দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোচীনের ইউরোপীয় উপনিবেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি আলোচনা করো?

সূচনা

ইন্দোচীন বলতে আনলাম, টংকিং টকিং এবং কোচিন চীনকে বোঝায়। এই ইন্দ্র চীন ও একাধিক উপনিবেশিক শক্তির অধীনস্থ হয়েছিল। ইন্দোচীনের অধিবাসীরা দীর্ঘদিন একের পর এক ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি অধীনে পরাধীন ছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এই অঞ্চল ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পায়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচিনে ইউরোপীয় উপনিবেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি

১. ফরাসি সাম্রাজ্য

উনিশ শতক নাগাদ দক্ষিণ পূর্বে এশিয়ার অন্তর্গত সমগ্র ইন্দ্রোচীন উপদ্বীপ অঞ্চলটি ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের আওতায় আসে। মূলত উনিশ শতকের তৃতীয় নেপোলিয়নের আমলেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা ঘটে। এর মধ্যে আবার বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইন্দ্রোচীনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে।

২. জাপানি সাম্রাজ্যবাদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করে। এদিকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়কালে জার্মান আক্রমণে ফ্রান্স কোন ভাষা হয়ে পড়লে সেই সুযোগে জাপান সমগ্র ইন্দোচিনে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ইন্দ্রোচিন জাপানি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়। জাপানি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ইন্দ্রোচীন বাসি একজোট হয়। ফলস্বরূপ বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা হো-চি-মিন এর নেতৃত্বে ইন্দ্রোচীন, ভিয়েতনাম নামে আত্মপ্রকাশ করে।

৩. ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের পূর্ণপ্রতিষ্ঠা

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ এর আগে পটসডাম সম্মেলনে আয়োজিত হয়। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল জাপানি ইন্দ্রোচীনে থেকে সরে গেলে ইন্দ্রোচীনের উত্তরাঞ্চলে জাতীয়তাবাদী কুয়োমিং তাং চীন ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্রিটেনে দায়িত্ব নেবে। এদিকে হো-চি-মিন-এর নেতৃত্বে হ্যানয় অঞ্চলে অস্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। হো-চি-মিন এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম থেকে ব্রিটিশ ও চীনা সামরিক বাহিনী সরে যায়।

এই সুযোগে ফ্রান্স পুনরায় এই সুযোগে ফ্রান্স পুনরায় ভিয়েতনামে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু হো-চি-মিন ভিয়েতনামে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়। অবশেষে ভিয়েতমিন সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে। চুক্তি শর্তানুসারে হো-চি-মিন এর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে ইন্দ্রোচীন ফেডারেশন এবং ফরাসি ইউনিয়নের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু অচিরেই এই চুক্তিকে অবজ্ঞা করে ফ্রান্স ভিয়েত নামে নিজের ক্ষমতা সু প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। আমেরিকা ফ্রান্সে এই উদ্যোগকে সমর্থন করে। এমনকি ব্রিটেনিও ইন্দ্রোচিনে ফ্রান্সকে তার পূর্বতন সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সমর্থন জানায়।

৪. মার্কিনী হস্তক্ষেপ

(১) উদ্দেশ্য : ফরাসীদের সঙ্গে ভিয়েতনামা বাসীর দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্যবাদের প্রসার ঘটতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন জাতীয় আন্দোলনের প্রসার রোধে সচেষ্ট হয়।

(২) ফ্রান্সকে সাহায্য : ইন্দ্রোচীনে হো-চি-মিন এর নেতৃত্বাধীন সরকারকে সাম্যবাদী সোভিয়েত ও চীন সমর্থন জানালে মার্কিন প্রশাসন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে সরাসরি সাহায্য করার নীতি গ্রহণ করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ঘোষণা করেন -“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে প্রয়োজনীয় সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দান করবে”।

(৩) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ : জেনেভা সম্মেলন ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ জুলাই এ গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে ভিয়েতনামের দীর্ঘ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটে। তারপরেই সাম্যবাদের প্রসার রোধের লক্ষ্যে আমেরিকা সরাসরি ভিয়েতনাম সংকটে অংশগ্রহণ করে। মার্কিন প্রশাসনিক প্রথমেই দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাও-দাই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করে ফ্রান্স বিরোধী ও সাম্যবাদ বিরোধী নেতা ন-দিন-দিয়েমকে।

(৪) সিয়াটো গঠন : উত্তর ভিয়েতনামে হো-চি-মিনের সরকারকে চীন ও সোভিয়েতের সাহায্য অব্যাহত রাখে। পক্ষান্তরে ইন্দ্রোচীন সহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সাম্যবাদ মুক্ত করার লক্ষ্যে মার্কিন উদ্যোগে গঠিত হয় সিয়াটো বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চুক্তি সংস্থা। একদিকে দিয়েমের মার্কিন দর্শনে দক্ষিণ ভিয়েতনামে গণ অসন্তোষ দেখা দেয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতার লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতীয় মুক্তি মোর্চা।

(৫) মার্কিনদের পরাজয় : দক্ষিণ ভিয়েতনামে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় জেনারেল নগুয়েন ভ্যান থিউ-এর হাতে। ভইয়এতকং বাহিনী ও উত্তর ভিয়েতনাম এর বাহিনীর মিলিত আক্রমণ মার্কিনিরা পিছু হটে। প্যারিস সম্মেলনে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং ভিয়েতকং এর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে যুদ্ধ বিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি শর্ত অনুযায়ী মার্কিন প্রশাসন তাদের সৈন্য ও পরামর্শদাতাদের ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে নিতে রাজি হয়। শেষ পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়। আত্মপ্রকাশ ঘটে সংযুক্ত, স্বাধীন, সার্বভৌম সমাজবাদী ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment