অনেকে পূর্বরাগ এবং অনুরাগকে সমার্থকবাচক ভেবে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু পুর্বরাগ ও আনুরাগ এক নয়। ‘রস কলিকা’ গ্রন্থে নন্দকিশোর দাস পূর্বরাগ ও অনুরাগের পার্থক্যকে সুন্দরভাবে উপস্থিত করেছেন।
“সঙ্গ নহ রাগ জন্মে কহি পূর্বরাগ।
সঙ্গ পরে রাগ যেই সেই অনুরাগ।”
পূর্বরাগ বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের অন্তর্গত। শ্রীরূপ গোস্বামী ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে পূর্বরাগের সংজ্ঞায় জানিয়েছেন-
“রতির্যা সংগমাৎ পূর্বং দর্শনশ্রবণাদিজা।
তয়োরুম্মীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগ স উচ্যতে।।”
অর্থাৎ নায়ক-নায়িকার পারস্পরিক সঙ্গম বা মিলনের পূর্বে দর্শন, শ্রবণ প্রভৃতি থেকে জাত মিলনেচ্ছাময় রতি যখন উপযুক্ত অনুভবের দ্বারা পুষ্ট হয়ে প্রকাশিত হয় তখন তাকে পূর্বরাগ বলে। নায়ক এবং নায়িকার মনে পূর্বরাগের উৎপত্তি ঘটে দর্শন এবং শ্রবণের ফলে।
দর্শনজাত পূর্বরাগকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়—১) চিত্রপটে দর্শন, ২) স্বপ্নে দর্শন, ৩) প্রত্যক্ষ দর্শন বা সাক্ষাৎদর্শন।
শ্রবণজাত পূর্বরাগের পাঁচটি ভাগ আছে, যথা—১) দূতীমুখে শ্রবণ ২) সখীমুখে শ্রবণ ৩) ভাট মুখে শ্রবণ ৪) বংশীধ্বনি শ্রবণ ৫) নায়ক কর্তৃক শ্রবণ৷ “পদাবলীতে ভাট মুখে গায়কের বর্ণনা শুনে পূর্বরাগের বিবরণ দেখা যায় না।” একথা বিমানবিহারী মজুমদার বলেন।
পক্ষাস্তরে ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে শ্রীরূপ গোস্বামী অনুরাগ এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে—
“সদানুভূতন্মপি যঃ কুর্যান্নবনবং প্রিয়ম্।
রাগৌ ভবন্নবনবঃ সোহনুরাগ ইত্যর্থতে।।”
অর্থাৎ যে রাগ নিত্য নবায়মান হয়ে সদা অনুভূত প্রিয়জনকে নূতন নূতন ভাবে অনুভবের মাধ্যমে প্রেমকে প্রতি মুহূর্তে নবীনতা দান করে তাকেই অনুরাগ বলে। এ হল—
“নবরে নব নিতুই নব,
যখনি হেরি তখনি নব।”
আসলে এখানে প্রেম প্রতি মুহূর্তে নূতনতর আনন্দনুভূতি নিয়ে হাজির হয়। আমরা রবীন্দ্রনাথের সুরে প্রেমের নিত্যনবায়মানতা প্রসঙ্গে বলতে পারি—
“আমার যদি বেলা যায় গো বয়ে জেনো জেনো।
আমার মন রয়েছে তোমার লয়ে।।
পথের ধারে আসন পাতি, তোমায় দেবার মালা গাঁথি—
জেনো জেনো তাইতো আছি মগন হয়ে।।”
এক্ষেত্রে প্রিয়তমকে দেখার তৃপ্তি কখনো মেটেনা তাই প্রেম প্রতি মুহূর্তে সজীব হয়ে ওঠে। বৈব শাস্ত্রকারেরা অনুরাগের চারটি লক্ষণের কথা বলেছেন—
- ১। পরস্পরধর্মী ভাব
- ২। প্রেমবৈচিত্র্য
- ৩। অপ্রাণীতে জন্মলাভের উৎকট বাসনা
- ৪। বিপ্রলম্ভ (অর্থাৎ চরম বিরহ অবস্থায় কৃষ্ণানুভব)।
পূর্বরাগ পর্যায়ের পদ রচনায় একাধিক বৈব কবি সাফল্য অর্জন করেছেন। বিদ্যাপতি শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগের চিত্রাঙ্কনে সকলকে ছাপিয়ে গেছেন সত্য কিন্তু বৈঘ্নব সাহিত্যে পূর্বরাগময়ী শ্রীরাধিকার ভাবতন্ময় চিত্র রূপাঙ্কনে চণ্ডীদাস অদ্বিতীয়। এখানে রাধিকা অধ্যাত্ম প্রেমের তপস্বিনী, তাই কৃষ্ণনাম শুনেই তাঁর হৃদয় আকুলিত হয়—
সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।।”
এইকৃষ্ণ নামের মোহ কিছুতেই রাধিকা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। তাঁর বদনে সদাই কৃথ্বনাম লেগে আছে এবং আস্তে আস্তে তাঁর দেহ-মন অবশ হয়ে পড়েছে।
পদটির পরবর্তী অংশে কৃতনুস্পর্শ করার জন্য রাধিকার মানস ইচ্ছা লক্ষণীয়—
“নাম পরতাপে যার ঐছন করলগো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়।”
চণ্ডীদাস যে শুধুমাত্র অধ্যাত্মরসের কবি নন, তিনি যে প্রেম মনস্তত্ত্বের রূপদক্ষ শিল্পী তার নির্দশ আছে পরবর্তী অংশে—
“পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়।”
এখানে চণ্ডীদাস চিরকালের প্রেমিক-প্রেমিকাদের গোপন কথাটি জানিয়ে দিয়েছেন ‘রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা’ পদটির মধ্যে রাধিকার যোগিনী বা প্রেম তপস্বিনী রূপটি খুঁজে পাওয়া যায়—
“সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ পান
নাচলে নয়ান তারা
বিরতি আহারে রাঙ্গা বাস পরে
যেমত যোগিনী পারা।”
অনুরাগের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে প্রেমবৈচিত্র্য পর্যায়ের পদেও। প্রেম বৈচিত্র্যের স্বাভাবিক লক্ষণ প্রিয়কে সম্পূর্ণ করে পাওয়া। সাময়িক পাওয়ার মধ্যে কোনও তৃপ্তি নেই। পূর্ণরূপে পাওয়ার জন্যেই রাধার আগ্রহ না পাওয়াতেই অতৃপ্তি, তাই জ্ঞানদাসের রাধা বলেন—
“রূপলাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।”
প্রেমবৈচিত্র্যের অপর একটি বৈশিষ্ট্য সবকিছুর উদ্দেশ্যে রাধার অনুরাগ আক্ষেপ কম নয়—‘মরমক দুখ কহিতে হয় লাজ’ নিজেকেই নিজের দোষের জন্য ধিক্কার দেন। রাধার প্রেম তার আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে ঘর বেঁধে ছিলেন—
“সুখের লাগিয়া এঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।”
এ পদটি চণ্ডীদাসের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়—
“বঁধু, তোমর গরবে গরবিনী আমি
রূপসী তোমার রূপে।
হেন মনে করি ওদুটি চরণ
সদা লইয়া রাখি বুকে।।”
চণ্ডীদাস যে ভাষায় শ্রীরাধিকার আক্ষেপ-অভিমান ব্যক্ত করেছেন তাতে একদিকে যেমন বাঙ্গালীর ঘরোয়া ভাব আছে তেমনি অন্যদিকে সার্বজনীন আবেদন আছে। একদিকে যেমন রাধা আমাদেরই গ্রামের, আমাদেরই পাড়ার রাধা তেমন অন্যদিকে যুগযুগান্তরের দেশদেশান্তরের রাধা। অতএব এখানেই বৈশ্বব সাহিত্যের পূর্বরাগ ও অনুরাগের উপস্থাপনা সার্থক হয়েছে।