ভাড়ুদত্তের কাহিনী / ভাড়ুদত্তের পরিণতি
দেবী চণ্ডীর কৃপাই ব্যাধসস্তান কালকেতু প্রচুর ধনের অধিকারী হ’য়ে বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করে, কিন্তু তথায় কোনো প্রজা না আসায় কালকেতু দেবীর শরণ গ্রহণ করে। দেবী তখন কলিঙ্গ রাজ্যে বন্যা বইয়ে দিলেন। সেই বন্যায় যখন প্রজারা সর্বস্বান্ত হয়ে হা হুতাশ করছে, তখনই আমরা ভাড়ুদত্তকে দেখতে পাই। ভাড়ুদত্ত দুঃখ ক’ৱে বলছে-
‘ভাড়ুদত্ত বলে মোর করমের ফল।
আমার দুয়ারে জল হইল অঞ্চল।।
উঠানে ডুবিয়া মরি না জানি সাঁতার।
জটে ধরি মাণ্ড মোরে করিল উদ্ধার।।”
তখন বুলান মণ্ডল প্রস্তাব দিলো—এ অবস্থায় সকলেরই ওজরাট নগরে চলে যাওয়া উচিত, সেখানে নানারকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। তখন ভাঁড়ু রাজার দোহাই দেয়। বুলান তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে— ‘আওয়ান তোমার প্রজা তুমি সে ঠাকুর।’
তোয়াজে তুষ্ট হ’য়ে ভাড়ুদত্ত কলিঙ্গের প্রজাদের সঙ্গে গুজরাটে উপস্থিত হ’ল। কাঁচাকলা ভেট নিয়ে আগে চলে ভাঁড়ু তার পেছনে তার শালা। তার বর্ণনা করেছেন কবি—
‘ভালে ফোটা মহাদস্ত ছেঁড়া ধূতি কোচা লম্ব
শ্রবণে কলম খরশাণ।’
ভাঁড়ুদত্ত প্রথমেই কালকেতুর সঙ্গে খুড়া সম্পর্ক পাতিয়ে কম্বলাসনে বসে হাতনাড়া দিয়ে আত্মপরিচয় দিলো –ভাড়ু আমলহাঁড়ার দত্ত, কায়স্থকুলে সে প্রধান এবং শ্রেষ্ঠ কায়স্থদের সঙ্গে তার সম্পর্ক—
‘দুই নারী মোর ধন্যা ঘোষ বসুর কন্যা
মিত্ৰে কৈল কন্যা-সমৰ্পণ ।।
গঙ্গার দুকুল কাছে যতেক কুলীন আছে।
মোর ঘরে করয়ে ভোজন।।’
ভাড়র বৃহৎ পরিবার–দুই নারী, চারি শালা, চাঁর পুত্র, বোন, শাশুড়ি, ছয় ঝি, ছয় জামাই। সবার জন্য চাই ঘর-বাড়ি জমিজমা, হাল-বলদ, ঢেঁকি-কুলা ইত্যাদি। এর উপরও ভাড়ুর দাবি—
‘আমি পাত্র রাজা তুমি আগে পুজা পাব আমি
পরিণামে ভাড়ুরে জানিবে।’
কালকেতু সসম্মানে ভাডুকে গ্রহণ করলো। ভাঁড়ু প্রথম থেকেই কালকেতুকে কুমন্ত্রণা দিতে আরম্ভ করলো। একদিকে সে ভরসা দিল যে তাকে সমস্ত ভার দিলে সে বিধিব্যবস্থা মতো বহু প্রজা বসাবে, কিন্তু তাদের পুরো শস্য নিয়ে যেতে দেবে না –
‘যখন পাকিবে খন্দ পাতিবে বিষম দ্বন্দ্ব
দরিদ্রের ধনে দিবে নাগা।’
এরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, তারও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এরপরই ভাড়ুদত্ত মনোদুঃখ প্রকাশ করে বললো-“এই বুলান মণ্ডল তার চিঠা নিয়ে বেড়াতো, তাকে মণ্ডল পদ দেওয়াটা সঙ্গত হয়নি, কারণ সে—
‘পরি দু-পণের কাচা ভাণিত আমার ভাচা
সেই বেটা হবে দেশমুখ।
নফরের হাতে খা বহুড়ির হাতে ভাণ্ডা
পরিণামে দেই অতি দুখ।’
‘এদিকে গুজরাট নগর জমজমাট হয়ে উঠলো, এখানে হাটপত্তন করা হল, হাটে বহু হাটুরিরাও এসে উপস্থিত হ’ল। কিন্তু প্রথম থেকেই ভাড়ু এদের ওপর উপদ্রব শুরু করলো।
পশারিয়ারা পশরা নিয়ে হাটে বসে, ভাড়ুদণ্ড হাটে প্রবেশ করলেই ‘পশারী পশরা ঢাকে ভাড়ুর তরাসে। পশরা লুটপাট করে নেয় ভাড়, কিন্তু পয়সা কড়ি দেয় না কাউকে, সব লণ্ডভণ্ড ক’রে দিয়ে হাটুরেদের গালি দিয়ে বলে—
‘আমি মহামণ্ডল আমার আগে তোলা।’
জবরদস্তি কাঁরে ভাড়ুদত্ত তোলা আদায় করে। শুধু তাই নয়, —
‘জটে ধরি কিল লাথি মারে তার ঘাড়ে।’
এইভাবে যখন হাটুরেদেরে ওপর ভাঁড়ু অত্যাচার চালায়, তখন নগর-পরিভ্রমণরত কালকেতুর কাছে প্রজারা সব ভাড়ুদত্তের বিরুদ্ধে নালিশ জানায়। তার সমস্ত অত্যাচার কাহিনীর বিবরণ দিয়ে বলে—
‘জানে ভাঁড়ু নানা ছলা পরদ্বন্দ্বে ধরে ছলা
টাকা সিকা নিত্য খায় ধুতি।’
আর শুধু ভাড়ুদত্তের নয়, তার ছেলের কুকীর্তির কথাও তারা প্রকাশ ক’রে দেয় –
‘বহুড়ি জলতে যায় আহড়ে থাকিয়া চায়
দূর হৈতে ফেলি মারে ঢেলা।’
এ সমস্ত শুনে কালকেতু ভাড়ুর কাছে দূত পাঠালো। ভাড়ু এসে কালকেতুকে নমস্কার জানালে কালকেতু তার বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ এসেছে, সেগুলি বর্ণনা ক’রে তাকে উপদেশ দিল—
‘আপনি রাখিলে রহে আপন মহত্ত্ব।’
উত্তরে ভাড়ু জানালো যে তার যা পাওনা, তা সে আদায় করবেই; তার প্রজারাই এখানে কালকেতুর প্রজা হ’য়েছে কাজেই এ জন্য তাকে কিছু বলা কালকেতুর উচিত নয়। কালকেতু ভাড়ুদত্তের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়নি, বরং সে ক্রুদ্ধ হয়েই বলে—
‘প্ৰজা নহি মানে বেটা আপনি মণ্ডল।
নগর ভাঙ্গিলি ঠকা করিয়া কোন্দল।।’
কালকেতুর ভর্ৎসনায় অপমানিত হয়ে তাড়ুও স্বমূর্তি ধারণ করলো, সেও কালকেতুর পুরানো ইতিহাস বলে তার গৌরব লাঘব করলো—
‘তিন গোটা শর ছিল এক গোটা বাঁশ।
হাটে হাটে ফুল্লরা পশরা দিত মাস।।’
কালকেতু এবার ভাডুকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলো। যাবার সময় ভাঁড়ু বলে গেলো—
‘হরিদত্তের বেটা হই জয়দত্তের নাতি।
হাটে লয়্যা বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতি।।
তবে সুশাসিত হ’বে গুজরাট ধরা।
পুনর্ব্বার হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা।।’
কালকেতুর সর্বনাশ সাধনের চিন্তা মাথায় নিয়ে ভাড়ু কালকেতুর রাজসভা ত্যাগ ক’রে কলিঙ্গযাত্রা করলো। স্ত্রীর শাড়ি কোচা দিয়ে প’রে কাচকলা, পুই শাক আর কলার মোচা ভেট নিয়ে ভাড়ু চললো রাজদর্শনে—
‘মস্তকে বান্ধিল পাতা নাহি ঢাকে কেশ।
মৃত্তিকার তিলক কৈল রঞ্জিত কৈল বেশ।।
কৈফিয়তী পাঁজিখান নিল সাবধানে।
শ্রীহরি বলিয়া ভাড়ু কলম গোঁজে কানে।।’
ভাঁড়ুর বড় ভাই শিবা—পায়ে গোদ ব’লে তার পয়তাল্লিশ বছর বয়সেও বিয়ে হয়নি। এবার ভাড়ু যদি মোড়ল হ’তে পারে, তবে তার বিবাহের ব্যবস্থা করবে—এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার মাথায় ভেটের বোঝা চাপিয়ে ভাড়ু কলিঙ্গরাজ্যের সভায় উপনীত হ’ল। অনুমিত হয়, ভাঁড়ু পূর্ব থেকেই কলিঙ্গরাজের পরিচিত ছিল। হয়তো তার সভাসদও ছিল; নিদেনপক্ষে এই রাজসভায় যার যাতায়াত ছিলই। তারপর মধুর সন্ধান পেয়ে এই সভা ত্যাগ করে কালকেতুর সভায় মোড়লী করতো। যাহোক্ কলিঙ্গরাজ তাঁকে সহাস্যে সম্বর্ধনা জানিয়ে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে ভাড়ুদত্ত কালকেতুর কাহিনী বিবৃত ক’রে জানালো যে ব্যাধসস্তান কালকেতু রাজা হ’য়ে কলিঙ্গের সব প্রজাকে নিজের রাজ্যে নিয়ে গেছে। এ সমস্ত ভাড়ু দেখে এসেছে–এর একটি কথা যদি মিথ্যা হয় তবে ভাড়ুর যেন প্রাণদণ্ড হয়। রাজা কোটাল পাঠিয়ে তার কথার সত্যতা পরীক্ষা করুন।
ভান্ডুর কথায় উত্তেজিত হয়ে কলিঙ্গরাজ তৎক্ষণাৎ কোটালকে খবর আনতে পাঠিয়ে দিলেন। কোটাল সন্ন্যাসীর বেশে গুজরাট পরিভ্রমণ করে এসে ভাড়ুর বিবৃতিকে সত্য বলে স্বীকার করলো। ভাঁড়ুর প্ররোচনায় কলিঙ্গরাজ সৈন্য সজ্জা ক’রে গুজরাট রাজ্য আক্রমণ করলেন। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হ’ল এবং সেই যুদ্ধে কালকেতুর বিক্রমের কাছে হতমান হয়ে কলিঙ্গ সৈন্যগণ পরাজয় বরণ করলো।
বালিগরাজের পরাজয়ে ভাড়ুর দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পেলো কারণ তার পরিবার-পরিজন রয়ে গেছে গুজরাটে। তাই কলিঙ্গ সৈন্যদের পুনর্বার যুদ্ধে যাবার জন্য কোটালকে উত্তেজিত করে তুলতে বলে—
‘এক লক্ষ টাকা তুমি খাইলে যে ধুতি।
ভাঁড়ু দত্ত জীতে পালাইয়া যাবে কতি।।’
এ কথায় ভয় পেয়ে কোটাল আবার গুজরাট আক্রমণ করলো। এবার স্ত্রীবুদ্ধিতে প’ড়ে কালকেতু আর যুদ্ধোদ্যোগ না করে ধন ঘরে (ধান্য ঘরে) আত্মগোপন করলো। এদিকে কলিঙ্গপক্ষ কালকেতুর কোন সাড়া না পেয়ে চিন্তিত হ’ল। তখন ভাঁড়ুদণ্ড এক ব্রাহ্মণকে সঙ্গে নিয়ে কালকেতুর পুরীতে উপস্থিত হ’য়ে ফুল্লরাকে নমস্কার করে জানালো যে কলিঙ্গরাজ কালকেতুর বীরত্বে তুষ্ট হ’য়ে তাকে ক্ষমা করেছেন এবং তার সঙ্গে সন্ধি করবার জন্য এই ব্রাহ্মণকে তার সঙ্গে দিয়েছেন। তারপর ভাড়ু নানাভাবে তার সদিচ্ছার কথা বলতে লাগলো। সরলা ফুল্লরা শঠচূড়ামণি ভাড়ুর কথায় বিশ্বাস করে ধনঘরের দিকে তাকালো। এদিকে কোটাল ভাড়ুর বিলম্ব দেখে পুরীতে এসে প্রবেশ করলো। এখানে সহজেই কালকেতু বন্দী হ’ল। কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে কারাগারে পাঠালে সেখানে কালকেতু চৌতিশাস্রুতিতে দেবী চণ্ডীকে তুষ্ট করলে দেবী কলিঙ্গরাজকে স্বপ্নে আদেশ করলেন কালকেতুর মুক্তি বিধানের জন্য। তদনুযায়ী কালকেতু মুক্তি পেয়ে আবার রাজসিংহাসনে বসলো।
চতুরক চূড়ামণি ভাঁড়ু কিন্তু এতে একটুও দমে যায়নি। সে আবার ভেট নিয়ে কালকেতুর সভায় উপস্থিত হয়ে বলে—
‘তুমি খুড়া হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আমি কান্দি
বহু তোমার নাহি খায় ভাত।’
কালকেতু ভাঁড়ুর স্বরূপ জানতে পেরেছে, কাজেই এবার আর ভুল করলো না। সভার মধ্যে কালকেতু ভাড়ুর কুকীর্তির কথাই শুধু প্রকাশ করেনি, তার জাতিত্বের গর্বও খর্ব করলো—
‘হয়্যা বেটা রাজপুত বোলহ কায়স্থসুত
নীচ হৈয়া উচ্চ অভিলাষ।’
তাড়ু এতেও নিরস্ত হয়নি, সে তখনো কালকেতুকে ভয় দেখাচ্ছে—
‘শিয়রে কলিঙ্গ রায় গোহারি করিয়া তায়
খারিজ করিব বাড়ি ঘর।’
এবার উত্তেজিত হয়ে কালকেতু আদেশ করলো ভাড়ুর মাথা মুড়িয়ে মুখে অভক্ষ্য পুরে দিয়ে এবং দুই গালে চুনকালি এঁকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করা হোক। তার আগে ভাড়ুর কাছে পাওনা তিন সনের খাজনাও দাবি করলো কালকেতু।
কালকেতুর ইঙ্গিতে নাপিত ঘোড়ার মূত্র দিয়ে ভাড়ুর মাথা ভিজিয়ে ভোতা ক্ষুর দিয়ে মাথা চেঁছে দিলো, তার পাঁচ স্থানে চুল রেখে দিলো। নাক-সাড়া দিয়ে তার দাড়ি উপরেও দিলো— রক্তে মুখ ভেসে গেলো। তারপর ভাঁড়ুর এক গালে চুন অপর গালে কালি মাখানো হ’ল। কেউ কেউ তার মাথায় ঘোল ঢাললো, কেউ কেউ তার পেছনে ঢোল বাজাতে লাগলো। মালাকার ভাড়র গলায় ওড়ফুলের মালা পরিয়ে দিলো। নগরের ছেলেরা তার পিছনে লেগে টিকারি দিতে লাগলো। বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে কেউ তাকে বেদম পিটালো, এমন কি কুলবধূরাও কালহাঁড়ি দিয়ে তাকে মারধর করলো।
শেষ পর্যন্ত ভাড়ুর যথেষ্ট অপমান ও শিক্ষা হয়েছে বিবেচনা করে কালকেতু তাকে ক্ষমা করলো এবং আবার বাড়িঘর ফিরিয়ে দিলো।