জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি বা ধারণা বিশ্লেষণ করো।

জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি

জাতীয় স্বার্থের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য অর্থনির্ধারণ একটি জটিল বিষয় বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। পল সিবিউরি দুটি অর্থে জাতীয় স্বার্থকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, জাতীয় স্বার্থ হল একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি। দ্বিতীয়ত, জাতীয় স্বার্থ হল সেই সমস্ত উদ্দেশোর সমষ্টি যা জাতি এবং তার নেতৃবৃন্দ অনুসরণ করে থাকেন।

[1] বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী। দৃষ্টিকোণের প্রবক্তা হ্যান্স জে মর্গেনথাউ জাতীয় স্বার্থের ধারণার ব্যাখা দিতে গিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতীয় স্বার্থের। বিশ্লেষণে নৈতিক বা মতাদর্শগত মানদণ্ডকে তিনি গ্রহণ করেননি। মর্গেনথাউ- এর মতে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনেতারা তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর বক্তব্য হল, যে-কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। কোনো রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থির করে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের কতকগুলি ন্যূনতম স্বার্থ থাকে, যেমন-ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুগ্ধ রাখা। এই সমস্ত স্বার্থ পূরণ করাই যে-কোনো রাষ্ট্রের লক্ষন। মর্গেনথাউ মনে করেন জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ তার সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মর্গেনথাউ এই অভিমতও ব্যক্ত করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা শুধু যে নিজের জাতির স্বার্থের ধারণা সম্পর্কে সচেতন করে তাই নয়, অন্য জাতির স্বার্থ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করে। আধুনিক বিশ্বে এই সংগতি রক্ষাকে রাজনৈতিক নীতিবোধের একটি প্রয়োজনীয় শর্ত এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার একটি প্রয়োজনীয় উপাদান বলে মনে করা হয়।

[2] ফ্ল্যাঙ্কেলের অভিমত: জোশেফ ফ্র্যাঙ্কেলের অভিমত হল, বিদেশনীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা প্রধান। অবশ্য জাতীয় স্বার্থের ধারণার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয় বলেও তিনি মনে করেন। জাতীয় স্বার্থ শুধু যে একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অন্য রাষ্ট্রের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার ওপরেও তা নির্ভরশীল। ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থ হল পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মূল ধারণা। জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি-(National interest is the key concept in foreign policy. In essence it amounts to the sum total of all the national values…)।

[3] জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত বিষয়: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে যেসব বিষয় জড়িত তার মধ্যে রয়েছে-জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি। অবশ্য জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি ও প্রভাব বিস্তার, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যবিস্তারও এর সঙ্গে জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাও স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত ছিল। একটি দেশের পররাষ্ট্র বা বিদেশনীতি কোনো পরিস্থিতিতেই জাতীয় স্বার্থের বহির্ভূত হতে পারে না। আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ মুখ্য নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে যে সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠন করা হয়, সেক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা প্রাধান্য পায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন ও সোভিয়েত নেতৃত্বের দ্বারা গঠিত যথাক্রমে ন্যাটো (NATO) এবং ওয়ারশ চুক্তির (Warsaw Pact) কথা উল্লেখ করা যায়। সমাজতন্ত্রী চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও পশ্চিম জার্মানির পারস্পরিক সম্পর্কও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে চালিত হয়। এ ছাড়া বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের ঘটনাও জাতীয় স্বার্থের ধারশা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

[4] একমেরু বিশ্বে জাতীয় স্বার্থ: সাম্প্রতিককালের একমের বিশ্বে (Uni- polar world) আণবিক মারণাস্ত্রের প্রসার, অতিবৃহৎ শক্তি (Super power) হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রভৃতির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে নয়া বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে চলেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিমেরুপ্রবণতা (Bi-polarism), বস্তুকেন্দ্রিক প্রবণতা (Poly- centrism) ও একমেরু প্রবণতা (Unipolarism)-এর মূলে জাতীয় স্বার্থের ধারণা সক্রিয় উপাদান হিসেবে কাজ করেছে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রবক্তারা মনে করেন।

উপসংহার: অধ্যাপক জোশেফ ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থের কোনো বিকল্প নেই। বস্তুত, জাতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থের ধারণা আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান  হিসেবে স্বীকৃত

Leave a Comment