চণ্ডীর পরিচয়:
দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সৃষ্টি। কিন্তু কে এই চণ্ডী? প্রশ্ন দীর্ঘকাল যাবৎ গবেষকদের বিব্রত করে রেখেছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত ‘সপ্তশতী চণ্ডী-তে দেবী চণ্ডীর বহু যুদ্ধ বিজয় কাহিনী ও মাহাত্ম্য প্রচলিত রয়েছে। এই চণ্ডী এবং চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের চণ্ডী উভয়ই শিবশক্তি, অতএব মনে হতে পারে, মার্কণ্ডেয় পুরাণের চণ্ডীই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও স্থান পেয়েছেন। কিন্তু কাহিনী-বিশ্লেষণে দেখা যায় একমাত্র নাম-সাদৃশ্য ছাড়া এই উভয় চণ্ডীর মধ্যে আর কোন ঐক্য নেই। পুরাণের চণ্ডী অতিশয় উগ্র, ইনি অনেক অসুর বধ করেছেন মানবসমাজের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়নি। পক্ষান্তরে ‘চণ্ডী মঙ্গল কাব্যে যে দুটি কাহিনী রয়েছে, তাতে দেবীদ্বয়ের একই চণ্ডী নাম থাকলেও কার্যত দু’জন পৃথক দেবী। কালকেতু-কাহিনীর দেবী চণ্ডী কখনাে বা মহিষাসুরমর্দিনী রূপধারিণী, তিনি অরণ্যের পশুকূলের পূজা গ্রহণ করেন এবং ব্যাধসন্তান কালকেতুকে তার পূজার জন্য নির্দেশ দান করেন। আবার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দ্বিতীয় কাহিনী ধনপতি সদাগরের কাহিনীতে যে চণ্ডীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তিনি রাখালদের পূজা গ্রহণ করেন, হারানাে জিনিষ পাইয়ে দেন, আবার কখনাে বা কমলে-কামিনী রূপ পরিগ্রহ করেন। বস্তুতঃ ইনি বাঙালী ঘরের মেয়েদের দ্বারা পৃজিতা দেবী মঙ্গলচণ্ডী; কাজেই চণ্ডীমঙ্গল কাহিনীর দুই চণ্ডী যেমন পৃথক, নাম-সাদৃশ্য ছাড়া অপর কোন সাদৃশ্য নেই, তেমনি পৌরাণিক চণ্ডীর সঙ্গেও তাদের একমাত্র নামেই সাদৃশ্য রয়েছে; অপর কোনদিকেই একের সঙ্গে অপরের কোন সম্পর্ক নেই। অবশ্য আর একটি ক্ষেত্রে এই সাদৃশ্যকে স্বীকার করে নিতে হয়। এঁরা তিনজনই কিন্তু শিবপত্নী। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দেবখণ্ডে দেবী কখনাে সতী, কখনাে বা পার্বতী উমারূপে বিরাজিতা। উভয় ক্ষেত্রেই শিবের সঙ্গে তার সংসারধর্মের কাহিনী বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু কোথাও চণ্ডী নামটি ব্যবহৃত হয়নি।
চণ্ডীর উদ্ভব:
অতএব অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দেবী চণ্ডী কে? গবেষকগণ এ বিষয়ে গবেষণা করেও ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে না পারলেও সকলেই স্বীকার করেছেন যে এই চণ্ডী কোন অনার্য সমাজ থেকে আগতা দেবী—এই অনার্য সমাজ দ্রাবিড়, অস্ট্রীক বা নিষাদ এবং মঙ্গোল বা কিরাত—যে কোনটি হতে পারে। তবে এর উপর পরে বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ এবং জৈন দেবীদের প্রভাব পড়ে থাকা সম্ভব। এ বিষয়ে মঙ্গলকাব্যের বিশিষ্ট গবেষক ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্য অনুমান করেন ওঁরাও জাতি ‘চাণ্ডী’ নামে যে এক অরণ্যদেবীকে পূজা করে থাকে এই ‘চাণ্ডী’ দেবী অরণ্যপশুকুলের রক্ষক এবং পশুপালক শ্রেণীর আরাধ্যা। মূল চণ্ডীকে আমরা সেখান থেকেই নিয়েছি এবং পরে যথােচিত মাজা-ঘষা করে তাকে শিবপত্নীতে উন্নীত করে তার একটা আর্যরূপ দিয়েছি। তৎসত্ত্বেও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে তাঁর আদি রূপটি চাপা পড়েনি। তাই দেখি বনের পশুরা তার কাছে দরবার করে, তারা আশ্রয় ভিক্ষা করে এবং দেবীও পশুহন্তারক ও অরণ্যজীবী ব্যাধ-সন্তানদের নিকট পূজা গ্রহণের আকুলতা প্রকাশ করেন।
চণ্ডীমঙ্গল-কাহিনী:
চণ্ডীর মূল অন্বেষণের পরই পণ্ডিতগণ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের উৎস-সন্ধানে তৎপর হন, কিন্তু এখানেও সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কাব্যের কাহিনীটি গড়ে উঠেছে এভাবেদক্ষযজ্ঞে শিবনিন্দা শুনে শিবপত্নী সতী দেহত্যাগ করে আবার উমা-পার্বতীরূপে হিমালয়-গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। এ জন্মেও তিনি শিবকেই পতিরূপে লাভ করেন। পার্বতীকে বিবাহের পর শিব শ্বশুরগৃহে ঘরজামাইরূপে অবস্থান করেন। এখানে মা মেনকার সঙ্গে মতান্তর হওয়াতে কন্যা পার্বতী স্বামীসহ কৈলাসে চলে যান। শিব ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। কিন্তু দরিদ্রের সংসারে অভাব নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মনােমালিন্যের সৃষ্টি হলে দু’জনেই যার যার মতে সংসার ত্যাগ করতে চান। তখন পার্বতীর সখী পদ্মাবতী দেবীকে মর্ত্যলােকে পূজা প্রচার করতে উপদেশ দেন। তদনুযায়ী পার্বতী মহাদেবকে অনুরােধ করেন, তিনি যেন শাপ দিয়ে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে মর্ত্যলােকে পাঠিয়ে দেনতিনিই মর্ত্যলােকে দেবীর পূজা প্রচার করবেন। মহাদেবও কূটকৌশলে নীলাম্বরকে অভিশাপ দিয়ে মর্ত্যে পাঠিয়ে দিলেন। এই পর্যন্ত ‘দেবখণ্ড’।
নীলাম্বর মর্ত্যে ব্যাধসন্তান কালকেতুরূপে এবং নীলাম্বরপত্নী ছায়া ব্যাধকন্যা ফুল্লরারূপে জন্মগ্রহণ করেন, তাদের বিয়ে হয়। এদিকে দেবী চণ্ডী মর্ত্যে প্রথম পূজা গ্রহণ করেন কলিঙ্গ- রাজের। তারপর বনের পশুদের পূজা গ্রহণ করে সিংহকে পশুদের রাজা করে দিয়ে তাদের অভয় দান করেন। এদিকে কালকেতু শিকার করতে গেলে বনের পশুদের মধ্যে ভয়ানক ত্রাসের সঞ্চার করে। দেবী সুবর্ণ-গােধিকা রূপ ধারণ করে কালকেতুকে ছলনা করেন। কালকেতু গােধিকাকে ঘরে নিয়ে এলে দেবী প্রথমে ষােড়শীরূপে এবং পরে মহিষম্দিনীরূপে দেখা দিয়ে কালকেতুকে প্রচুর ধন পাইয়ে দিয়ে তাকে গুজরাট বন কেটে রাজা হতে নির্দেশ দান করেন। সেখানে দেবীর দেউল নির্মিত হলাে এবং মর্ত্যলােকে দেবীর পূজা প্রচারিত হলাে। এই পর্যন্ত ‘আখেটিক পর্ব’।
এরপর দেবীর ইচ্ছা হলাে—তিনি নারীর এবং বণিক সমাজের পূজা গ্রহণ করবেন। এই উদ্দেশ্যে গন্ধর্বকে শাপগ্রস্ত করে ধনপতি সদাগর ও তৎপত্নীকে ফুল্লরা রূপে মর্ত্যলােকে প্রেরণ করেন। এটি বণিক পর্ব। দেবী এখানে প্রথমে মঙ্গলচণ্ডীরূপে এবং শেষ পর্যায়ে কমলে-কামিনী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। এই কাহিনীটি কালকেতু কাহিনী অপেক্ষা অনেক বেশি বিস্তারলাভ করেছে। কালকেতু কাহিনীর মধ্যে কোন সংযােগ-সূত্র নেই—একমাত্র চণ্ডীর নাটিম ছাড়া। উভয় কাহিনীতে চণ্ডীর প্রকৃতিও ভিন্ন তবে তার উপকার করবার ইচ্ছা উভয়ত্র বর্তমান।
কাহিনী-বিশ্লেষণ ও নামকরণ: আলােচিত কাহিনীটির প্রথমাংশ অর্থাৎ দেবখণ্ড পুরাণভিত্তিক হলেও হরগৌরীর সংসার যাত্রার কাহিনী কবি নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালী জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই আহরণ করেছেন। অপর দুটি মূল কাহিনী অর্থাৎ কালকেতু-কাহিনী এবং ধনপতি সদাগরের কাহিনী সম্ভবতঃ লৌকিক উৎস থেকেই সংগৃহীত হয়েছে এবং চণ্ডীর নাম-সাদৃশ্য-হেতু দুটিকে একই পৃষ্টপটে আবদ্ধ করা হয়েছে। কেহ কেহ অবশ্য বৃহদ্ধ্মপুরাণের একটি শ্লোককেই উক্ত কাহিনীদ্বয়ের উৎসরূপে নির্দেশ করে থাকেন। শ্লোকটি এরূপ- ‘ত্বংকালকেতু বরদাচ্ছেলগােধিকাসি যা ত্বাং শুভা ভবসি মঙ্গলচণ্ডিকাখ্য। শ্ৰীশালবাহন নৃপাদ বণিজঃ স্বসূনাঃ রক্ষেহস্বুজে করিদ্বয়ং গ্রসতী বমস্তী।’ অর্থাৎ – “আপনি সুবর্ণগােধিকা মুর্তি পরিগ্রহ করিয়া কালকেতুকে বর দিয়াছেন, আপনি শুভা মঙ্গলচণ্ডিকা, আপনি মাতঙ্গভােজন ও উদগীরণ করতঃ কমলে-কামিনী-রূপে শ্রীমস্তসদাগর ও তৎপিতাকে শ্রীশালবাহন রাজার হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছেন।” -এখানে দু’টি কাহিনীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলেও এগুলি অর্বাচীন বৃহদ্ধর্মপুরাণে পরবর্তীকালে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছিল বলেই অনুমান করা হয়। অতএব কাহিনীর উৎসরূপে বৃহদ্ধর্মপুরাণকে গ্রহণ করা চলে না।
বাঙলাদেশে চৈতন্যপূর্ব যুগে কোন চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সন্ধান পাওয়া না গেলেও যে তৎকালে মঙ্গলচণ্ডীর গীত’ প্রচলিত ছিল, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন চৈতন্যজীবনীকার কবি বৃন্দাবন দাস। তিনি চৈতন্যসমকালীন সমাজ-জীবনের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন—
ধর্ম কর্ম লােকে সবে এই মাত্র জানে।
মঙ্গলচণ্ডীর গীত করে জাগরণে।।
এ ছাড়াও তৎপূর্বকালেও যে বাঙলায় মঙ্গলচণ্ডীর পূজা প্রচলিত ছিল, তারও পাথুরে প্রমাণ বর্তমান। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত গােধিকাসহ যে দেবী-মূর্তিটি উত্তরবঙ্গে পাওয়া গেছে, তা নিশ্চিতই দেবী চণ্ডীর মূর্তি। বিভিন্ন পুরাণে যে চণ্ডীর নাম পাওয়া যায়, তিনি এই চণ্ডী নন; তবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে মঙ্গলচণ্ডীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বলা হয়েছে—
মঙ্গলেষু চ যা দক্ষা সা চ মঙ্গলচণ্ডিকা।
অর্থাৎ যিনি ভক্তের মঙ্গলসাধনে দক্ষ, তিনিই দেবী মঙ্গলচণ্ডিকা। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অর্বাচীনকালে রচিত হলেও সম্ভবতঃ দ্বাদশ শতকের পরে নয়। বাংলাদেশে সেন রাজত্বকালেই সম্ভবতঃ মঙ্গলচণ্ডীর পূজা প্রবর্তিত হয়েছিল।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য:
অপরাপর মঙ্গলকাব্যের তুলনায় চণ্ডীমঙ্গল কাব্য যে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, এ বিষয়ে মনীষী সমালােচক বলেনঃ “বালকোচিত কথা-সাহিত্যের যুগে চণ্ডীমঙ্গলই প্রথম পরিণত যুবমনের পরিচয় দিয়াছে উত্তেজনাময় প্রাণধর্মের উর্ধ্বে প্রশান্ত মনােধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিয়াছে। দেব-দানবের যুদ্ধ নহে, দেব-মানবের প্রতিযােগিতা নহে, অতি সাধারণ বর্ণহীন ও তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনায় সম্প্রসারিত মানবজীবনই ইহাতে প্রধানভাবে বর্ণনীয়। বাঙালীর সুখ-দুঃখ, সামাজিক দলাদলি, কুসংস্কার, বারমাস্যা, রন্ধনপ্রণালী, ভােজ্যতালিকা, বেশভূষা, বিবাহ-বিধি, পরনিন্দা প্রভৃতি অতি সাধারণ ব্যাপারকেও চণ্ডীমঙ্গলে আস্বাদ্য করিয়া তােলা হয়েছে।” মনসামঙ্গলের মত প্রত্যক্ষভাবে চণ্ডী মঙ্গলে দেবতা ও মানুষের দ্বন্দ্ব বর্ণিত হয়নি। দেবী চণ্ডী পূজা প্রার্থনা করেন, কিন্তু কখনাে উগ্রভাবে আত্মপ্রকাশ করেননি। বিভিন্ন উপকাহিনী এবং ঘটনার সর্বত্রই কবিদের বাস্তব, মানবমুখী ও সমাজ-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এমন কি অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী দেবী চণ্ডীর মধ্যেও লৌকিক জীবনের পরিচয়ই অধিকতর পরিস্ফুট-মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু উপাখ্যানে সমসাময়িক যুগের সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসের সন্ধান পেয়েছেন। এখানে পাওয়া যাচ্ছে, কীভাবে প্রাচীন বর্ণগত কৌলীন্য প্রথা ক্রমশঃ কাঞ্চনকৌলীন্যের কাছে হতমান হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে স্বীকৃতি জানাতে বাধ্য হলাে। দৈবধনের অধিকারী বিত্তবান অনার্য ব্যাধ সন্তান কালকেতুকে দমিয়ে রাখবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ব্রাহ্মণ্য সমাজাশ্রিত কলিঙ্গরাজ শেষ পর্যন্ত তাকে স্বীকার করে নিলেন। প্রজারা প্রথমে অনার্যরাজ্যে বসতি স্থাপনে অনিচ্ছুক ছিল।
অতএব নানাভাবে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যকাহিনীর বিশ্লেষণান্তে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, একমাত্র এই মঙ্গলকাব্যেই উপন্যাসের ধর্ম অনেকটা পরিমাণে বর্তমান। ফলত এইদিক থেকে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যকেই সর্বাধিক আধুনিক প্রাগ্রসর বলে অভিহিত করা চলে।
(ক) দ্বিজ মাধব: চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি দ্বিজ মাধবের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তির কারণ রয়েছে। মধ্যযুগে মাধব নামে একাধিক কবি বর্তমান ছিলেন—কেউ ‘দ্বিজ মাধব’, কেউ বা মাধবাচার্য, আবার একই ব্যক্তি উভয় নাম ব্যবহার করতেন কিনা, তা-ও নিশ্চিতভাবে জানবার উপায় নেই। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি দ্বিজ মাধব আত্মপরিচয়সুত্রে বলেছেন—‘পরাশর পুত্রজাত মাধব যে নামে। আবার ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’ রচয়িতা মাধবাচার্যও পরিচয় দিয়েছে—
পরাশর নামে দ্বিজকুলে অবতার।
মাধব তাহার পুত্র বিদিত সংসার ।।
জন্মস্থানরূপে কবি নবদ্বীপের কথা উল্লেখ করেছেন, কোন গ্রন্থে নবদ্বীপ-স্থলে সপ্তগ্রামের নাম পাওয়া যায়। মাধবাচার্যের বংশধরদের নিকট মাধববংশতত্ত্ব’ নামক যে কুলপঞ্জিকা আছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে কবি মাধব গঙ্গাতীর থেকে বাস উঠিয়ে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার মেঘনা তীরে বাসভূমি স্থাপন করেছিলেন। গঙ্গামঙ্গল’রচয়িতারূপেও এক মাধবের পরিচয় পাওয়া যায়। দ্বিজ মাধব-রচিত চণ্ডীমঙ্গলের যাবতীয় পুথি পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নবদ্বীপ সপ্তগ্রাম বা ময়মনসিংহ অঞ্চলে কোন পুঁথি পাওয়া যায়নি। অতএব কোন মাধব চণ্ডীমঙ্গল রচনা করেন এবং তার বাসস্থান কোথায় ছিল, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভবপর নয়।
দ্বিজ মাধব কোক্কালে বর্তমান ছিলেন তা নিয়েও সমস্যা দেখা দিয়েছে। একটি আত্মপরিচয়জ্ঞাপক শ্লোকে আছে—
ইন্দুবিন্দুবাণধাতা শক নিয়ােজিত।
দ্বিজ মাধব গাত্র সারদাচরিত।।
এ থেকে তারিখ পাওয়া যায় ১৫৯১ শকাব্দ বা ১৫৭৯ খ্রীঃ। গ্রন্থের অন্যত্র আছে—
‘পঞ্চগৌড় নামে স্থান পৃথিবীর সার।
একাব্বব নামে রাজা অর্জুনাবতার।।
উক্ত সালে আকবর সিংহাসনাসীন থাকলেও পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়নি অতএব কোথাও একটা গোঁজামিল থাকা সম্ভব। ডঃ সুকুমার সেন পূর্বোক্ত ইন্দু-বিন্দুবাণধাতা- স্থলে ‘ইন্দ্রবিন্দুদানদাতা’ পাঠ গ্রহণ করে কবির কাব্য রচনাকাল নির্ণয় করেছেন ১৬৪৪-৪৭ খ্রীঃ। কিন্তু এতে আকবরের সঙ্গতি থাকে না এবং কাব্যের কতকগুলি অভ্যন্তর লক্ষণের জন্য একে অর্বাচীন বলেও মনে হয় না। এতএব অধিকতর প্রামাণিক তথ্য আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত দ্বিজ মাধবের কাব্য রচনাকাল ১৫৭৯ খ্রীঃ বলেই গ্রহণ করা সঙ্গত।
কবি দ্বিজ মাধব তাঁর কাব্যের নাম বলেছেন ‘সারদাচরিত’ বা ‘সারদামঙ্গল’। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এটি ‘সুকবি মাধবাচার্য-বিরচিত জাগরণ’ নামক ব্রতকথা বা পাঁচালি জাতীয় গ্রন্থরূপে বহুল প্রচলিত। মাধবের কাব্য-পাঠে স্পষ্টতঃই অনুমিত হয় যে কবিকঙ্কণের কাব্যের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। কাজেই তিনি যে মুকুন্দ চক্রবর্তীর প্রাগবর্তী-এই অনুমান যথার্থ হওয়াই সম্ভব। সাধারণভাবে কাহিনীর দিক থেকে কবিকঙ্কণের কাব্যের সঙ্গে এর বিশেষ পার্থক্য নেই। এতেও তিনটি খন্ড- দেবখন্ড, আখেটিক খন্ড এবং বণিকখন্ড। তবে এতে একটি অতিরিক্ত কাহিনী যুক্ত হয়েছে- দেবী চণ্ডী-কর্তৃক মঙ্গলাসুর বধ এবং এই কারণে ‘মঙ্গলচণ্ডী’ নাম লাভ। এতে কালকেতু কাহিনী এবং ধনপতি কাহিনী সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হয়েছে আর কাব্যের শেষাংশে তত্ত্বকথার ব্যাখ্যা অহেতুক বিস্তারলাভ করেছে। কাহিনী-নির্মাণে কবি উচ্চ প্রতিভার পরিচয় দিতে না পারলেও বাস্তব পরিবেশ সৃষ্টিতে তিনি পরিচয় দিয়েছেন, তা অবশ্যই উল্লেখযােগ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে তার বাস্তবচিত্র যে কবিকঙ্কণ অপেক্ষাও বিশ্বাসযােগ্যরূপে উপস্থাপিত হয়েছে, তার দু’ একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। কবিকঙ্কণের কাব্যে আছে কালকেতু-ফুল্লরাকে সংসার-জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে বৃদ্ধবয়সে কালকেতুর পিতা-মাতা ধর্মকেতু-নিদয়া কাশীবাসী হলেন এবং তাদের ভরণ-পােষণের জন্য কালকেতু মাসে মাসে টাকা পাঠাতাে। একজন ব্যাধের পক্ষে এ জাতীয় জীবনযাপন কি বিশ্বাস্য? পক্ষান্তরে দ্বিজ মাধব দেখিয়েছেন কালকেতুর বিবাহের পর সংসার বৃদ্ধি পাওয়াতে পিতা ধর্মকেতু জীবিকা সংগ্রহের জন্য অরণ্যে গিয়ে সিংহের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাধ-জীবনের সঙ্গে এই পরিণামই তাে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ।
কবি দ্বিজ মাধব তথ্যানুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে জীবনকে দেখেছেন এবং সেই দৃষ্টিতেই কাব্যখানি রচনা করেছেন বলেই এর বাস্তবতা এত প্রখর হয়ে উঠেছে। সাধারণভাবে চরিত্র-সৃষ্টিতে তিনি অসাধারণ কোন নৈপুণ্য দেখাতে না পারলেও তাঁর অঙ্কিত ভাড়ু দত্ত অতিশয় জ্বল হয়ে উঠেছে। তার কুটবুদ্ধি, চাতুরী এবং বঞ্চনার চিত্রের মতই তার অপরাধ এবং শাস্তি বিধানের কাহিনীও সমভাবেই কৌতুকোদ্দীপক। দেবী চণ্ডী অনার্য সমাজ থেকে আগত হলেও কবিকঙ্কণ তাকে আর্য-কল্পনার পৌরাণিক ছদ্মবেশে উপস্থিত করেছেন, কিন্তু দ্বিজ মাধবের কাব্যে দেবী যথাযথভাবে অনাযােচিত ভয়ঙ্করী দানবীরূপেই উপস্থাপিত হয়েছেন। অন্যান্য চরিত্রসৃষ্টিতেও কবি আনুপূর্বিক সঙ্গতিবিধানের চেষ্টা করলেও তা কবিকঙ্কণের মতাে সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি। দ্বিজ মাধবের দুর্ভাগ্য যে তাকে মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল বলেই তাঁর তুলনায় নিষ্প্রভ প্রতিপন্ন হয়েছে। কবিকঙ্কণকে বাদ দিয়ে অপর যে কোন মঙ্গলকাব্যকারের তুলনায় তার প্রতিভা যে কোন অংশেই ন্যূন নয়, এ কথা নিঃসংশয়ে প্রকাশ করা চলে। কবিকঙ্কণকে যদি শিল্পী কবি আখ্যা দেওয়া যায়, তবে দ্বিজ মাধব স্বভাবকবির মর্যাদা অবশ্যই পেতে পারেন।
(খ) কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী– মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীকবিরূপে স্বীকৃত হয়ে থাকেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী। অথবা অন্যতম কবি না বলে তাকেই মধ্যযুগের প্রাধানতম কবি বলে চিহ্নিত করা চলে, যিনি একটি লােককাব্যধারাকে রূপ দিয়েও মৌলিকতায়, চরিত্রচিত্রণে, বাস্তব রস সৃজনে এমনকি ঔপন্যাসিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশে আধুনিক সমালােচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভে ধন্য হয়েছেন। তার গ্রন্থে তিনি যে আত্মপরিচয় দিয়েছে, তা থেকে জানা যায়, মানসিংহ যখন বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদার ছিলেন, তখন ডিহিদার মামুদ সরীফের অত্যাচার-আশঙ্কায় কবি পিতৃপুরুষের ভিটা দামুন্যা ত্যাগ করে ব্রাহ্মণভূমি আড়রার রাজা বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় লাভ করেন এবং তার পুত্র রঘুনাথের শিক্ষক নিযুক্ত হন। দেবী চণ্ডী স্বপ্নাদেশ এবং রাজা রঘুনাথের অনুরােধেই কবি তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। মানসিংহ ১৫৯৬ খ্রীঃ বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার সুদেবার নিযুক্ত হয়েছিলেন অতএব কবির স্বীকারােক্তি অনুযায়ী তিনি এর পর দামুন্যা ত্যাগ করেছিলেন। গ্রন্থ রচনাকাল আরাে কিছু বিলম্বিত হওয়াই স্বাভাবিক। তাই অনুমান করা চলে যে, কবিকঙ্কণ সম্ভবতঃ সপ্তদশ শতকের গােড়ার দিকেই তার কাব্য রচনা করেছিলেন; কবিকঙ্কণের কোন কোন পুথিতে গ্রন্থ রচনাকাল-বিষয়ক একটি শ্লোকে আছে—
শাকে রস রসে বেদ শশাঙ্কগণিতা।
কত দিনে দিলা গীত হরের বণিতা।।
এতে তারিখ পাওয়া যায় ১৪৬৬ শকাব্দ (১৫৪৪ খ্রীঃ) অথবা ১৪৯৯ শকাব্দ (১৫৭৭ খ্রীঃ) কিন্তু একালে আকবরের সুবেদার মানসিংহকে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া কবিচন্দ্র মুকুন্দ রচিত ‘বাসুকীমঙ্গল কাব্যে এ শ্লোকটি বর্তমান থাকায় অনুমান করা হয় যে নাম-সাদৃশ্য শ্লোকটি কবিকঙ্কণের গ্রন্থে প্রক্ষিপ্ত হয়ে থাকতে পারে।
কবি গ্রন্থের নাম বলেছেন অভয়ামঙ্গল। গ্রন্থটি অপরাপর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মতই তিনটি খণ্ডে বিভক্ত—দেবখণ্ড, আখেটিক খণ্ড এবং বণিক খণ্ড। কাহিনী গতানুগতিক, তাতে মৌলিকত্ব প্রদর্শনের কোন সুযােগ না থাকলেও কবি ঘটনা-বর্ণনায়, চরিত্র-সৃষ্টিতে এবং সর্বোপরি তার দৃষ্টিভঙ্গিতে অসাধারণ মৌলিকত্বের পরিচয় দিয়েছেন। দেখণ্ডে তিনি হরগৌরীর জীবনযাত্রার যে চিত্র অঙ্কন করেছেন, তাতে দৈবী মহিমা ক্ষুন্ন হলেও তা মানবিক মহিমায় সমুজ্জ্বলতা লাভ করেছে। বস্তুতঃ এই জীবনযাত্রায় নিম্নবিত্ত বাঙালী গৃহস্থ ঘরের যে চিত্র রূপায়িত হয়ে উঠেছে, ঐতিহাসিকদের পক্ষেও এমন নিখুঁত বাস্তব চিত্র অঙ্কন করা সম্ভবপর নয়। বস্তুতঃ এই বাস্তবতার জন্যই কবিকঙ্কণের কাব্য এত উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত হবার সুযােগ পেয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে দ্বিজ মাধবের কাব্যেও বাস্তবতা আছে, তা বস্তুসঞ্চয় মাত্র, কবিকঙ্কণ একই উপাদানকে জীবনরসে নিষিক্ত করে বাস্তবরসে পরিণত করেছেন।
মুকুন্দ চক্রবর্তীর অপর বিশিষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে চরিত্রসৃষ্টিতে। তিনি দেবদেবীর চরিত্রেও মানবিকতার সার্থক প্রকাশ দেখিয়েছে। মানব চরিত্রগুলিকেও মানবিক দোষগুণে সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন তিনি। চরিত্রগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য মুরারি শীল ও ভাড়ু দত্ত। বেনে মুরারি শীল তৎপত্নী বেনেনী অতি স্বল্প পরিসরেই এমন বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে, যার তুলনা শুধু একালের ছােটগল্পেই পাওয়া যেতে পারে। ভাঁড়ু দত্তের চরিত্রটিও এককথায় অনবদ্য। তার পােশাক-পরিচ্ছদ, চলন-বলন এবং কার্যকলাপ একালের সার্থক খলচরিত্র-র সঙ্গেই শুধু উপমিত হতে পারে। দুর্বল দাসীও কবিকঙ্কণের হাতে একটি অতিশয় আকর্ষণযােগ্য চরিত্রে পরিণত হয়েছে। অপরাপর চরিত্রগুলি এতটা স্ফুটোজ্জ্বল না হলেও সেকালের পক্ষে নিন্দনীয় নয়। কবি আখেটিক খণ্ডের নায়ক কালকেতুকে যে ভদ্রবীর করে না তুলে ব্যাধসন্তানরূপেই অঙ্কন করেছেন, তাতে তার স্বাভাবিক বাস্তববুদ্ধিরই পরিচয় পাওয়া যায়। কালকেতুর পরিচয়ে তিনি বলেন—
শয়ন কুৎসিত বীরের ভােজন বিটকাল।
ছােট গ্রাস গেলে যেন তে-আঁটিয়া তাল।।
তেমনি ফুল্লরা তার সখী বিমলার বাড়ি গেলে পর বিমলা যখন বলে—
‘আস্য গাে প্রাণের সই বস্যগাে বুহিনি।
মাের মাথায় গােটা কত দেখত উকুনি।।
তখন তার স্বাভাবিকতায় সন্দেহ করবার উপায় থাকে না। সব মিলিয়ে চরিত্র-সৃষ্টিতে তার সার্থকতা-বিষয়ে ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেন ঃ “মুকুন্দরাম খুব বৃহৎ বিস্ময়কর বিশাল চরিত্র সৃষ্টি করিতে না পারিলেও সাধারণ, প্রত্যক্ষ, পরিচিতি ও পাঁচা-পাঁচি বাস্তব চরিত্রাঙ্কনে অসাধারণ কুশলতা দেখাইয়াছেন।”
বাস্তবতাবােধ, চরিত্র সৃষ্টি ক্ষমতা এবং মানবিকতাবােধের যে পরিচয় কবিকঙ্কণের কাব্যে পরিলক্ষিত হয়, এদের অসাধারণ সমন্বয়ের ফলে একালের সমালােচকদের দৃষ্টিতে কবিকঙ্কণ-চণ্ডী প্রায় উপন্যাসের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। সেকালের প্রখ্যাত মনীযী রমেশচন্দ্র দত্ত কবিকঙ্কণের কাব্য-বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, “The thought and feelings and sayings of his men and women are perfectly, natural, recorded with fidelity which has no parallel in the whole range of Bengali literature.” বিশিষ্ট সমালােচক অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন- “দক্ষ ঔপন্যাসিকদের অধিকাংশ গুণই তাহার ছিল। এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।” বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক অধ্যাপক ডঃ সুকুমার সেনও এ বিষয়ে অভিন্ন মত পােষণ করেন। তিনি বলেন- “নিপুণ পর্যবেক্ষণ, জীবনে আস্থা, ব্যাপক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি যে সব গুণ ভালাে উপন্যাস-লেখকের রচনায় আমরা প্রত্যাশা করি, সে সব গুণ সেকালের পক্ষে যথােচিত পরিমাণে মুকুন্দরামের কাব্যে পাই।” মধ্যযুগের একজন কবির পক্ষে এই সমস্ত গুণ তার অসাধারণত্বেরই পরিচায়ক।
কোন কোন সমালােচক মুকুন্দরামকে ‘দুঃখবাদী বলে অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু এই উক্তির পেছনে কোন তথ্যনিষ্ঠ যুক্তি নেই। সত্য বটে, গ্রন্থ রচনায় বাস্তবতার প্রয়ােজনে কবি যে কয়টি দুঃখদারিদ্রগ্রস্ত জীবনের চিত্র অঙ্কন করেছেন, তাদের যথার্থতা বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এ থেকে কবির জীবনদর্শনের পরিচয় আশা করা মূঢ়তা। তাঁর প্রখর বাস্তবানুভূতির জন্যই দুঃখের চিত্রগুলি এত সজীব হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখকেই যে তিনি জীবনের সত্য বলে গ্রহণ করেন নি, তার পরিচয়ও সর্বত্র বিদ্যমান। তার নিজের কিংবা কোন কাহিনীর পরিণামই দুঃখময় নয়। প্রতিটি দুঃখের শেষেই তিনি আশার আলাে দেখিয়েছেন। অতএব তিনি যে দুঃখবাদী ছিলেন না, এটিই সত্য। বরং দুঃখ বর্ণনার মধ্য দিয়ে আসলে তিনি জীবনের প্রতি অপরিমিত মমত্বেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাই অনেকে তাকে দুঃখবাদী না বলে, ‘দুঃখরসের কবি’ বলাই সঙ্গত মনে করেন।
কবিকঙ্কণ সম্বন্ধে সর্বশেষ কথা—তিনি ছিলেন বাঙালী জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। প্রসঙ্গক্রমে হরগৌরীর জীবনযাত্রার কথা উল্লেখ করা চলে। না বলে দিলে এটিকে দেবতার লীলা বলে বােঝার কোন উপায় নেই। এটিকে গদ্যভাষায় রূপান্তরিত করে অনায়াসে একালের ছােটগল্প বলে চালিয়ে দেওয়া চলে। বস্তুতঃ মুকুন্দ চক্রবর্তী তার কাব্যে এই যে শাশ্বত বাঙালী জীবনের কাহিনী রচনা করেছেন, এটিকেই তাঁর কবিকৃতির সর্বোত্তম সম্পদ বলে গ্রহণ করা চলে।
(গ) অন্যান্য কাব্যকারগণ- চণ্ডীমঙ্গল কাব্য-রচয়িতাদের সংখ্যা একেবারেই মুষ্টিমেয় এবং কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী ও দ্বিজ মাধব ছাড়া অন্য কোন কবির রচনাই তেমন উল্লেখযােগ্য বিবেচিত হয় না।
- মাণিক দত্ত- কবিকঙ্কণ তার কাব্যে মাণিক দত্তকে আদি কবির সম্মান দান করেছেন। এইক্ষেত্রে মাণিক দত্ত ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের অনুমান মতাে ত্রয়ােদশ শতকের লেখক হতে পারতেন। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করেছে প্রাপ্ত মাণিক দত্তের পুথি। মাণিক দত্তের ভণিতাযুক্ত যে পুথি পাওয়া যায়, তাতে চৈতন্যদেব ও তার পরিকরদের বিবরণ থাকায় ডঃ সুকুমার সেন অনুমান করেন, “প্রাপ্ত পুঁথির মাণিক দত্ত অষ্টাদশ শতাব্দের আগেকার লােক না হওয়াই সম্ভব। তিনি খানিকটা পুরানাে মালমসলা ব্যবহার করেছিলেন।” অতএব অনুমান করা চলে, প্রাপ্ত পুঁথির মাণিক দত্ত মুকুন্দ কথিত আদি মাণিক দত্ত নন। সম্ভবতঃ এই মাণিক দত্ত প্রথম মাণিক দত্তের রচনা থেকে কিছু উপাদান আহরণ করেছিলেন। এর আত্মপরিচয়ে জানা যায় ইনি খঞ্জ ও বধির ছিলেন, দেবী চণ্ডীর বরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। মাণিক দত্তের কাব্যে ‘সৃষ্টিপত্তন’ অংশে বৌদ্ধপ্রভাব বর্তমান-অনুরূপ বৌদ্ধপ্রভাব একমাত্র সমসাময়িক কালের ধর্মমঙ্গল কাব্যেই লক্ষ্য করা যায়। ভাড়ু দত্তকে কবি শিবভক্তরূপে বর্ণনা করেছেন—এরি ফলে তিনি চণ্ডীর কোপে পড়েন এবং পরে দেবী দুর্গার শরণ গ্রহণ করে নিষ্কৃতি লাভ করেন। কবির কাব্যের নাম ছিল ‘ভবানীমঙ্গল’ বা দুর্গামঙ্গল।
- দ্বিজ জনার্দন- দ্বিজ জনার্দন-রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটি পাঁচালি’রূপেই পরিচিত। এর মধ্যে ধনপতি সদাগরের কাহিনীই প্রধান কালকেতু কাহিনী এরই অঙ্গীভূত। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন অনুমান করেন যে দ্বিজ মাধব-আদি কবিগণ এ জাতীয় কোন কাব্যকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছিল।
- দ্বিজ রামদেব- গ্রন্থে প্রদত্ত রচনাকাল থেকে জানা যায় যে কবি দ্বিজ রামদেব ১৫৭১ শকাব্দ বা ১৬৪৯ খ্রীঃ তাঁর ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। গ্রন্থকার সম্ভবতঃ পূর্ববঙ্গবাসী ছিলেন। তাঁর কাব্যে রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক শতাধিক উৎকৃষ্ট পদ পাওয়া যায়। গ্রন্থটির সমগ্র অংশ এখনও পাওয়া যায়নি।
- মুক্তারাম সেন- গ্রন্থে প্রদত্ত আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় যে বৈদ্যবংশীয় কবি মুক্তারাম সম্ভবতঃ ১৭৪৭ খ্রীঃ ‘সারদামঙ্গল’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কবির কোন এক পূর্বপুরুষ যশােহর থেকে চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। এঁর কাব্যটি পাঁচালিজাতীয় ক্ষুদ্রকায়—এর ভাষা সরল সহজ, পাণ্ডিত্যবর্জিত।
- দ্বিজ হরিরাম- দ্বিজ হরিরাম রচিত কাব্যটি আকারে সুবৃহৎ। তিনি বিদ্রোহী শােভা সিংহের আশ্রয়ে ছিলেন। অতএব সম্ভবতঃ সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের সন্ধিকালে বর্তমান ছিলেন। তাঁর কাব্যে মুকুন্দরামের প্রভাব সুস্পষ্ট।
- ভবানীশঙ্কর- ১৭৭৯ খ্রীঃ ভবানীশঙ্কর ‘মঙ্গলচণ্ডী পাঞ্চালিকা’ নামে নাতিবৃহৎ কাব্যটি রচনা করেন। কবি পণ্ডিত লােক ছিলেন রচনায় কবিত্ব অপেক্ষা পাণ্ডিত্যের ভারই ছিল অধিক।