত্য হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস অতীত এর বিবরণ দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমানকে জানার ও সুযোগ করে দেয়। বর্তমানে দেশ ও জাতিকে এবং তার ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
(৬) আর্থ-সংস্কৃতির উন্নতির ধারণায় : ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলাতে বিগত বিভিন্ন যুগের ও সময়কালে অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতির অবস্থার ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক অর্থনীতি কিভাবে শিল্প বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হল তা জানা যা ইতিহাস থেকে। এছাড়াও কোন ধরনের অর্থনীতি মানুষ ও রাষ্ট্রের পক্ষে কল্যাণকর বা কোন ধরনের অর্থনীতি দ্বারা একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সে সম্পর্কে ধারণা দেয় ইতিহাস। এছাড়াও সংস্কৃতি অগ্রগতি বা বিবর্তনের ধারা বোঝা যায় ইতিহাস থেকে। আসলেও অতীতের সংস্কৃতির ওপরে একটি দেশ বা জাতির বর্তমান সংস্কৃতি নির্ভরশীল। অতীত সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে সংস্কৃতিকে অনুধাবনের জন্য ইতিহাসের গুরুত্ব রয়েছে।
(৭) সঠিক সত্য নিরূপণে : সভ্যতায় মানুষের অবদানে বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরতে গিয়ে ইতিহাস সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যকে অধিক গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত করে। অপরদিকে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলিকে যতটা বেশি সম্ভব বাদ দিয়ে চলার চেষ্টা করে। আজকে যে বিষয়টি ইতিহাসের সঠিক বলে মনে হয় ইতিহাসের আগামী দিনে নতুন নতুন তথ্য প্রমাণ আবিষ্কারের ফলে সেগুলিকে আরো সঠিক বলে মনে নাও হতে পারে। নতুন নতুন সঠিক তৈরী ধরা প্রচলিত তথ্যকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং বর্জন করে নতুন সর্বজন গ্রাহ সঠিক তথ্য উপস্থাপন করে ইতিহাস। ফলে ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমরা সহজে সঠিক সত্যটি নিরূপণ করতে পারি।
(৮) জাতীয়তাবাদের ও দেশপ্রেমের বিকাশে : ইতিহাসে নিজে নিজে জাতির অতীতে গৌরব গাঁথা উল্লেখিত ও লিপিবদ্ধ থাকে বলে এর মাধ্যমে জাতীয়তা বোধ দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে। নিজে নিজে নাগরিকরা তাদের নিজেদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র দর্শন প্রভৃতি জানার ফলে নিজ দেশ ও জাতির প্রতি গরিমা অনুভব করে। নিজ দেশের বীরগাথা ও গৌরবময় কার্যাবলী বর্ণনার পাশাপাশি নিজ দেশের প্রতি বিদেশীদের শোষণ ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে ইতিহাস জনগণকে জাতীয়তা বোধ উদ্বুদ্ধ করে ও দেশপ্রেম জাগ্রত করে। ইতিহাস থেকে বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদের আন্দোলন সরূপ উমোচিত হয়।
গ্রিক হেরোডোটাস তার ঐতিহাসিক ইতিহাস গ্রন্থে (ইতিবৃত্ত) মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন -“গ্রীকদের দেশপ্রেম, জাতীয় দৃঢ়তা, জাতীয় ঐকোর কাছে পরাশক্তি পারস্য সম্রাটের পরাজয় ইতিহাসে পরবর্তী প্রজন্মকে জাতীয়তা বোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। রোমের জাতীয় ঐতিহাসিক লিভি লিখিয়েছেন “ইতিহাস পাঠে তুমি নিজের ও নিজ দেশের আদর্শ বা অমঙ্গল এর পূর্বভাস উভয় পেতে পারো।” স্পেনের বিরুদ্ধে ওলন্দাজদের স্বাধীনতা আন্দোলন, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম প্রভৃতি সম্পর্কে ইতিহাস থেকে জ্ঞান লাভ করি।
উপসংহার
মানব সভ্যতায় বিকাশে ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মানব সমাজের ধারাবাহিক বিবর্তন, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভের জন্য ইতিহাস পাঠ অত্যন্ত জরুরি। এজন্য উইনস্টন চার্চিল বলেছেন যে, “তুমি সুদূর অতীতে ফিরে তাকাতে পারলে সুদূর ভবিষ্যতেও তাকাতে পারবে।”