ক্রুসেডের উদ্দেশ্যসমূহ
[১] মূল উদ্দেশ্য: জিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি প্যালেস্টাইনের জেরুজালেম ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র তীর্থস্থান। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কিরা জেরুজালেমের দখল নেয়। তুর্কিরা খ্রিস্টানদের চার্চের পাশে মসজিদ তৈরি করে। অপর দিকে মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম ছিল হজরত মহম্মদ (সাঃ), হজরত মুসা ও হজরত দাউদের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্রভূমি। তাই খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয় জাতিই জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষায় উদ্যত হয়।
[২] অন্যান্য উদ্দেশ্য
- বাইজানটাইন সাম্রাজ্য রক্ষা: একাদশ শতকে সেলজুক তুর্কিরা ইউরােপের দিকে বিজয়াভিযান শুরু করে। পশ্চিমে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যভুক্ত এশিয়া মাইনরের একাংশ তারা দখল করে। এরপর তারা কনস্ট্যান্টিনােপলের দিকে অগ্রসর হলে পূর্ব রােমের বাইজানটাইন সম্রাট আলেক্সিয়াস ভীত হয়ে পড়েন।
- পােপের হারানাে গৌরব পুনরুদ্ধার: একাদশ শতকে রােমান ক্যাথলিক চার্চ ও গ্রিক চার্চের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ফলে উভয় চার্চের মধ্যে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এর ফলে পােপের ক্ষমতা ও মর্যাদা অনেকটাই হ্রাস পায়। এই হারানাে গৌরব পুনরুদ্ধারে পােপ ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের আহ্বান জানান।
- নতুন স্থান দখল: সেলজুক তুর্কিদের আক্রমণের ফলে আরব দুনিয়ায় বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। এই সুযোগে বাইজানটাইন শাসকগণ আরব ভূখণ্ডের কিছুটা অংশ দখলের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও বাণিজ্যের সমৃদ্ধির জন্য ক্রুসেডের মাধ্যমে নতুন স্থান দখলের প্রয়ােজন ছিল। তাই ইটালির বণিকরা আরব বণিকদের হটিয়ে তাদের স্থান দখলের উদ্দেশ্যে ক্রুসেডে যােগ দেয়।
- অর্থলাভ: অভিজাতদের মধ্যে যে অংশ তুলনায় আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল, তারা ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে আরও ধনী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা করেছিল৷ ইটালির বণিকরা কুসেডের মাধ্যমে কনস্ট্যান্টিনোপল ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখেছিল।
- অন্যান্য: ক্রুসেডে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। (a) সামন্তপ্রভুরা চেয়েছিল প্রাচ্যে নতুন ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে সেখানে সামন্তপ্রথার প্রবর্তন ঘটাতে। (b) সার্ফরা (ভূমিদাস) চেয়েছিল কুসেডে যােগ দিয়ে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেত। (c) বেকার ও ভবঘুরেরা প্রাচ্য দেশে কর্মসংস্থানের আশায় বুক বেঁধেছিল। (d) নাইটদের অন্তরে ছিল দক্ষতা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা। (e) ধর্মযুদ্ধে শহিদ হলে স্বর্গলাভের প্রত্যাশা দেওয়া হয় কুসেডারদের।
পােপের ক্ষমতা বৃদ্ধি
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের আগে রােম সাম্রাজ্যে পােপের ক্ষমতা খুব বেশি ছিল না। ক্রুসেডগুলিতে নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে পােপের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও আত্মসম্মান বেড়ে যায়।
[1] ক্রুসেডের নেতৃত্বের মাধ্যমে: পােপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সম্রাট, সামন্ত, বণিক ও কৃষক শ্রেণি ক্রুসেডে যোগ দেয় ও পােপের পরােক্ষ নেতৃত্ব মেনে নেয়। আর ধর্মযুদ্ধে অংশ না নেওয়া সমাজের অবশিষ্টরাও পােপের এই ভূমিকায় শ্রদ্ধাবনত হয়। পােপ খ্রিস্টান জগতের কাছে সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।
[2] সামন্তদের ক্ষমতা হ্রাসের সুবাদে: সামন্তপ্রভুরা কুসেড যাত্রার আগে তাদের সব ভূসম্পত্তি ধর্মীয় সংগঠনের নামে উইল করে দিয়ে যায়। ক্রুসেডে যােগদানের ফলে এই সামন্ত শ্রেণি সর্বস্বান্ত হন। এ ছাড়াও ক্রুসেডে বহু সামন্তের মৃত্যু হয়। এর ফলে ইউরােপে সামন্ত শ্রেণি দুর্বল হয়ে পােপের ক্ষমতা বৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করে।
[3] পূর্বাঞ্চলীয় চার্চের প্রতিপত্তি হ্রাসের সূত্রে: বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের চার্চ বা গ্রিক চার্চ অনেকটাই বাইজানটাইন রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ক্রুসেডের যুদ্ধগুলির ফলে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয় এবং গ্রিক চার্চের প্রতিপত্তিও কমে। যায়। পক্ষান্তরে রােমান চার্চ তথা পােপের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।
[4] অর্থ ও সম্পদ লাভের মাধ্যমে: পােপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বা পুণ্যলাভের আশায় ইউরােপের নানা প্রান্তের মানুষ যুদ্ধের খরচ জোগানের জন্য সস্তায় তাদের ভূসম্পত্তিগুলি চার্চ বা মঠের কাছে বিক্রি বা দান করে দেয়। এ ছাড়াও, ক্রুসেডের খরচ তােলার দোহাই দিয়ে পােপ ইনডালজেন্স বিক্রি করে বা নানা কর ধার্য করে প্রচুর অর্থ লাভ করে।