ঠান্ডা লড়াই
পরিচিতি
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ হয়। এরপর বিজয়ী মিত্র শক্তিবর্গ দুটি পরস্পর বিরোধী রাষ্ট্রপতিতে বিভক্ত হয়ে বিশ্বে এক অভিনব রাজনৈতিক বাতাবরণ সৃষ্টি করে। এই দুই শিবিরের একদিক থেকে সোবিয়েড ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র জোট, অপরদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জোট। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য গড়ে তোলার জন্য এই দুই রাষ্ট্র জোটের মধ্যে যে গোপন লড়াই শুরু হয় তা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত। রুশোর বিদেশ মন্ত্রী ম্যাক্সিম লিটভিনভ এর মতে আদর্শগত ধ্যান ধারণাই ঠান্ডা যুদ্ধের উদ্ভবের জন্য দায়ী। অধ্যাপক এফ. এইচ. হার্টম্যান- এর মতে তুই মহাশক্তি দৃষ্টিভঙ্গি ও তত্ত্বগত পার্থক্য ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব ঘটায়। মার্কিন সাংবাদিক ওয়ানল্টার স্লিম ম্যান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তার ‘The Clod War’গ্রন্থে সর্বপ্রথম ঠান্ডা লড়াই কথাটি ব্যবহার করেন।
ঠান্ডা লড়াইয়ের পটভূমি/ঠান্ডা লড়াই উদ্ভবের পরিস্থিতি
ঠান্ডা লড়াইয়ের এই উদ্ভবের পরিস্থিতি গুলিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এগুলি হলো – (১) দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পূর্ববর্তী পর্যায়, (২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পর্যায়ে এবং (৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে।
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে
(১) বলশেভিক বিপ্লবের বিরোধিতা : রুশো বিপ্লবের সময় বলশেভিকরা আদর্শগত কারণে পশ্চিমে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগোষ্ঠীর চক্ষুশূল ছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবকে দমন করার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গোষ্ঠী আমেরিকান, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জাপান জারতন্ত্রের সমর্থনে রাশিয়ায় সেনা পাঠায়। সমাজতন্ত্রকে সূচনা কালের শেষ করে দেওয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কাজেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের জন্ম লগ্ন থেকে বিশ্বে দ্বিমেরু করণ রাজনীতির জন্ম নেয়।
(২) হিটলারের প্রতি তোষণ নীতি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে একনায়ক তান্ত্রিক শাসন হিটলারের জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স হিটলারের চেয়ে সাম্যবাদী রাশিয়াকে নিজেদের বড় শত্রু বলে মনে করত। এদিকে হিটলার ও রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের তীব্র বিরোধী হওয়ায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তার প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে হিটলারকে আরো প্ররোচিত করে।
২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পর্যায়
(১) দ্বিতীয় রণাঙ্গনের ভূমিকা : যুদ্ধ চলাকালে জার্মানির প্রবল আক্রমণে দিশেহারা সোভিয়েত রাশিয়া পশ্চিমী জোটের কাছে জার্মানির বিরুদ্ধে পশ্চিম ইউরোপের দ্বিতীয় রাণাঙ্গন খোলার অনুরোধ রাখে। কিন্তু এই অনুরোধ কে নিয়ে চার চিলের দুমুখো নীতি স্টাইলিনকে ক্রুদ্ধ করে তোলে।
(২) মার্কিন সমর দপ্তর পেন্টাগনের প্রভাব : মার্কিন সামরিক দপ্তর পেন্টাগনের সেনাপতি কঠর বিরোধী ছিলেন। তারা কখনোই চাননি অ্যামেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নরম মনোভাব পোষণ করুক। তারা মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান কে সোভিয়েতের রাশিয়ান বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করতে উস্কানি দেন। এছাড়াও ইয়আল্টআ সম্মেলনে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পুল সমিতি নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া সঙ্গে শক্তি গুলির মতপার্থক্য এবং গ্রীষ্মের মুক্তিযুদ্ধে ইঙ্গ মার্কিন হস্তক্ষেপ স্টালিন কে রুষ্ট করে তোলে।
(৩) ট্রুম্যানের দায়িত্ব : আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ছিলেন প্রবলভাবে সোভিয়েত বিরোধী। পোল্যান্ড থেকে জার্মান সৈন্য সরে গেলে সেখানে রুশো প্রভাবিত সরকার গঠিত হয়। এতে ক্রুদ্ধ ট্রুম্যান রুশো পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভের কাজে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
(৪) পটসডাম সম্মেলন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন শেষ ও সম্মেলন টি অনুষ্ঠিত হয় পটসডামে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। পটসডাম সম্মেলনে জার্মানির সমস্ত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়নি। জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে সোভিয়েত ও মার্কিন মতবিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। পারস্পরিক মত বিরোধের মধ্যে দিয়ে এই সম্মেলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বলা হয় পটসডামে সম্মেলন থেকে ঠান্ডা লড়াই প্রকাশে আসে।
৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে
(১) পাঁচ বিদেশ মন্ত্রীর সম্মেলন : অক্ষশক্তি ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে শান্তি চুক্তির খসড়া রচনার লক্ষ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন এই পাঁচটি দেশের বিদেশ মন্ত্রীরা একটি কাউন্সিল গঠন করেন। কিন্তু এই কাউন্সিলের কার্যকলাপে রাশিয়ার সন্দেহ হয় যে, পশ্চিমী শক্তি পূর্ব ইউরোপের দ্রুত হাজির হওয়ার উদ্দেশ্যে জার্মানির সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
(২) চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইউরোপের পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গ্রীস, তুরস্ক, ইরানেও ওর তারা অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফ্রান্স ও ইতালি নির্বাচনে তারা দারুন সাফল্য পায়। ইউরোপের কমিউনিস্টদের সাফল্য এবং রাশিয়া সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক পশ্চিমে দেশগুলিকে আতঙ্কিত করে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন আমেরিকার মিশৌরি প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনে ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে পাঁচ মার্চ বলেন, উত্তর বালটিক সাগরের তীরবর্তী স্টোটিন দেখে দক্ষিণ অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের ট্রিয়েস্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল লৌহ যবনিকার সোভিয়েত আড়ালে ঢাকা। ফালটন বক্তৃতায় চার্চিল রুশ আগ্রাসন থেকে ইউরোপীয় সভ্যতা কে রক্ষা করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন।
(৩) কেন্নানের বেস্টনী তথ্য : রাশিয়ায় কর্মরত প্রাক্তন সহকারী মার্কিন রাষ্ট্রদূর জর্জ এফ. কেন্নান, মা. এক্স ছদ্ম নামে আমেরিকার ফরেন অ্যাফেয়ার্স নামে পত্রিকায় এক প্রবন্ধের সোভিয়েতের আক্রমণ নাটক নীতি প্রতিহত করার জন্য এবং সোভিয়েত প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বেস্টনী তত্ত্ব ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই প্রকাশ করেন, যা মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয়।
(৪) ট্রুম্যান নীতি : আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেস এক বক্তৃতা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ মার্চ তুরস্কর অগ্রিসহ বিশ্বের যে কোন দেশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন, যা ম্যান নীতি নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক আইজ্যাক ডয়েসচার ট্রুম্যান নীতিকে ঠান্ডা লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বলে অবহিত করেছেন।
(৫) মার্শাল পরিকল্পনা : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৫ জন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এক বক্তৃতা আমেরিকায় বিদেশ মন্ত্রী জজ মার্শাল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের আর্থিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্য এক পরিকল্পনা পেশ করে, যা মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা নামের ট্রুম্যান নীতির পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপিত হয় এই মার্শাল পরিকল্পনা। ফলে আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে ঠান্ডা লড়াই।
(৬) সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে আর্থিক সহায়তা পরিষদ গঠন : সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গঠন করে কমিকন বা Council for Mutual Economic Assistance নামে একটি আর্থিক সহায়তা পরিষদ। মার্শাল পরিকল্পনার প্রত্যুত্তর হিসেবে কমিকন গঠিত হয়েছিল।
(৭) আমেরিকার নেতৃত্বে শক্তি জোট গঠন : সোভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 1949 খ্রিস্টাব্দে প্রথমে গড়ে তোলে উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা তারপর একে একে গড়ে তোলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা; মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা, পরবর্তীকালেটির নাম হয় মধ্য এশিয়ার চুক্তি সংস্থা; অ্যানজাস, ইত্যাদি শক্তি জোট।
(৮) রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তি জোট গঠন : আমেরিকান নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পশ্চিমি সামরিক শক্তি জোট ন্যাটোর জবাবে রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি কে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চোকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া অপূর্ব জার্মানি নিয়ে গঠিত হয় ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা, যা ছিল একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
উপসংহার
শুধুমাত্র ইউরোপেই নয়, ঠান্ডা লড়াই এর পরিধি সারা বিশ্বের সম্প্রসারিত হয়। এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ভিত্তিক সমগ্র বিশ্বের মানুষকে অস্থির করে তোলে। মর্গ্যানথাউ এবং লুই জে. হ্যালের মতে বাস্তববাদীরা ঠান্ডা লড়াইকে মূলত ক্ষমতা রাজনীতি আর শক্তির সামনের সংকট থেকে উদ্ভূত এক প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নোয়াম চমস্কির মতে -ঠান্ডা যুদ্ধ হলো এমন একটি কার্যকরী ব্যবস্থা যাতে মহা শক্তিধর দেশগুলি নিজেদের অঞ্চল গুলিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।