ভূমিকা
জাপান উদীয়মান সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত। কার্যতো সাদা এশিয়া মহাদেশের উপনিবেশিক শক্তির কাছে প্রধানত হলেও জাপান কিন্তু মাথা নত করেনি। উন্নত শির বাজায় রেখে স্বাধীন জাপান নবোদিত সূর্যের মতোই ভাস্বর ছিল। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে জাপানের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা দূর হলে, পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের ও ভাবধারার সংস্পর্শে আধুনিকতার প্রসার ঘটে। শীঘ্রই জাপানি ইউরোপীয় শক্তিগুলির সমকক্ষ হয়ে ওঠে এবং এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগী হয়। ইউরোপের রণাঙ্গনে মিত্র শক্তি জোট এবং অক্ষশক্তি জ্যোতির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান অক্ষশক্তি জোটে যোগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপান সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ নেয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানিদের অগ্রগতি
১. জাপানি আগ্রাসন
(১) প্রস্তুতি : উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাপান আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি সমকক্ষ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে জাপান নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে সম্পাদিত অসম অমর্যাদা কর চুক্তি গুলি বাতিল করার উদ্যোগ নেই। মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য জাপানের প্রয়োজন ছিল সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করা। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপ সাম্রাজ্য বিস্তারে সুযোগ তৈরি করে। ইউরোপের মাটিতে ইউরোপীয় দেশ গুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় তাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশে গুলি অক্ষরিত হয়ে পড়ে এই সুযোগে জাপান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ নেই। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাবান ও যোগ দিয়েছিল। কিন্তু জাপানের মূল লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের একাধিকপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
(২) সরকারি উদ্যোগ : (i) প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের সম্প্রসারণবাদকে সরকারি তরফ সমর্থন করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমামারো কোনোয় তিন নভেম্বর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে অখন্ড ভারত দু টুকরো হলো। পূর্ব এশিয়ার নতুন বিধান ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় বলা হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ সূচনা ঘটানো হবে। এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল – (a) চীনের অর্থনীতির ওপর জাপানের একচেটিয়া অধিকার স্থাপন। (b) চীনে জাতীয়তাবাদী সরকারি যাদের বিদেশ থেকে সামরিক সাহায্য না পায় তার ব্যবস্থা করা।
(ii) ডায়েটে আইন পাস : জাপান সরকারের সংস্কার গ্রন্থী সামরিক আমলা রাজাপানকে এক জাতীয় প্রতিরক্ষা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখেন। ইতিমধ্যে জাপানি নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন ফুমিমারো কোনোয়। তিনি এই প্রস্তাব মেনে কিছু আইন সংস্কারের নেন। আইনি সংস্কারের অঙ্গ হিসেবে ডাইরেক্ট পার্লামেন্টে পাশ করানো হয় ‘কোক্কা সোদোইন হও আইন’ । এই আইন পাশের মাধ্যমে একদিকে যেমন শিল্প বিকাশের কর্মসূচি নেওয়া হয় অপরদিকে তেমন জাপানি আগ্রাসী নীতিকে ও সমর্থন করা হয় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ ২৪ মার্চ।
২. চিনে আক্রমণ
(১) সূচনা : আগে মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ ও দখল জাপানি কে চীনের ওপর বৃহত্তর আধিপত্য অনুপ্রাণিত করে। মাঞ্চুরিয়ায় বসবাসকারী জাপানি সৈন্যরা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে থেকেই চীনে আক্রমণের সুযোগ খুঁজতে থাকে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জুড়ে জাপানের চীনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। জাপানের সেনাবাহিনী চীনে পিকিং শহরে দক্ষিণ মার্কোপোলো সেতুর কাছে অবস্থানরত চীন সেনাদের আক্রমণ করে। পিকিং শহরের সীমান্তবর্তী লুকো-চিয়াও নামে গ্রামটিতে শুরু হয় চীন ও জাপানি সোনার মধ্যে সংঘর্ষ (১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই)। জাপানি সেনারা ভেবেছিল যে এই গ্রামটি যেহেতু পিকিং-হ্যানকাও রেলপথের মার্কোপোলো সেতুর কাছে অবস্থিত তাই এই গ্রামে দখল নিতে পারলে সেতুর ধ্বংস করে চীনে রাজধানীর পিকিং থেকে চীনের বাকি অংশকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সম্ভব হবে।
(২) অধিকার প্রতিষ্ঠান : চীনের কুয়োমিন তাং ও কমিউনিস্ট দল নিজেদের পূর্বেকার বিরোধ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাপানের আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হয়। চীনা বাহিনী ও প্রতি আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু তারা হার মানে। জাপানি সেনারা পিকিং ও তইয়এনসইন এই দুটি শহরের দখল নেই। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের সাংহাই, নানাকিং, পিকিং, ক্যান্টন এবং উয়ান থেকে সেচুয়ান পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডের ওপর চাপা নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
(৩) জাতিসংঘের চীনের আবেদন : জাপানের আগ্রাসন রোধে ব্যর্থ হয়ে চীনের চিয়াং সরকার জাতিসংঘের সুবিচার চেয়ে আবেদন জানায়। জাতিসংঘের চীনের আবেদনের ভিত্তিতে দূর প্রাচ্যের পরামর্শদাতা কমিটি জাতিসংঘের সাধারণ সভার কাছে এক প্রতিবেদন পাঠায়। এই প্রতিবেদনে জাপানকে নয় শক্তি চুক্তি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এবং প্যারিস চুক্তি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লঙ্ঘনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বলা হয় এই দুই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলির কর্তব্য হলো চীন-জাপান সমস্যার সমাধানের জন্য এগিয়ে আসা।
(৪) ব্রাসেলস সম্মেলন : সাধারণ সভার উদ্যোগে নয় শক্তি চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশগুলি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস এ এক সম্মেলনে মিলিত হয়। জাপানি সম্মেলনে যোগ না দেওয়ায় ব্রাসেলস সম্মেলন ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করার আগে পর্যন্ত চীনে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব বজায় থাকে।
৩. এশিয়ার বিস্তার নীতির বৃহত্তর পরিকল্পনা
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাথমিক পূর্বে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন জার্মানি আক্রমণে প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।। এই সুযোগে জাপান এশিয়াতে জাপানি সাম্রাজ্যের বিস্তারের লোককে বৃহত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। জাপানের এই পরিকল্পনার নাম ছিল বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যৌথ অগ্রগতি বলয়। শিরটোরি তোসিও নামে জাপানের এক প্রভাবশালী আমলা সর্বপ্রথম এই নীতির উত্থাপন করেন। এই পরিকল্পনায় বাস্তবে রূপায়ণ ঘটান জাপানের বিদেশ মন্ত্রী মাৎসুওকা। এই পরিকল্পনায় মূল কথা ছিল জাপান কেবল মাঞ্চুকুয়ো এবং চীনের মধ্যে জাপানি সম্প্রসারণবাদকে আটকে রাখবে না। সেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরী অঞ্চলে ও তার সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটাবে।
৪. জার্মান সাহায্য
(১) জাপ-জার্মান মিত্রতা : এশিয়া জুনে সফলভাবে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের লোককে জাপানি মন্ত্রীসভার এক উচ্চপর্যায়ে সম্মেলনে আয়োজিত হয়। জাপ-জার্মান মিত্র তাকে আরো সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার নেয়া হয়। এশিয়া মহাদেশ ইঙ্গ-ডাচ-ফরাসি-পর্তুগিজ উপনিবেশিক গুলি ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এশিয়ায় জাপানি বিস্তা নীতিকে সমর্থন জানায় জার্মানি। এক্ষেত্রে জার্মানি উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ায় রণাঙ্গনে ব্রিটেনে ব্যস্ত থাকলে ইউরোপে জার্মানির বিরুদ্ধে পক্ষ মিত্র ও শক্তি জোটের দুর্বলতা বাড়বে।
(২) ত্রি-পাক্ষিক সামরিক চুক্তি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটালে জাপানি ইতালি ও জার্মানির সঙ্গে রোম-বার্লিন-টোকিও চুক্তি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর আবদ্ধ হয়। এই ত্রি-পাক্ষিক অক্ষ চুক্তি বা অ্যান্টি কমিন্টার্ন চুক্তি না আমিও পরিচিত। এই চুক্তির পরে জাপান একে একে সুমাত্রা, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিসন, বোর্নিয়ো এবং যা ভাই ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন বন্দর গুলি ধ্বংস করে দেয়।
(৩) বিভিন্ন অঞ্চল দখল : সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করে জাপান একে একে শ্যাম দেশ থাইল্যান্ড, হংকং, মালয়, সিঙ্গাপুর, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ইন্দোনেশিয়া দখল করে।
৫. বিভিন্ন অঞ্চল দখল
(১) কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুবিধা জনক অবস্থায় থাকাকালীন জাপান ফরাসি নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রচীন নিজের কর্তিত স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পতন ঘটলে জাপান ইন্দ্র চীনে নিজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
(২) ভিয়েতমনিদের বিরোধিতা : হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা চলাকালীন আন্নাম, টংকিং, কোচিন-চীন একজন হয়ে ভিয়েতনাম নামে এক স্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হো-চি-মিন ভিয়েতনামি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেন ‘ভিয়েতমিন’ বা ‘ভিয়েতনামি’স্বাধীনতা লিগ’ । এই মুক্তিযোদ্ধারা ইন্দ্র চীনকে জাপানিদের হাতে থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রবল সংগ্রাম শুরু করে।
(৩) ইন্দোচিন ত্যাগ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি জোট শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। জাপান এত সমর্পণ করে। ফলে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে জাপান সরে আসতে বাধ্য হয়।
৬. আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে সংযোগ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্বে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাপানি রণকৌশল এর বদল ঘটে। এই নতুন রণকৌশল এর অঙ্গ হিসেবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আই. এন. এ কে সর্বত্রভাবে সাহায্য করার আশ্বাস দেয় জাপান সরকার। আই. এন. এ র সঙ্গে মিলিত হয়ে জাপানি সেনাদল ইম্ফলএর ব্রিটিশ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। কিন্তু তারা ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়।
মন্তব্য
জাপান দা সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াকে নিজের অধীনে আনে। অধিকৃত অঞ্চল গুলির বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ জাপান হস্তগত করে। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে জাপানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে পড়ে। মার্কিন বিমান বাহিনীর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বর্ষণ করলে জাপান সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জাপানি অগ্রগতি থেমে যায়। এই সুযোগে বিভিন্ন জাপ অধিকৃত অঞ্চল গুলি একে একে স্বাধীন হয়।