‘তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।’ -কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের এমন ‘ভয়ংকর সজাগ থাকার কারণ কী?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ ছােটোগল্প থেকে সংকলিত এই উদ্ধৃতিটিতে বিদেশিদের কথা বলা হয়েছে।
ভূতগ্রস্ত ভারতবাসীর কথা বলতে গিয়ে এ গল্পে বলাহয়েছে যে, ‘পৃথিবীর অন্য দেশগুলােকে ভূতে পায় নি।’ আমাদের দেশের ঘানি থেকে বেরােনাে পেষণকারীর রক্ত ভূতের মাথার খুলিতে ঢালতেই ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া, সে-কাজে পেষণকারীর তেজ ও শক্তি নির্গত হয়ে যায় বলে তা পেষণকারীকে ঠান্ডা ও নির্জীব করে তােলে। বিদেশের মানুষকে ভূতে পায়নি বলে বিদেশের ঘানি থেকে কেবল তেলই বের হয়, পেষণকারীর রক্ত বা শক্তি নয়। সে-তেল সেসব দেশের উন্নয়নের রথচক্রকে সচল করতেই ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই ভূতে না-পাওয়া বিদেশিরা শীতল হয়ে যায়নি, তারা সজাগ আছে। ভূতগ্রস্ত অর্থাৎ ধর্মতন্ত্র- গ্রস্ত দেশবাসী ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ এবং তার চিন্তা-চেতনাতেই তার শক্তি নিঃশেষিত করে ফেলে বলেই তারা প্রতিবাদহীন শান্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধর্মতন্ত্রের মােহজালে আচ্ছন্ন নাথাকায় বিদেশিরা তাদের সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আজ য়ুরােপের ছােটোবড়াে যে-কোনাে দেশেই জনসাধারণ মাথা তুলিতে পারিয়াছে, সর্বত্রই ধর্মতন্ত্রের অন্ধ-কর্তৃত্ব আলগা হইয়া মানুষ নিজেকে শ্রদ্ধা করিতে শিখিয়াছে।” এ কারণেই বলা হয়েছে যে, তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।
“কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল।”—কারণটি পর্যালােচনা করাে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ ছােটোগল্পে ভূতগ্রস্ত দেশবাসীর আপাত-শান্ত, আপাত-দ্বিধাহীন, আপাত-অহংকারী অবস্থা বর্ণনার পরই লেখক উক্তিটি করেছেন। তিনি বলেছেন, মুশকিলটা হল, ‘পৃথিবীর অন্য দেশগুলােকে ভূতে পায় নি।’ ভূতগ্রস্ত এদেশের ঘানি থেকে বেরেনাে রক্ত ভূতের মাথার খুলিতে ঢালা হয়। এই কাজে পেষণকারীর তেজ বেরিয়ে যায় বলে এদেশে ঘানি চালনায় দেশবাসী ঠান্ডা ও নির্জীব হয়, শক্তিশালী হয় ভূততন্ত্র। অন্যদিকে ভূতে না-পাওয়া বিদেশিদের ঘানি থেকে নির্গত তেল ব্যবহৃত হয় ‘তাদের ভবিষ্যতের রথচক্ৰটাকে সচল করে রাখার জন্যে।’ ফলে বিদেশিরা নির্জীব হয়ে যায়নি, তারা সজাগ আছে। ভূতগ্রস্ত অর্থাৎ ধর্মতগ্রস্ত এদেশবাসী ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে তাদের শক্তি নিঃশেষিত করে প্রতিবাদের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। ধর্মতন্ত্রের মােহজালে আচ্ছন্ন না থাকায় বিদেশিরা কিন্তু তাদের সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে। এ কারণেই তারা ভয়ংকর সজাগ রয়েছে। ভূতে-না-পাওয়া বিদেশিদের এই জুড়িয়ে না যাওয়া এবং ‘ভয়ংকর সজাগ থাকার চিন্তাই দেশবাসীকে মুশকিলে ফেলে দিয়েছিল।
কর্তার ভূত গল্পে যে সামাজিক সত্যের দিকে লেখক নির্দেশ করেছেন তা নিজের ভাষায় লেখাে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত গল্পে রূপকের সাহায্যে প্রাচীন ধর্মকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার স্বরূপ এবং সেখানে প্রজাদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বুড়াে কর্তা ভূত হয়ে দেশের লােকের ঘাড়ে চেপে থাকে। আর দেশের লােকও তাতে পরম নিশ্চিন্ত হয়, কারণ এই ধর্মতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করলে।
নিজের ভাবনা আর ভাবতে হয় না। ভূতগ্রস্ত দেশের মানুষেরা চোখ বুজে চলে আর ভবিষ্যৎকে ভূতের খোঁটায় বেঁধে রাখে। সংস্কারগ্রস্ত ধর্মতন্ত্রের কাছে সব মানুষই যে আত্মসমর্পণ করে তা নয়। কিন্তু স্বভাবদোষে’ অর্থাৎ নিজস্ব যুক্তিবােধে যারা অন্যরকম বলতে চায় তাদের ভূতের কানমলা অর্থাৎ ধর্মব্যবস্থার শাস্তির মুখােমুখি হতে হয়।
এখানে ভুতুড়ে জেলখানার ঘানিতে মানুষের তেজ নিংড়ে নেওয়া হয়। এভাবে তৈরি করা হয় এক জবরদস্তি শান্তির আবহাওয়া। সেখানে দেশের মানুষদের হুঁশিয়ারদের থেকে সাবধান থাকতে বলা হয়। এরই মধ্যে ভূতের শাসন অনন্তকাল চলবে কি না সে প্রশ্নও উঠে আসে।
অর্থাৎ বিবেকসম্পন্ন দুচারজন মানুষ এই অন্ধত্ব আর কুসংস্কারের পরিবেশ থেকে বেরােতে চায়। আর তখনই আসল কথাটা বলে দেন ভূত হয়ে থাকা বুড়াে কর্তা—“আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই, তােরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।” মানুষের মনের মধ্যে যে অন্তহীন ভয় তার সূত্র ধরেই প্রাচীন ধর্মব্যবস্থার ভূত টিকে থাকে সমাজে। এইভাবে বুড়াে কর্তার ভূত এবং ভূতের শাসনব্যবস্থাকে আশ্রয় করে ধর্মতন্ত্রের নেতিবাচক চেহারাকে লেখক আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন।