নয়া উপনিবেশবাদ (Neo Colonialism) এর বৈশিষ্ট্য লেখ?

সূচনা : ‘নয়া উপনিবেশবাদ’- এই কথাটি সর্ব প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি ইতিহাসবিদগণ এবং মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকগণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রায় ছয়ের দশক নাগাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নয়া উপনিবেশবাদ কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ৮ এর দশক নাগাদ পুঁজিবাদী দেশগুলির সরকার এবং বহু জাতের সংস্থা (Multinational Corporation) এর আধিপত্যের স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে নয়া উপনিবেশবাদ এক বহুল আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়।

নয়া উপনিবেশবাদ বৈশিষ্ট্য

নয়া উপনিবেশ বাদ আসলে উপনিবেশবাদের নতুন রূপ। তাই অনেক নয়া উপনিবেশবাদ কে ‘নতুন পাত্রে পুরনো পানীয়’ (Old wine in a bottle) নামে অভিহিত করেন। নয়া উপনিবেশবাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো-

১. উপনিবেশহীন

নয়া উপনিবেশবাদে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনে কোন উপনিবেশ থাকে না। তাই অনেকে নয়া উপনিবেশবাদ কে উপনিবেশ হীন সম্রাজ্যবাদ আখ্যা দিয়ে থাকেন। যদি অতীত উপনিবেশ গুলি অর্থনীতি সহ নানা ক্ষেত্র গুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাইরে থেকে তা নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখে কিন্তু অতীতের উপনিবেশ গুলি আপাতভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি থাকে।

২. বাজার অর্থনীতি

নয়া উপনিবেশবাদ একটি মূল বৈশিষ্ট্য হল বাজারের অর্থনীতি। বাজারে অর্থনীতিকে হাতিয়ার করে পুঁজিবাদ বর্তমান বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা কে নিয়ন্ত্রণে উদ্যত। এই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের হাত ধরে বাজারে অর্থনীতি প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজারে অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ হয়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পক্ষে বাজারে অর্থনৈতিক ক্ষতিকর দিকগুলি মোকাবিলা করার সামর্থ্য নেই। তাই বহু জাতি সংস্থাগুলির মাধ্যমে পুঁজিবাদী তৃতীয় বিশ্বের ওপর একাধিপত্য স্থাপন করে।

৩. আনুষ্ঠানিকতাহীন সাম্রাজ্যবাদ

অনেক ধারণাই নয়া উপনিবেশবাদ আনুষ্ঠানিক অধ্যাহীন সম্রাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ এই ব্যবস্থায় সরাসরি সাম্রাজ্য স্থাপন না করে বাইরে থেকে সুখ কৌশলের তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানে সু কৌশল বলতে বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক অনুদান, আধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দানকে বোঝানো হয়েছে। আসলে সময় এখনো সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপনিবেশিক শক্তি গুলি নিজে নিয়ন্ত্রণ কৌশল বদলে চলেছে।।

৪. অর্থনীতি অধীনতা

নয়া উপনিবেশবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো অর্থনৈতিক অভিনেতা। ধনী বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থা গুলি প্রতিদিনের উপনিবেশ গুলি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এগিয়ে আসবে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি মূলত তিনটি উপায়ে বহির বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, যথা – (১) মূলধনের লগ্নি। (২) প্রযুক্তিগত কলা কৌশল সরবরাহ। (৩) পরিচালনা দক্ষতার ধারণা দান। কোন দেশের শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য এই তিনটি উপাদান উপরিহার্য। তাই অনুন্নত দেশ বলে নিজেদের শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে বহুজাতিক সংস্থা গুলির এই দুর্বল অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি শিল্পোন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

৫. সমরগত নিয়ন্ত্রণ

নয়া উপনিবেশবাদের মাধ্যমে সমর্গত ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণগত উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা চালানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো তথাকথিত শক্তিশালী দেশ গুলি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দুর্বল দেশগুলির ওপর এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা চালায়। বিশ্বের শক্তিধর এই দেশগুলি দুর্বল দেশগুলোকে কখনো ও ভয় দেখিয়ে আবার কখনো লোভ দেখিয়ে নিজে নিজে সামরিক জোটের অন্তর্ভুক্ত করা বা তাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নাট্য, সিয়াটো, সেন্টো বা বাগদাদা চুক্তি, অ্যানজাস চুক্তি প্রভৃতি গঠনের মাধ্যমে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি দুর্বল দেশগুলির ওপরে সামরিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশগুলো নিজেদের সমর কৌশলে অঙ্গ রূপে না আমি অনুন্নত দেশগুলিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। এছাড়াও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে অনেক সময় দুর্বল দেশগুলিকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য দিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে সে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেই সরকারকে শেষ পর্যন্ত পুতুল সরকারের পরিণত করে।

৬. আর্থিক শোষণ

নয়া উপনিবেশবাদ পূর্বতন উপনিবেশবাদের অস্তিত্ব না থাকলেও আর্থিক শোষণ গত ভূমিকা বজায় থাকে। নয়া উপনিবেশবাদের তথাকথিত দুর্বল দেশগুলো অর্থ ও সম্পদ আত্মসাৎ করার সুতীব্র বাসনা লক্ষ্য করা যায়। তবে সরাসরি এই অর্থ ও সম্পদ শোষণ করা সম্ভব হয় না। অনন্যা তো দেশগুলিকে আর্থিক ঋণদান করে বিপুল সুদের বোঝা চাপিয়ে এই শোষণ করা হয়। এছাড়াও অনুন্নত দেশগুলোতে উন্নত দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ হল নয়া উপনিবেশবাদী শোষণের আরেকটি মাধ্যম তাই বলা যায় না নয়া উপনিবেশ বাদে রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা অপেক্ষা আর্থিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা বা সুযোগ-সুবিধা লাভ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে মাইকেল ব্যারাট ব্রাউন লিখেছেন – “Imperialist control , now depends more on economic domination than on political rule “.

৭. রাজনৈতিক ভিত্ত

ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন স্থানে নিজে নিজে উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তবে ঊনবিশ ও বিষ শতকের ইউরোপের শিল্প উন্নত দেশগুলি যে নয়া সাম্রাজ্যবাদী বা নয়া উপনিবেশিকতাবাদী নীতি গ্রহণ করে তা পূর্ববর্তী যুগে উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবতী নীতির চেয়ে অনেক তীব্র ও সক্রিয় ছিল। ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তি গুলি তৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশিক স্থাপনে হয়েছিল।

তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশিক ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। উপনিবেশী রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলি প্রকৃতপক্ষে উপনিবেশ নিজের সামগ্রিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতো। রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে উপনিবেশের অর্থনৈতিক, সামরিক সামাজিক, ধর্মীয় প্রবিতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহজেই নিজেদের একাধিক পত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতো।

মন্তব্য

নয়া উপনিবেশবাদ শুধুমাত্র উন্নত বা অনুন্নত দেশের সার্বিক অগ্রগতি বা উন্নতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি, টা বিশ্ব শান্তি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেউ বিঘ্নিত করেছে। এই সত্য অনুভব করে উন্নয়নশীল দেশগুলি নির্জট আন্দোলন গড়ে তোলে এছাড়া উন্নতশীল দেশগুলি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাহায্য নিয়ে বা জি-৭৭, জি-১৬ এবং আফ্রিকার ঔর কুশংস্থা প্রভীদের মাধ্যমে নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment