পরমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ বর্ণনা করো?

ভূমিকা

বর্তমানে বিষে পারমাণবিক অস্ত্র মানব জীবন ও মানব সভ্যতাকে নিমিষে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সুবাদে হাইড্রোজেন বোমার বর্ষণ মারণাস্ত্র বিশ্বের অস্তিত্বকে যেকোনো সময় বিনাশ করতে পারে। তাই বিশ্ব সভ্যতার অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য পরমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া জরুরী। এই স্মরণ সত্য অনুধাবন করে তাই আধুনা শান্তি প্রতিষ্ঠার একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে।

পরমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ

১. প্রেক্ষাপট

পারমাণবিক অষ্ট প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার অনেক আগেই নিরস্থীয়করণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্বক ৫৩৪ অদ্বে চীনের হোন্যান প্রদেশে বিরোধী লুপ্ত রাজ্যগুলির মধ্যে অস্ত্র সংবরণ প্রচেষ্টা নিদর্শন মিলে। মধ্যযুগ ইউরোপীয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংস শিলার পর নিরস্তীয়করণে প্রশ্নটি সবিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের পাঁচটি প্রধান নৌ শক্তিধর রাষ্ট্র এক শক্তিতে আবদ্ধ হয়ে নৌক্তির প্রতিযোগিতা হ্রাসের সম্মত হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুন বিশ্বের ৩৬ টি দেশে জেনেভা প্রটোকলে স্বাক্ষর করে যুদ্ধের বিষাক্ত গ্যাস, রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের ব্যবহারে নিষিদ্ধ করতে সম্মত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনী যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমায় হাজার ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ আগস্ট ও নাগাসাকিতে ৯ আগস্ট আণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে সার্বিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয়।

২. পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা

(১) সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধরত শক্তিশালী কয়েকটি দেশ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আবিষ্কৃত সূত্র প্রয়োগ করে কে কার আগে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে সে বিষয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোট ও মার্কিনী নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোটের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হলে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। আমেরিকা উপলব্ধি করেছে যে জার্মানি হিটলার যদি সবার আগে বোমা তৈরি কাজে সফল হন তবে তার পরিণতি হবে মারাত্মক।

যাইহোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থব্যায়ে যে, ‘ম্যানহাটার প্রকল্পের’ কর্মসূচি গ্রহণ করে যার অন্তর্গত ছিল হাইড্রোজেন বোমা, শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী বোমারু বিমান, অন্তর মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, অনাবিক ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধজাহাজ, আণবিক বোমা বাহিনী সাবমেরিন এবং নক্ষত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা। এর ফলে আমেরিকান ১৯ খ্রিস্টাব্দে ১ আগস্ট পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায়। আমেরিকা এই বোমা সর্বপ্রথম হিরোশিমায় বর্ষণ করে।

(২) পরমানবিক অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফলে পরমানবিক যুদ্ধ অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ও দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি অন্তর মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত একসঙ্গে বিভিন্ন বহনের ক্ষমতা রাখে। এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবেগ টি.এন.টি. ক্ষমতাযুক্ত। এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবেগ ঘন্টা ১১ হাজার কিলোমিটার এবং এর নির্দিষ্ট নিশানয় আঘাত হান্তে সময় লাগে মাত্র ৩০ মিনিট। এর থেকে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র হলো পার্শিং দুই এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যেগুলি মাত্র চার থেকে ছয় মিনিটের মধ্যে দৃষ্টি নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম। হিরোশিমাতে এই বোমা বিস্ফোরণের ফলে প্রায় ৫০,০০০ বাড়িঘর ধ্বংস হয় এবং প্রায় ৭৫, ০০০ মানুষ নিহত হয়।

(৩) স্বরূপ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে প্রথম দিকে আমেরিকার কাছে এমন শক্তি সম্পন্ন বোমারু বিমান ছিল যেগুলি একটানা উড়ে গিয়ে সোবিয়েড ইউনিয়নে বোমা বর্ষণ করে পুনরায় ফিরে আসার ক্ষমতা রাখে। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে এ ধরনের বিমান না থাকায় তারা অন্তর মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং সফল হয়। সোভিয়েতের এই সফলতায় শঙ্কিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্তবর্তী দূরত্বের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে।

(৪) প্রতিযোগিতা তত্ত্ব : সময় এগুলো সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েদ ও মার্কিন উভয় তরফেই পরমানবিক বোমা ক্ষেপানাস্ত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর ফলে এমন এক পরিচিতি উদ্ভব ঘটে যাতে পরমানবিক যুদ্ধে বিশ্বের ধ্বংস সাধনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই ধ্বংস প্রক্রিয়া MAD তত্ত্ব নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে সমিত ও মার্কিন একে অপরকে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম আঘাত হানায় ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করার নীতি নেই। এই নীতির নাম Policy of Nuclear Deterrence । পরমাণুর বস্ত্র প্রতিযোগিতার অগ্রগতিকালে শক্তি সাম্য ত্রাসের সাম্য নামে পরিচিত লাভ করে।

৩. শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ : বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মাঝামাঝি সময়কাল থেকে পরমাণুবি বস্ত্র প্রতিযোগিতা থামিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন তরফ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হয়। এক্ষেত্রে সোভিয়ে ত ও মার্কিন উভয় তরফে উদ্যোগের পাশাপাশি জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

(১) অনাবিক শক্তি কমিশন গঠন : ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার প্রস্তাব অনুসরণ একটি পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন অনাবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনার সিদ্ধান্ত নেয়।

(২) জেনেভা নিরস্ত্রীয়করণ সম্মেলন : রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে জেনেভাতে এক নিরস্তীয়করণ সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনের নিরস্থীয়করণের বিষয়টি তাদের জন্য দশটি সদস্য রাষ্ট্রকে নিয়ে এক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি নিরস্তীয়করণে লক্ষ্যে সদর্থক আলোচনার প্রস্তাব রাখে।

(৩) পরবর্তী সম্মেলন সমূহ : রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে, তারপর ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে আরবিক অস্ত্র রোধের লক্ষ্য একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের সোভিয়েদ ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে মহাকাশে ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

(৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ : (i) বারুচ পরিকল্পনা : মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি দাতা কূটনীতিবিদ বার্নার্ড বারুচকে পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি মনোনীত করেন। বারুচ নিরস্তীয়করণ সম্পর্কিত এক পরিকল্পনা কমিশন পেশ করেন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ জুন যা বারুচ পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এর দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা IADA গঠন করে পরমানবিক শক্তির উৎস গুলি সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলা হয়। এই পরিকল্পনায় পরমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের ব্যাপারে এক পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়।

এছাড়াও এই পরিকল্পনা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি আণবিক অস্ত্র ভান্ডার পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় নিরাপত্তা পরিষদের ওপর। (ii) আইজেন হাওয়ার পরিকল্পনা : মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেন হাওয়ার পরমাণুবিক দ্রব্যের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের লোকের রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক ঘাঁটিগুলোর আলোকচিত্র ব্লু প্রিন্ট বিনিময়ের উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এক আন্তর্জাতিক শক্তি কমিশন গঠনের কথা বলেন।

(৫) সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগ : সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই জুন গ্রোমিকো পরিকল্পনা নামে এক প্রস্তাব পেশ করা হয়। (i) সাধারণ সভায় নিরস্তীয়করণে প্রস্তাব পেশ : ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের সোভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণ সভার নিরক্ষীয়করণ কমিশনের উপ-সমিতির কাছে এর প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাবে বিভিন্ন দেশের সামরিক খাতের খরচে পরিমাণ কমানোর কথা বলা হয়। (ii) সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান উদ্যোগ : নিকিতা ক্রোশ্চভ, লিওনিদ ব্রেজনেভ, মিখাইল গরবাচভ প্রমুখ সোভিয়েত রাষ্ট্রপতিগণ পরমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাসের লক্ষ্যে সচেষ্ট হন। ক্রুশ্চেভ জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভার সর্বনাত্মক নিরস্তীয়করণের প্রস্তাব তোলেন।

ব্রেজনেভ কৌশল গত পরমাণু অস্ত্র সমিতি করনের লক্ষ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান রিচার্ড নিকসনের সঙ্গে মস্কোতে সল্ট ওয়ান চুক্তি ২৬ মেয়ে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে এবং পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রপতি কার্টারের সঙ্গে ভিয়ানায় সল্ট টু ১৮ই জুন ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন। পরবর্তীকালে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিখাইল গরবাচভ মার্কিন রাষ্ট্রপতি জজ বুশের সঙ্গে START- I ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ৩১ জুলাই নামে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই চুক্তিতে সোভিয়ে দাও মার্কিন উভয় রাষ্ট্রের অস্ত্র সম্ভারের অস্ত্র সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। পরবর্তী রুশো প্রজাতন্ত্রে প্রধান বরিস ইয়েৎসিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুসের সঙ্গে START-II যুক্তিসম্পাদন করেন ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারির। এই চুক্তিতে উভয় দেশ নিজেদের পরমাণবিক অস্ত্র ভান্ডার অর্ধেকেরও বেশি নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে সম্মত হয়।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment