‘নিরুদ্দেশ যাত্রা চিত্র গীতের মেলবন্ধন গঠিত’ -আলোচনা করো।

সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের অস্তিম কবিতা এটি। ১৩০০ বঙ্গাব্দে ২৭৩ অগ্রহায়ণ লেখা। ৮০টি পঙক্তি এবং ৬টি স্তবকে সজ্জিত মাত্রাবৃত্তছন্দে লেখা এই কবিতায় কবি রহস্যময়ী সৌন্দর্যদেবীর আহ্বানে প্রেম সৌন্দর্যের এক অজানা দেশে যাত্রা করেছেন। রহস্যময়ী এই অপরিচিতা ‘মানসসুন্দরী’ কবিকে অজানা ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে চলেছে। কবিও জীবনের সমস্ত লাভালাভের হিসেব ত্যাগ করে চিরন্তন সৌন্দর্যের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন এই সৌন্দর্যলক্ষ্মীর কাছে। এই সৌন্দর্যলক্ষ্মী ‘সোনার তরী’র মাঝি, তাঁর ‘মানস সুন্দরী’ আর ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র রহস্যময়ী অপরিচিতা, ‘চিত্রা’ পর্বের জীবনদেবতা।

কবিতার শুরুতেই হতাশা নৈরাশ্য ও ক্লান্তি বোধের প্রকাশ ঘটেছে—

“আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী, 

বলো কোন পারে ভিড়িবে তোমার সোনার তরী।”

এই রহস্যময়ী নারীমূর্তি কবিকে অজানার উদ্দেশ্যে নিয়ে চলেছে কবি তার সঙ্গলাভের জন্য উন্মুখ। কিন্তু পরের প্রতিটি স্তবকে রহস্যময়ীর নীরব হাসি কবিকে ব্যাকুল করে চলেছে। কবিতার শেষস্তবকে—“কোথা আছ ওগো, করহ পরশ নিকটে আসি।” বলার মধ্যে দিয়ে সমগ্র কবিতাতে প্রবাহিত বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার রসের ভাব সঙ্গতি রক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া কবিতার সময়কাল সন্ধ্যা, ‘অজানা সমুদ্র যাত্রা উদ্বেগ, ‘বিকল হৃদয় বিবশ শরীর, রহসম্যময়ী অপরিচিতার ছলনা পাঠককে এক মায়াঘন করুণ রসের মায়াজালে আবদ্ধ করেছে।

‘সোনারতরী’ কাব্যে ছিল বর্ষার ছবি ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় সমুদ্র যাত্রার সঙ্গে কবিমনের আলোড়ন আন্দোলন যেমন স্পষ্ট করে তেমনি দুর্ত্যেয় অন্বেষণের ইঙ্গিত দেয়। প্রতিটি স্তবকে রয়েছে তাই এই প্রশ্নচিহ্ন

  • ১ম স্তবক : “আর কতদূরে নিয় যাবে মোরে হে সুন্দরী ?” 
  • ২য় স্তবক : “মেঘচুম্বিত অস্তগিরির চরণতলে ?”
  • ৩য় স্তবক : “তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি হাসিছ কেন?”
  • ৪র্থ স্তবক“আশার স্বপন ফলে কি হেথায় সোনার ফলে ?”
  • ৫ম স্তবক“আছে কি শান্তি আছে কি সুপ্তি তিমির তলে ?”

এই জিজ্ঞাসা সূচক বাক্যগুলো একই সঙ্গে রহস্যময় নিরুদ্দেশযাত্রার ইঙ্গিতবাহী যা আস্ত সঙ্গতিপূর্ণ চিত্রমূলক অর্থনির্মাণের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। প্রথম স্তবকেই “অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি” কবির যাত্রাসুরুর উৎকণ্ঠাকে ব্যক্ত করেছে। দ্বিতীয়স্তবকে বিষাদময় ধরণীর চি “ওই যেথা জ্বলে সন্ধার কূলে দিনের চিতা” বা “দিক বধূ যেন ছলছল আঁখি অশ্রুজলে মধ্যে কবির দ্বিধা দ্বন্দ্ব প্রকটিত। তৃতীয় স্তবকে কবি অনুভব করেছেন সংকটময় সমুদ্র যাত্রাকে অচেনা ভবিষ্যতের একটি চিত্র নির্মিত হয়েছে এখানে—“হুহু করে বায়ু ফেলিচে সততা দীর্ঘশ্বাস/অন্ধ আবেগে করে গর্জন জলোচ্ছ্বাস। “এই সংকটময় পথেও আশার আলো নেভেনি। চতুর্থ স্তবকে : চঞল আলো আশার মতন কাঁপিয়ে জলে।” এই পূর্ণেআপমার মধ্যে গীতিকবির মনোভাব অনুপমকাব্যিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। পঞ্চম স্তবকের মেঘরৌদ্রময় ক্ষুব্ধ সাগরে কবি শান্তি খুঁজতে চেয়েছেন। কবির যাত্রা শেষ হয়নি। শেষ নেই যার শেষ কথা কে বলবে?

মাধ্যম লয়ের মাত্রাবৃত্তে রচিত এই কবিতায় ছন্দের দোলায়, কোমল ব্যঞ্জনের মিল বিন্যাসে, অনুপ্রাস উপমা অলংকারের বিচ্ছুরণ অনাবিল ভাবসৌন্দর্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। যা সমগ্র কবিতা জুড়ে প্রবাহিত বিষাদ করুণ সমুদ্র অন্বেষণকে সর্বাত্মক করেছে। একটি নমুনা

  • শুধু ভাসে তব দেহ সৌরভ ৬/৬ 
  • শুধু কানে আসে জলকল রব॥ ৬/৬

অলংকারের বিন্যাসেও এই অপ্রাপ্তি বেদনা বিচ্ছুরিত উপমা : “চঞ্চল আলো আশার মতন কাঁপিছে জলে।”

  • উৎপ্রেক্ষা: দিকবধূ যেন ছলছল আঁখি অশ্রু জলে।
  • সমাসক্তি : হু হু করে বায়ু ফেনিছে সতত দীর্ঘশ্বাস। 
  • অতিসয়োক্তি : ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে দিনের চিতা।

কাব্যসৌন্দর্য সৃষ্টি এই অসীম পথ পার হয়েও কবির যাত্রা শেষ হয় না। ‘কড়ি কোমল’,‌ ‘মানসী’ পেরিয়ে সোনার তরীতে তার ক্ষণিক বিশ্রাম, তার পর সেখান থেকে ‘চিত্রা’, বলাকার পথে নব নব সৃষ্টি লীলার শুরু। অলোচনা সমাপ্তিকালে তাই বলতে হয়—

“Whither, Omy sweet mistress,

must follow thee.”

-Geogiarn poetry

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment