জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বেলগ্রেড সম্মেলন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ওপর আলোকপাত করো? অথবা, প্রথম নির্জোট সম্মেলন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের বর্ণনা দাও?

সূচনা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বের একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট অপরদিকে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের বাইরে আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকা সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি এই সমস্ত দেশগুলি উভয় জোটের প্রভাবের বাইরে থেকে বিশ্বব্যাপী এক নির্জোট আন্দোলন গড়ে তোলারও সিদ্ধান্ত নেয়।

বেলগ্রেড সম্মেলন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ

১. প্রস্তুতি

প্রথম জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন বেলগ্রেড আয়োজিত হওয়ার আগে এই সম্মেলনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। ৫ থেকে ১২ জুন মিশরের রাজধানী কায়রোতে এই অনুষ্ঠিত হয়। এখানে বাইশটি দেশের বিদেশ মন্ত্রী এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বইটাকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য রাষ্ট্রগুলির জন্য নির্ধারিত নিয়মাবলী ও যোগ্যতার মাপকাঠি স্থির করা হয়। এগুলি হল –

(১) জোট নিরপেক্ষ সদস্য পদপ্রার্থী দেশকে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র নীতি মেনে চলতে হবে।

(২) জাতীয় আত্মনিয়ন্তনের অধিকার কে স্বীকৃতি জানিয়ে বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ বিরোধী, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানাতে হবে।

(৩) বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে কার সংঘাত বা প্রভাব কে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঠান্ডা যুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এমন কোন পারস্পরিক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যাবে না।

(৪) রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানগত ভিন্নতা সত্ত্বেও জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলিকে পারস্পরিক সহাবস্থান নীতি মেনে চলতে হবে।

(৫) কোন সদস্য রাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কোন বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা করলেও সেটিকে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব মুক্ত রাখা হবে।

(৬) কোন সদস্য দেশ তার কোন রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডকে বিদেশি শক্তি সামরিক স্বার্থে প্রদান করলেও সেই ভূখণ্ডকে ঠান্ডা যুদ্ধের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে।

২. আয়োজন

বেলগ্রেড এর প্রস্তুতির সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম শীর্ষ সম্মেলন বসে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যুগোশ্লাভিয়া রাজধানী বেলগ্রেড। এই সম্মেলন চলে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সোভিয়েত মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের উত্তপ্ত রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যে আয়োজিত হয় এ সম্মেলন।

৩. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু, মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল নাসের, যুগোশ্লাভিয়া রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ, ঘানা রাষ্ট্রপতি নক্রুমা, শ্রীলংকার সিরিমাভো বন্দর নায়ক প্রমুখ নেতা বেলগ্রেড নির্জন সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ওই সম্মেলন ২৬ টি সদস্য রাষ্ট্র যোগ দেয়। এতে পরিদর্শন হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকা ব্রাজিল, বলিভিয়ান ও ইকোয়েড যোগদান করেছিল। এই সম্মেলন উপস্থিত দেশগুলির মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশ গুলি আধিক্য ছিল।

৪. গৃহীত সিদ্ধান্ত

এই সম্মেলনে এক খসড়া প্রস্তাব মার্কিন ও সোভিয়ে দুই ভাই রাষ্ট্রকে কোন সংঘাতে জড়িয়ে না হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর তত্ত্বাবধনে রচিত এই খসড়া প্রস্তাব ‘An Apple for Peace নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে অন্যান্য যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেগুলি হল –

(১) উপনিবেশবাদের অবসান ঘটানো লক্ষে সক্রিয় থাকা।

(২) বিশ্বজুড়ে নিরস্তীয়করণের প্রচার চালানোর এবং নিরক্ষীয় করনের উদ্যোগকে সফল করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন।

(৩) এই সম্মেলনে আরো ২৭ দফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই ২৭ দফা সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন, অ্যান্গোলাই পোর্তুগিজ উপনিবেশবাদের বিরোধিতা, কঙ্গোয় বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরোধিতা প্রকৃতি।

(৪) এই সম্মেলন থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন প্রস্তাবগুলি অনুসরণে প্যালস্তিনীয় জনগণের অধিকার কে সুরক্ষিত করার দাবি জানানো হয়।

(৫) এছাড়া ও এই সম্মেলন থেকে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পারমাণবিক পরীক্ষা, উপনিবেশবাদ এবং জাতিগত বৈষম্যের অবসান এর দাবি ঘোষণা করা হয়।

৫. গুরুত্ব

রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা মনে করেন বান্দুং সম্মেলন যদি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে জন্ম ধাত্রী হয় তাহলে বেলগ্রেড সম্মেলন ছিল তার প্রতিষ্ঠান ভিত্তি। বেলগ্রেড সম্মেলনে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল ও অনুন্নত দেশগুলির সংঘবদ্ধ হওয়ার একটি মঞ্চ করে দেয়। তাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে মার্কিন সোভিয়ে জঙ্গি আগ্রাসনকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় সফল হয়। এই সম্মেলনে যোগদানকারী রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিকতাবাদ এবং নয়া উপনিবেশিকতাবাদের অবসান ঘটিয়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়া হয়।

৬. বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানের মতামত

(১) ভারত : ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেওয়ার কথা বলেন। নেহেরু জোর নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন জোট নিরপেক্ষ বলতে সেই সমস্ত জাতিকে বোঝায় যারা আদর্শগত এবং কার্যগতভাবে যুদ্ধ, সামরিক জোট বা মোর্চা গঠন করার বিরোধী।

(২) ইন্দ্রোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ বলেন যে, জার্মানি, কোরিয়া বা ভিয়েতনামে ভূখণ্ডের অধিকার লাভ কে কেন্দ্র করে এই দুই মহা শক্তি রাষ্ট্রের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বন্ধ হওয়ার প্রয়োজন, নতুবা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

(৩) বার্মা : বার্মা রাষ্ট্রপতি ইউসুফ বলেন যে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে এবং উপনিবেশবাদ বা জাগতিক অবসান ঘটাতে হবে।

৭. মন্তব্য

প্রথম নির্জন সম্মেলন বেল গ্রেড সম্মেলন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে এ জোট নিরপেক্ষ ধারণা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন স্পষ্ট রূপ পায়। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রনায়কগণ এক যৌথ ইস্তাহারে ঘোষণা করেন যে তারা জোটবদ্ধ হয়ে উপনিবেশবাদ, নয়া ও উপনিবেশিকবাদ, বর্ণ বৈষ্ণব বাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। এই যৌথ ইস্তাহারে হারে তারা জানান যে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গুলিকে তারা সমর্থন করবেন। প্রথম নির্জন সম্মেলনে এই ভূমিকা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ভিত্তি করে দেয়। তাই বলা যায় বেলগেট সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে নির্জন আন্দোলন সূচনা ঘটে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment