‘কর্তার ভূত’ রচনায় ওঝা প্রসঙ্গটির তাৎপর্যটি লেখাে
কর্তার ভূত রচনার মধ্য দিয়ে লেখক রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতবাসীর নির্বিকার গতানুগতিক জীবনপ্রণালীকে বিদ্রুপ করেছেন। এদেশের মানুষ ‘ভূত’ অর্থাৎ অতীতের জরাজীর্ণ সংস্কারকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে ভালােবাসে। কর্তা মরলে কর্তার ভূতও তাই তাদের কাছে নতুনের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযােগ্য। ফলে নতুনত্বের আহ্বানে এরা সহজে সাড়া দিতে পারে না।
তাই অন্য দেশের প্রগতির সঙ্গে এরা তাল মিলিয়ে চলতেও পারে না। উলটোদিকে অন্য দেশগুলিকে ভূতে পায় না, পেলেও তারা দ্রুত ওঝার ব্যবস্থা করে। অর্থাৎ সেদেশগুলিতে প্রাচীনত্বের রেশ কাটাবার ব্যবস্থা থাকে। সে ব্যবস্থা করে থাকেন ওঝা অথচ এদেশের মানুষ সেই প্রাচীনত্বকেই আঁকড়ে থাকে, যা এক অর্থে স্থবিরতা।
আবার যারা বিদেশে গিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় অভিভূত হয়ে দেশে তা প্রয়ােগ করতে চান, সমাজের উচ্চপদস্থ ধর্মের ধ্বজাধারীরা তাদেরকেই অপবিত্র বলে দূর করে দেয়।
কিন্তু প্রাচীনপন্থী ভারতবাসীর ভূত ছাড়াবার মতাে ওঝার বড়াে অভাব এদেশে। তাই ভারতবাসীর উন্নতি হয় না, অন্যের শাসনের অত্যাচারে পিষ্ট হতে থাকে ক্রমাগত। আসলে মানুষের সচেতনতা না এলে পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই সচেতনতা বাড়ানাের জন্য ভালাে ওঝার প্রয়ােজনের কথা লেখক বলেছেন।
“সে ভবিষ্যৎ ভ্যাও করে না ম্যাও করে না” -সে ভবিষ্যৎ ভ্যা বা ম্যা করে না কেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘কর্তার ভূত’ নামক রচনায় উল্লিখিত বাক্যাংশে সে ভবিষ্যৎ বলতে ‘ভূতশাসনতন্ত্র’-এর অন্তর্ভুক্ত বিচার-বুদ্ধিহীন মানুষের ভবিষ্যতের কথা বলা হয়েছে। কথােপকথনের ভঙ্গিতে চলিত ভাষায় লেখা হলেও ভাষার একটা বাকবৈদগ্ধ্য এখানে লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের ব্যবহারও করেছেন নিপুণ ভঙ্গিতে।
ভেড়া কিংবা ছাগলেরা পর্যন্ত ডাক দেয় কিন্তু ভূতের শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকা সাধারণ মানুষের মুখে রা পর্যন্ত নেই। তারা প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের মৃত সংস্কার আঁকড়ে থাকে, কোনাে প্রশ্ন করে না।
যা প্রচলিত, যা অপরিবর্তনীয় তার প্রতিই আসক্তি তাদের। তাই তারা ভাবে বুড়াে কর্তা চলে গেলে তাদের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠবে।
দেশবাসীর কথা ভেবে কর্তা মহাশয়ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। সমস্যার সমাধান করতে ভগবান জানান যে, দেশবাসীর চিন্তার কিছু নেই, মৃত্যুর পরও কর্তা থাকবেন। ভূত হয়ে চিরদিন তাদের ঘাড়ে চেপে থাকবেন, কারণ ভূতের মৃত্যু নেই। তাই ভবিষ্যতে ভূত থাকবে, ভূতশাসনতন্ত্রও থাকবে।
পরাধীন ভারতবর্ষের পটভূমিতে দেখলে ব্রিটিশ শাসনই হল কর্তার ভূত। এই শাসনতন্ত্রই ভারতবাসীকে কুসংস্কারের আবর্তে বীর্যহীন, প্রতিবাদহীন করে রেখেছে।
“কেননা ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেছে”- ওঝাকে ভূতে পেলে কী ক্ষতি হওয়ার কথা লেখক বলেছেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কর্তার ভূত’ রচনায় দেশের মানুষকে যখন ভূতে পায় তখন তাদেরকে ভূত ছাড়ানাের প্রসঙ্গে ওঝার কথা এনেছেন। লেখকের মতে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই প্রাচীনপন্থী। অতীতের জরাজীর্ণ সংস্কার নিয়ে বেঁচে থাকতেই তারা বেশি ভালােবাসে।
কাউকে ভূতে পেলে ওঝা তুকতাক মন্ত্র আউড়ে, ঝাঁটা-জুতাে দিয়ে মেরে ভূতে পাওয়া মানুষের ঘাড় থেকে ভূত নামায়। তাই দেশে ভূতের বাড়াবাড়ি ঘটলে ওঝার খোঁজ পড়ে। ভালাে ওঝা ভূতের প্রভাব দূর করে মানুষকে বাস্তব-চেতনা দান করতে পারে। মানুষকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার শিক্ষা দেয় সে। দেশের অগ্রগতিতে তাই ওঝার একটা গুরুত্ব থেকেই যায়। কিন্তু এদেশে সে পথ বন্ধ। কারণ এদেশে ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়েছে।
এদেশের ওঝা নিজেই অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। সে অতীত সংস্কারগ্রস্ত। অতীতের নিয়মনীতি, ভাবনা বাদ দিয়ে এক পা-ও চলতে পারে না। ওঝা নিজে ভূতগ্রস্ত হয়েই ভূতের চিকিৎসা করে বলে কোনাে ফল পাওয়া যায় না। তাই কর্তার ভূত এদেশের মানুষকে ছেড়ে যায় না।
ভুতুড়ে জেলখানায় এদেশের মানুষ বন্দি। তারা দিবারাত্র ঘানি টেনে চলে কিন্তু তেল বেরােয় না। তাই দেশ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
‘কর্তার ভূত’- কি নিছক ভূতের গল্প, নাকি রাজনৈতিক রূপক কাহিনি? ব্যাখ্যাসহ লেখাে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা লিপিকা গ্রন্থে ‘কর্তার ভূত’ রচনাটি আসলে একটি কথিকা। এর মধ্য দিয়ে লেখক মানুষের চিরকালীন অভ্যাসের সমালােচনা করেছেন।
ভূতের কথা বললেও এটি কোনাে ভৌতিক রহস্যময় গল্প নয়। এটি নিছক কোনাে রাজনৈতিক রূপক কাহিনিও নয়। এখানে রূপকের আড়ালে লেখক মানুষের ওপর চেপে বসা চিরকালীন কুসংস্কারের তীব্র সমালােচনা করেছেন।
‘ভূত’ বলতে এখানে অতীতকে বােঝানাে হয়েছে। অতীতকাল থেকেই আদিম মানুষ গােষ্ঠীবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত। তখন তাদের যাবতীয় ভাবনাচিন্তা তারা অর্পণ করেছিল দলের প্রাচীন ও নেতাস্থানীয় ব্যক্তির ওপর।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্তার মৃত্যু ঘটলেও তার ভূত অর্থাৎ অতীত ধারণা এদেশের মানুষকে ছেড়ে যায়নি। সে প্রতি পদে পদে এদের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সেই জেলখানায় অনেক নিয়মের চাপে পড়ে ঘানি ঘােরাতে ঘােরাতে মানুষ তার তেজ এবং অগ্রগতির পন্থাকে হারিয়ে ফেলে।
ভূত বলে প্রকৃত কোনাে বস্তু বা শক্তি কিছুই নেই যাকে অনুভব করা যায়। এটা প্রাচ্যের মানুষের মনে বাসা বেঁধে থাকা এক চিরকালীন ভয়। এই ভয়ই তাকে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দেয় না। আধুনিক চিন্তাভাবনার পথে এক পা বাড়ালে তার মনের ভয় তাকে বলে ওঠে সে অশুদ্ধ হয়ে যাবে, প্রকৃত প্রাচীন ঐতিহ্যের গর্বকে হারিয়ে ফেলবে।