‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রিকা সাপেক্ষে জনা চরিত্রটি বর্ণনা করো।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে তাঁর কবি প্রতিভার সামগ্রিক প্রতিফলন বিস্মিত করেছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এই কাব্যের মধ্যে কোমলতা ও কাঠিন্যের সমাবেশে হয়েছে যুগ বিপ্লবী মানবতাবাসের অঙ্কুরোদগম। এখানে নারী নারীর পূর্ণ মর্যাদা পেয়েছে। সমাজরীতির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে শিল্প সৃষ্টির সৌন্দর্য চাতুর্য। নারী মাত্রই এখানে কল্পিত হয়েছে বীরাঙ্গনা রূপে। বীর অর্থে কেবল তেজস্বিনী যোদ্ধা নয়, বীরাঙ্গনা অর্থে প্রধানত বোঝানো হয়েছে ব্যক্তিত্বময়ী নারী। প্রকৃতপক্ষে সে অর্থে বীর বলতে একমাত্র জানাকেই গণ্য করা চলে। একাদশটি নায়িকার মধ্যে যথার্থ ক্ষত্রিয় রমণীর তেজ ও সাহস একমাত্র জনার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তা স্বামীর বিরুদ্ধে সত্য নিষ্ঠ স্ত্রীর সতেজ কণ্ঠস্বর। ফলে সাহসী তেজস্বিনীরূপে জনাকেই যথার্থ বীরাঙ্গনা বলা যায়।

বীরাঙ্গনা কাব্যের এগারোজ অজনার মধ্যে দু’জন মাত্র সতেজ অনুযোগ পত্র লিখেছিলেন। একজন হলেন কেকয়ী, অপরজন জনা। উভয়েরই অনুযোগ পত্রিকার রচনার মূল কারণ স্বামীর অন্যায় ব্যবহার, সত্য ভ্রষ্ট হবার আশংকা যা ক্ষত্রিয় রমণীরূপে তাদের আত্মগ্লানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উভয়ের ক্ষোভের কারণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে তাঁদের পুত্রের প্রতি স্বামীর উদাসীন আচরণ। তার মধ্যে কেকয়ীর রয়েছে পুত্র স্বার্থ রক্ষার বাসনা কিন্তু জনার পুত্রশোক। মেঘনাদবধ কাব্যের প্রমীলার মতো আর এক তেজস্বিনী নায়িকা জনা মধুসূদনের অন্যতম সৃষ্টি। নারীদের কাছে স্বামীর চেয়েও যে সন্তান প্রিয়তর— বুকচেরা ধন—তার প্রমাণ পাওয়া যায় জনা পত্রিকায়।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করার জন্যে যজ্ঞের অশ্ব ছেড়েছিলেন। অর্জুন সেই অশ্বের রক্ষকরূপে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছিলেন। যথাকালে সেই অশ্ব মাহেশ্বরীতে এসে উপস্থিত হলে, মাহেশ্বরী রাজপুত্র প্রবীর সে অশ্ব ধরে ফেললে অর্জুনের সঙ্গে প্রবীরের যুদ্ধ অনিবার্য হয় এবং যুদ্ধে প্রবীর অর্জুনের হাতে নিহত হন। পুত্রের মৃত্যুতে মাহেশ্বর রাজ নীলধ্বজ পুত্র হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে অর্জুনের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন এবং পরম মিত্র হিসেবে তাঁকে নিজ সিংহাসনে বসালেন। অপিচ, নরনারায়ণ জ্ঞানে তাঁকে সেবা যত্ন করতে লাগলেন। একথা রাজমহিষী জনার কাছে গেলে তিনি ক্রুদ্ধা ও ব্যথিতা হয়ে সানুযোগে রাজাকে ভর্ৎসনা করতে শুরু করলেন।

জন্য ক্ষত্রিয় রমণী। তাঁর আচার-আচরণ-বিশ্বাস সমস্তই ক্ষত্রিয় রমণীর মতোই। তাঁর বীরপুত্র প্রবীর, অর্জুনের হাতে সম্মুখ সমরে বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। তাতে তাঁর শোক হলেও গৌরবের হানি হয় নি। কিন্তু যখন সংবাদ পেলেন যে তাঁর স্বামী নীলধ্বজ পুত্র হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে কাপুরুষোচিত্ত আচরণ করে অর্জুনের সঙ্গে সন্ধি করে নিয়েছেন তখনই তার ক্ষত্রিয় রমণীর মর্যাদায় আঘাত লাগল। তিনি স্বামীর এই অক্ষত্রিয় আচরণে ক্রুদ্ধ হয়েও প্রথমে স্ত্রীর কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হলেন। স্বামীর ভ্রান্তি নিরসন করা স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য। জনা তাঁর স্বামী নীলধ্বজের ভ্রান্তি নিরসন করে তাঁকে যথোচিত আচরণ করার জন্যে অনুরোধ করলেন। পত্রের শুরুতেই তাই স্বামীর জ্ঞানোদয় ঘটাতে লিখলেন –

‘“সাজিছ কি, নররাজ, যুঝিতে সদলে—

প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে, 

নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্গুনির লোহে? 

এই তো সাজে তোমারে, ক্ষত্রমণি তুমি

মহাবাহু।”

স্বামীর মনে ক্ষত্রতেজ উদ্দীপ্ত করার জন্যেই জনার প্রাথমিক প্রয়াস সাধিত হয়েছে। রাজার মনে পুত্র হত্যার প্রতিহিংসা জাগিয়ে তুলতে জনা বদ্ধপরিকর। নীলধ্বজের উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তব্য হল, অন্যায় সমরে যে মৃঢ়, বালককে বধ করল হে রাজা তুমি তাকে নাশ কর। তা হলেই ‘ভুলিব এ জ্বালা, এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে।

বীর পুত্র প্রবীর বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। তার জন্যে জনা দুঃখ পেলেও রাজার কাছে সে দুঃখ গোপন করে কেবল ক্ষত্রিয় নারীর মতো তেজোদ্দীপ্ত ভাবে নীলধ্বজকে যুদ্ধে উৎসাহিত করতে চেয়েছেন। জনা জানেন ‘জন্ম মৃত্যু;- বিধাতার এ বিধি জগতে।’ তাই পুত্রের মৃত্যু শোকে তাঁর বিলাপ নেই। তিনি কেবল রাজাকে বলতে চেয়েছেন—

পাল, মহীপাল

ক্ষত্রধর্ম, ক্ষত্রকর্ম সাধ ভুজবলে।

কিন্তু দাসীমুখে যখন জনা শুনতে পেলেন, রাজসভা আনন্দ বিলাসী। সে স্থান নাচে গানে আনন্দে পরিপূর্ণ এবং পুত্রহস্তারক শত্রুর আনন্দ বিধানে রত, তখন আর জনা নিজেকে, নিজের অন্তরের ক্রুদ্ধ জ্বালাকে সামলাতে পারলেন না। একদিকে তার বীরপুত্র প্রবীরের মৃত্যু শোক, অন্যদিকে ক্ষত্রিয় স্বামীর অক্ষত্রিয় আচরণে তাঁর ক্ষত্রিয় নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। স্বামীর সম্বিত ফিরিয়ে আনতে প্রথমে কাপুরুষোচিত আচরণের জন্যে ভর্ৎসনা করলেন। তাতে যখন কাজ হল না, তখন অর্জুনের নিন্দা করলেন। ক্রমে কুন্তী, দ্রৌপদী এমনকি বেদব্যাসের নামেও কুৎসা রটনা করে স্বামীকে ফেরাতে চেষ্টা করলেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছেন পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে।

জিনা তার স্বামীর কর্তব্য চেতনা আনতে চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। ধৈে সঙ্গে নীলধ্বজকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন—পুত্র হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে শত্রুকে মিত্র জ্ঞানে যে নীলধ্বজ সেবা করছে—

কি কহিবে, কহ,

যবে দেশ-দেশান্তরে জনরব লবে। 

এ কাহিনী,—কি কহিবে ক্ষত্ৰপতি যত?

কিন্তু কিছুতেই যখন জনা নীলধ্বজকে সচেতন করতে পারেন নি, তখনই তাঁর ক্ষত্রতেজ তিনি প্রকাশ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি প্রকৃতই ক্ষত্রনারী। তা বলে স্বামীকে অবমাননা করে তাঁর ক্ষত্র তেজ তিনি প্রদর্শন করেন নি। দীর্ঘকাল ধরে লালিত সংস্কারে তিনিও আচ্ছন্না। তাই স্বামীকে গঞ্জনা দিতে গিয়েও সমাজ ও পরলোকে অধোগতির চিন্তা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেন নি। তবু তাঁর তেজ, তাঁর সাহসিকতা উল্লেখযোগ—

“কিন্তু বৃথা এ গল্পনা। গুরুজন তুমি 

পড়িব বিষয় পাপে গঞ্জিলে তোমারে।

কুলনারী আমি, নাথ, বিধির বিধানে 

পরাধীনা! নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে

এ পোড়া মনের বাঞ্ছা!”

জন্য একজন মাতা, পুত্রহারা মাতা। পুত্র শোকে তার হৃদয় বিদারী শোকোচ্ছ্বাসের পরে স্বামীর প্রতি অভিমানী স্বর ফুটে উঠেছে। তিনি স্বামীর কাছে বিদায় প্রার্থনা করেছেন—’যাচি চিরবিদায় ও পদে’। বিদায় নিয়ে জনা তার পুত্রের উদ্দেশ্যেই যাত্রা করতে চায়। এখানে জনার কোমল হৃদয় বৃত্তির পরিচয় সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। সমগ্র পত্রিকাটির মধ্যে জনার তেজ, সাহস, নারী হৃদয়ের কোমলতা, অপত্যস্নেহ, পতি প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের কর্তব্যাদি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

পুত্রশোক জনার পক্ষে সহনীয় ছিল। কেননা জনা ক্ষত্রিয় রমণী। সম্মুখ সমরে প্রিয়জন বীরগতি প্রাপ্ত হলে তাঁদের মধ্যে দুঃখ শোকের চেয়েও গৌরব বেশি বোধ হয়। কিন্তু জনার পক্ষে অসহনীয় অবস্থা হল তাঁর স্বামীর অক্ষত্রিয় আচরণ। জনার আত্মমর্যাদায় তা আঘাত করে। সে আঘাত জনাকে আত্মহননের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তাই জনা তাঁর স্বামীকে লিখেছেন—

“ক্ষত্ৰকুল বালা আমি; ক্ষত্ৰ-কুল-বধূ 

কেমনে এ অপমান সব ধৈর্য ধরি’?

ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;

দেখিব বিস্মৃতি যদি কৃতান্ত নগরে 

লভি অস্তে।”

প্রকৃতপক্ষে জনার তেজস্বিতা, সাহসিকতা যতই থাকুক মধুসূদন তাঁকে চিরন্তন ভারতীয় নারীরূপেই চিত্রিত করেছেন। তাই জনা চরিত্রের মধ্যে পতিব্রতা সাধ্বী রমণীর মনোভাব লক্ষ্য করা যায় এদেশের মায়ের মতোই তাঁর পুত্র স্নেহে অন্তর পরিপূর্ণ। এ দেশের অন্যান্য নারীর মতো তিনিও হাত পা বাঁধা অবস্থায় সংসারে পড়ে আছেন। না হলে পুত্র হত্যার প্রতিশোধ তিনি নিজেই নিতে পারেন—এই মানসিকতাও তাঁর মধ্যে বর্তমান। সর্বোপরি এত শোক, দুঃখ, আঘাত, অপমান, অমর্যাদা সত্ত্বেও স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি ভারতীয় নারীদের মতোই তাঁর চিত্তে অবিচলিত থেকেছে। তিনি প্রয়োজনে স্বামীকে অবমাননা করেননি কিম্বা কোথাও তাঁকে অতিক্রম করে যান নি। অভিমানবশে তিনি আত্মহত্যা করে প্রাণ বিসর্জনের জন্যে রাজপুরী ত্যাগ করছেন বটে, কিন্তু স্বামীর প্রতি আনুগত্যবশতঃ তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে জনা চরিত্রটি কোমলে কঠিনে মেশা এক আশ্চর্য বিস্ময়কর চরিত্ররূপে মর্যাদা পেয়েছে। তাই সব দিক থেকে বিচার করলে জনাকেই যথার্থ বীরাঙ্গনা বলা যায়।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment