দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা পত্রিকায় শকুন্তলা চরিত্রটি কীভাবে বীরাঙ্গনা হয়েছে তা আলোচনা করো।

যে প্রেম পরিণয়ে সার্থক হয়নি, সেই প্রেমমুগ্ধ নায়িকার পত্রের সঙ্গে পতিপত্নীর যত্নে স্বাভাবিক কারণে একটি লক্ষণীয় পার্থক্য বর্তমান থাকে। সুতরাং এই শ্রেণির পত্রগুলিতে প্রেমিকা নারী অপেক্ষা পতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নারী আমরা প্রত্যাশা করতে পারি। কিন্তু দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলার পত্রটিতে আমরা জানি শকুন্তলা বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সেই কারণে অমিলনজনিত উৎকণ্ঠায় পত্রটিকে উষ্মার ছোঁয়া জেগেছে এবং জীবনী শক্তির কারণ হয়েছে। শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের পরিচয় ঘটেছে একবারই এবং সেই একবারেই তাদের প্রেম থেকে পরিণয়ে সমাধা হয়েছে। এরপর থেকে দুষ্মন্তের দর্শন আর পাওয়া যায়নি। শকুন্তলা যে অবস্থায় দুষ্মন্তের কথা স্মরণ রেখেছে পৌরাণিক ইতিবৃত্ত সম্পূর্ণ অমনোযোগী হলে এই অদর্শনের পর এক তীব্র, মানসিক যন্ত্রণা ও উৎকণ্ঠা শকুন্তলা স্মরণ করতেই পারে।

প্রথম নায়িকা শকুন্তলার পত্র দিয়েই মধু বীরাঙ্গনা কাব্য সূচনা করেছেন। শকুন্তলার উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা স্বাভাবিক কারণেই দুষ্মন্ত মৃগয়া করতে একবারই প্রবেশ করেছিলেন মুনির আশ্রমে এবং শকুন্তলার কোমল মনের প্রেমের অর্ঘ্য গ্রহণ করে সেই যে চলে গিয়েছিল আর তাঁর দেখা নেই। নিষ্ঠুর ব্যাধের মতোই হৃদয়ের ওপর মৃগয়াবৃত্তি প্রকাশ করে তিনি সেই তপোবনে তপোবনচারিণীকে দেখে বিস্মৃত হয়েছেন। এর পরের যে কাহিনি সকলেরই জানা আছে দুর্বাশা মুনির অভিশাপ। এই অভিশাপের কারণেই দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে বিস্তৃত হয়েছিলেন, পুরাণ কথা এ ঘটনাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু মধুসূদন তাঁর নায়িকাকে সে প্রণয় স্মরণ করেছেন সময়কাল ও পূর্বের বলে বোঝা যায়। দুষ্মন্ত চলে যাবার পরে তার চিন্তায় শকুন্তলাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল সে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে একেবারেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। তাই সমস্তক্ষণেই সে দুষ্মন্তের চিন্তায় বাহ্যজ্ঞান থাকত। এই ব্যাপারটি বোঝাবার জন্যই দুর্বাশার আগমন বৃত্তাস্তটি মূল্যবান। তপোবন পরিচর্যাকারিণী হিসাবে শকুন্তলার সবচেয়ে অতিথি তপোবনে প্রবেশ করে আতিথ্য প্রার্থনা করা সত্ত্বেও শকুন্তলা সে সময় অবহিত হতে পারেনি। মনের এই অবস্থাতেই সে দুষ্মস্তের পত্র রচনা করতে বসেছিল, এটাই কবিকল্পনা।

সংস্কৃত সাহিত্যের বিখ্যাত কবি কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌’ অবলম্বনে কবি শকুন্তলা চরিত্র নির্মাণ করেছেন। মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে উপনীত রাজা দুষ্মস্ত কগ্গের আশ্রিতা তপোবন-বালিকা শকুন্তলার সাক্ষাৎপ্রাপ্ত এবং গান্ধর্ব মতে তাকে বিবাহ করেন। রাজ্যে ফিরে যাবার সময় তিনি তাকে রাজকীয় মর্যাদায় বরণ করে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও দুষ্মন্তের কোনো সংবাদ না পেয়ে বিরহ বিক্ষুদ্ধ শকুন্তলা এই পত্র রচনা করেন। বিশ্বামিত্র ও মেনকা পরিত্যক্ত কন্যা এরকম কোনো পত্র রাজসমীপে প্রেরণ করেছিলেন তা জানা যায় না। সম্ভবত এটি কবিকল্পনা। দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলার সুগভীর প্রেম প্রথম পত্রে ব্যক্ত হয়েছে। শকুন্তলা প্রতি মুহূর্তে দুষ্মন্তের আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করেছিলেন। তাঁর আশা দুষ্মন্ত এসে তাকে নিয়ে যাবেন রাজপ্রাসাদের কিন্তু দুষ্মন্তের দিক থেকে কোনো আকর্ষণই কার্যত দেখা মেলে না। তপোবনে বিশ্ব প্রকৃতির নানা স্বাদ, পশুপাখির আনন্দ মুখরতা, সবই তার কাছে নিরর্থক মনে হয়। বনদেবীর সঙ্গে শকুন্তলার ছিল নিবিড় অভিযোগ ৷ তাই তার মনে হয় ‘কাঁদিছেন বনদেবী দুঃখিনীর দুখে। আসলে সর্গের প্রতি ছত্রে শকুন্তলার মনোবেদনার প্রকাশ ঘটেছে। শৈশবে পিতা মাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন, যৌবনে স্বামীরূপে যাকে বরণ করলেন তিনি তাকে ভুলে গেলেন।

গান্ধবমতে বিয়ে করে স্ত্রীকে একেবারে বিস্মৃত হওয়া যে জাতীয় অমানবিক আচরণ তাকে স্ত্রী হিসাবে অনেক কঠোর বাক্য শকুন্তলা প্রয়োগ করতে পারত। কিন্তু কবি একথা বিস্মৃত হননি যে সে আশ্রমকন্যা। সুতরাং তার ভাষা ব্যবহার ও তার উপযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই তার মানসিক অবস্থাই সে বেশি করে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করেছে, প্রতি মুহূর্তে রাজার প্রত্যাবর্তন আশা তার মনে এতই প্রবল যে, সে বলে—

“অমনি চমকি ভাবি,—মদকল ? 

বিবিধ রতন অঙ্গে পশিছে আশ্রমে।”

–এই ভুল অবশ্য ভাঙতেও বিলম্ব হয় না। দুই সখী শকুন্তলার দুঃখ দেখে কেবল কাঁদে। বনের পশু পাখি তরুলতাদের আগের মতোই আনন্দিত দেখে শকুন্তলার ক্রোধ হয়। এখানে মধুসূদন প্রাচীন দৃষ্টি ত্যাগ করে আধুনিক হয়ে উঠেছেন। শকুন্তলাকে তপোবন থেকে বিদায় দেবার সময় মন্যুষ্যেতর প্রাণী এবং তরুলতাদি শোকবিহ্বল হয়ে উঠেছে। এটাই প্রাচীন সৃষ্টি। মধুসূদনের দৃষ্টিতে বিরহিণী শকুন্তলা তাঁর বিরহ বিষণ্ণ মনে তপোবনের মনুষ্যেতর প্রাণীর চিরাচরিতের আনন্দিত জীবন সহ্য করতে পারেন না। সে পুষ্পকুঞ্জকে বলেছে—

“রে নিকুঞ্জ শোভা,

কিসাধে সহিস তোরা? কেন সমীকরণে 

বিতরিস্ আজি হেথা পরিমল সুধা?”

কোকিলকে ডেকে সে বলে—

“কেন তুমি, পিককুল পতি 

এ স্বর লহরী, আজি বরিষ এ বনে?

কে করে আনন্দ ধ্বনি নিরানন্দ কালে?”

শকুন্তলার কিছুই ভালো লাগে না। কেবল যেসব স্থান দুষ্মস্ত প্রতি সুরভিত যেসব স্থানে সে ঘুরে বেড়ায়। দুষ্মত্তের সঙ্গে প্রথম দর্শনের প্রথম প্রেমের কিছু বিচ্ছিন্ন চিত্র তাকে উন্মাদ করে তোলে। যে তরুতলে গান্ধর্ব বিবাহ হয়েছিল যে নিকুঞ্জে ফুলশয্যা হয়েছিল সে স্থানে শকুন্তলা বিদগ্ধ হৃদয় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। শকুন্তলা তার এই বিদগ্ধ হৃদয় তার দুই সখীকে দেখাতে চায় না কারণ—

“বিবশা দেখিলে মোরে রোষে ঋষি বালা,

নিন্দে তোমাহে নরেন্দ্র, মন্দ কথা কয়ে। 

বজ্ৰ সম অপবাদ বাজে পোড়া বুকে!

ফাটি অন্তরিত রাগে-বাক্যনাহি ফোটে।”

আসলে বিরহ দিন একটি রোমান্টিক নায়িকা রূপেই শকুন্তলাকে দেখেছেন পল্লবিনী লতার মতোই কোমল তার চরিত্র তাই নিজেই সে কষ্ট পেতে পারে। এই কথাই জানাবার জন্য পত্র লিখতে পারে।

“দাসীভাবে পাদুখানি এই লোভ মনে,”–কিন্তু তীক্ষ্ণ অনুযোগ বা তীক্ষ্ণ অভিমান আশ্রমে বালিকাভাবি তার মনে বিষচরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে দাসীর ভাব। বন নিবাসিনী শকুন্তলা তো কিছুই চায়নি চেয়েছিল শুধু এতটুকু ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি। সে তাও পেল না, কিন্তু মনে ক্ষীণ আশা তখনও অবশিষ্ট, দুষ্মন্ত একদিন নিশ্চিত ফিরবেন। তাই এই চিঠি epistile টি লিখে রাজার কাছে পাঠালেন শকুন্তলা। ‘জীবনের আশা হয়ে কে ত্যাজ সহজে! এই পঙ্ক্তিতে শকুন্তলার ভগ্ন আশা, তার মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।

চিরন্তন কাব্যসুন্দরী শকুন্তলার বিরহিণী রূপ নারী হৃদয়ের উৎকণ্ঠা, স্বামীর প্রতি অনুযোগ ও অভিমান আলোচ্য পত্রিকায় অপূর্ব সুধাময়ে মণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়ে বীরাঙ্গনাকে করেছে শ্রেষ্ঠ কাব্য ও মধুসূদন হয়েছেন শ্রেষ্ঠ কবি।

এই প্রশ্নের অনুকরণে লেখা যায়—

(১) শকুন্তলার প্রেমে একদিকে রয়েছে সূক্ষ্মতা, অন্যদিকে রয়েছে বেদনা । এই দ্বৈত সত্তার মিলন কবি ঘটিয়েছেন। ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’ পত্র অবলম্বনে আলোচনা করো। অথবা (২) ‘এই কিরে ফলে ফল প্রেমতরু শাখে!–শকুন্তলা পত্রিকায় শকুন্তলা এই আক্ষেপ কীভাবে ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে আলোচনা করো। অথবা (৩) দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা পত্রিকাটি আগাগোড়া-ই আত্মনিবেদনে বিনম্র আলোচনা করো।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment