‘গুরু’ নাটকে গুরুর স্বরূপ | ‘গুরু’ নাটকের সুভদ্র চরিত্র | ‘গুরু’ নাটকে শূনকদের ভূমিকা | ‘গুরু’ নাটকে দর্ভকদের ভূমিকা

‘গুরু’ নাটকে গুরুর যে স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখাে

রবীন্দ্রনাথের গুরু নাটকে দেখা যায়, গুরুর যথার্থ আগমনের আগেই তার আগমন সম্ভাবনা অচলায়তনে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার মানুষদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। পঞ্চকের কাছে গুরু হলেন মুক্ত পৃথিবীর আহ্বান, যাঁকে স্বাগত জানানাের জন্য জঞ্জালের মতাে আচার-সর্বস্ব পুথিপত্রকে সে সরিয়ে ফেলে।

অন্যদিকে অচলায়তনে যাঁরা শাস্ত্রপন্থী, তাঁরা গুরুর জন্য মাঙ্গল্য নিয়ে সিংহদ্বার সাজাতে যান। স্থবিরপত্তনের রাজা গুরুকে অভ্যর্থনার জন্য অচলায়তনের সমস্ত জানলা বন্ধ করে শুদ্ধিমন্ত্র পাঠের কথা বলেন। অর্থাৎ, গুরু তাঁদের কাছে মন্ত্র আর নিয়মনিষ্ঠার শীর্ষ ব্যক্তি।

যখন গুরুর প্রকৃতই আবির্ভাব ঘটে, তখন তিনি হয়ে ওঠেন বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতির মধ্যে মিলনের কারিগর। তাই দর্ভকদের কাছে যিনি গোঁসাই ঠাকুর, শূনকদের কাছে যিনি দাদাঠাকুর-তিনিই আচার্যের কাছে গুরু। তিনি বিশ্বাস করেন, সকলের সঙ্গে সকলের মিলনেই আত্মার মুক্তি। বদ্ধ অচলায়তনের প্রাচীর শূনকদের সাহায্যে ভেঙে ফেলে সংস্কারের রুদ্ধ পরিবেশে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন মুক্তি আর প্রাণের উল্লাস। বালকদের নিয়ে দাদাঠাকুর বা গুরু খেলতে যেতে চান খােলা জায়গায়, কারণ ‘খােলা জায়গাতেই সব পাপ পালিয়ে যায়’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনসাধনায় জীর্ণজরাকে সরিয়ে দিয়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, গুরু নাটকে অচলায়তনের নিয়ম ভাঙার মধ্যে তারই প্রকাশ ঘটেছে।

‘গুরু’ নাটকের সুভদ্র চরিত্রটি বিশ্লেষণ করাে

‘গুরু’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ প্রথার সঙ্গে প্রাণের যে দ্বন্দ্বকে রূপায়িত করতে চেয়েছেন -তার পরিপ্রেক্ষিতে সুভদ্র চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই নাটকে সুভদ্রের যেসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে, সেগুলি হল :

কৌতুহলী মানসিকতা: সুভদ্রের উত্তর দিকের জানলা খুলে বাইরের দিকে তাকানাে এই কৌতূহলী মানসিকতারই পরিচয়।

কুসংস্কারে বিশ্বাসী: সুভদ্রের বিশ্বাস ছিল, উত্তর দিকের জানলা খােলার জন্য একজটা দেবীর অভিশাপ অনিবার্য। তাই প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য সে উদগ্রীব হয়েছিল। আসলে শাস্ত্রনির্দিষ্ট শিক্ষা, প্রথার প্রতি তীব্র আনুগত্য নিয়েই গড়ে উঠেছে সুভদ্রের মন।

মানসিক দ্বন্দ্ব: উত্তর দিকের জানলা খােলার অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ছ-মাস মহামসের বিধান দিয়েছে। মহাপঞ্ক। অন্যদিকে তাকে আড়াল করতে চেয়েছে পঞ্চক এবং আচার্য। আর এই দ্বন্দ্বেই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সুভদ্র। পঞ্চকরা তাকে নিয়ে গেলেও মহাতামস ব্রত পালন করার জন্য আবার উপাধ্যায়-মহাপঞ্কদের কাছে ফিরে আসে সুভদ্র।

নাটকের শেষে অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে পড়ায় তার প্রায়শ্চিত্ত শেষ না হওয়ার ফলে সুভদ্র রীতিমতাে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। কিন্তু সুভদ্রকে অভয় দেন দাদাঠাকুর। পঞ্চক সুভদ্রকে আহ্বান জানায় দুজনে মিলে চারিদিকের দরজা-জানলা খুলে দেবার জন্য। নাট্যদ্বন্দ্ব অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সুভদ্রেরও মানসিক দ্বন্দ্বমুক্তির নিশ্চিত ইঙ্গিত থাকে সেই আহ্বানে।

‘গুরু’ নাটকে শূনকদের ভূমিকা আলােচনা করাে

অচলায়তন নাটকে যারা ছিল শােণপাংশু, ‘গুরু’ নাটকে তারাই হল যূনক। অচলায়তনের চোখে তারা অস্পৃশ্য। অচলায়তনের প্রাচীর ডিঙিয়ে যুনকদের কাছে যাওয়া পঞককে শূনকরা জানিয়েছে—“আমরা নাচবার সুযােগ পেলেই নাচি, পা দুটোকে স্থির রাখতে পারি নে।” অচলায়তনের শাস্ত্র আচারে বদ্ধ জীবনযাপনের বিরুদ্ধে যেন প্রতিবাদ ঘােষিত হয় শূনকদের এই সংলাপে। তারা গুরুবাদে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে কাজে। যুনকরা বিশ্বাস করে, দাদাঠাকুর গেলে অচলায়তনের পাথরগুলাে পর্যন্ত নাচতে শুরু করবে, পুথিগুলাের মধ্যে বাঁশির সুর শােনা যাবে।

যুনকরা অন্ধ সংস্কারে বিশ্বাসী নয় বলেই যুক্তিবাদী। প্রথম যূনক তাই পঞ্চকের কাছে জানতে চায় যে, কাকুড় ও খেসারি ডাল খাওয়ার ক্ষেত্রে অচলায়তনিকদের কোনাে নিষেধ নেই, অথচ সেই জিনিসগুলি নিজের হাতে চাষ করা কেন অন্যায় বা পাপ? দ্বিতীয় যূনক পঞ্চ কে প্রশ্ন করেছিল, তাদের পিতামহ বিষ্কণ্তী কেন কাঁকুড়ের মধ্যে হঠাৎ জন্মগ্রহণ করতে গেলেন? যূনকরা যুক্তিনির্ভর ছিল বলেই পঞ্চকের কোনাে কথাকেই নির্বিচারে না মেনে বারংবার তাকে প্রশ্নের দ্বারা বিরক্ত করে তুলেছিল।

শূনকদের প্রাণশক্তিকে কাজে লাগিয়েই শেষপর্যন্ত অচলায়তনের নিষেধ ও সংস্কারের প্রাচীর ভেঙে ফেলেন দাদাঠাকুর। দর্ভকদের সঙ্গে যূনকরাও গেয়েছে গুরুকে স্বাগত জানানাের গান, সে গানে সমস্ত বন্ধনের ক্ষয় হওয়ার সুর বেজে ওঠে।

‘গুরু’ নাটকে দর্ভকদের ভূমিকা আলােচনা করাে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে অচলায়তনে যে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাস প্রচলিত আছে, দর্ভকরা প্রান্তবর্তী হয়েও তার থেকে মুক্ত নয়। তাদের ছোঁয়া খাবার পঞ্চকদের দিতে তাই দর্ভকরা সংকুচিত হয়ে ওঠে, কিংবা “আমরা নীচ জাত- -এ কথা তারা সহজেই বলতে পারে। কিন্তু অচলায়তনের মানুষদের সঙ্গে দর্ভকদের পার্থক্য হল এই যে, শাস্ত্রশিক্ষা অচলায়তনের মানুষদের মধ্যে যে অহংকারের জন্ম দিয়েছে, তা থেকে শাস্ত্রজ্ঞানহীন দর্ভকরা মুক্ত। গুরুকে সম্ভাষণ বা স্বাগত জানানাের সময়েও তাদের এই চারিত্রিক বিনয়কে আলাদা করে লক্ষ করা যায়। গুরুর স্নানের জল কে তুলে আনলে তিনি সন্তুষ্ট বােধ করবেন, সেটা দ্বিতীয় দর্ভক গুরুর কাছ থেকেই জানতে চায়।

দর্ভকরা অতিথি আপ্যায়নে যথেষ্ট আন্তরিক। তাই বাড়িতে শুধু ভাত ও মাষকলাই রান্না হলেও তাদের প্রিয় গোঁসাই ঠাকুরের জন্য তারা ব্যবস্থা করতে চেয়েছে বনের জাম,. খেজুর বা কালো গােরুর দুধ।

দর্ভকরা শাস্ত্র জানে না, তারা কেবল নামগান করে। কিন্তু অজ্ঞতা থেকেই অচলায়তনে লড়াইয়ের খবর পেয়ে তারা তাতে অংশ নিতে চায়, অচলায়তনের পাশে দাঁড়াতে চায়।

নাটকের শেষে অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে পড়লে সেখানে দাদাঠাকুর, যূনকদের সঙ্গে দর্ভকরাও উপস্থিত থাকে। কিন্তু তাদের উপস্থিতি ছিল নিছক দর্শকের মতাে। শেষ অবধি অবশ্য গুরুর বন্দনাগানে শূনকদের সঙ্গে তাদেরও মিলিয়ে দেন নাট্যকার।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment