কবি বিহারীলালের কাব্যপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য | উনিশ শতকের আখ্যানকাব্য ও মহাকাব্য | বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যচর্চা

আখ্যানকাব্যের সাধারণ পরিচয় দিয়ে উনিশ শতকের আখ্যানকাব্যগুলি উল্লেখ করাে।

আখ্যানকাব্য: বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যেসব আখ্যানকাব্যের পরিচয় আমরা পাই, তা ছিল দেবদেবীর মাহাত্মজ্ঞাপক অথবা দৈব-নিরপেক্ষ নরনারীর প্রেমের উপাখ্যান। কিন্তু উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পাশ্চাত্য আদর্শে যেসব আখ্যানকাব্য রচিত হয়েছিল, সেগুলি ছিল ইতিহাস আশ্রিত এবং স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবােধে পরিপূর্ণ। এই আখ্যানকাব্যগুলির উৎস কিংবদন্তি বা ইতিহাস হলেও এগুলিতে কবিকল্পনা স্থান পাওয়ায় কখনাে কখনাে তা সমসাময়িক হয়ে উঠেছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আখ্যানকাব্যের শ্রেষ্ঠ চারজন কবি হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭), হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) এবং নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯)। মধুসূদনের ‘তিলােত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০), রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮), ‘কর্মদেবী’ (১৮৬২), ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮) ও ‘কাঞীকাবেরী’ (১৮৭৯), হেমচন্দ্রের বীরবাহু কাব্য (১৮৬৪), ‘চিন্তাতরঙ্গিণী’ (১৮৬১) ও ‘আশাকানন’ (১৮৭৬) এবং নবীনচন্দ্রের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৫), ‘ক্লিওপেট্রা’ (১৮৭৭) ও রঙ্গমতী’ (১৮৮০)এ বিষয়ে উল্লেখযােগ্য।

মহাকাব্য ও তার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে উনিশ শতকের মহাকাব্যগুলি উল্লেখ করাে।

মহাকাব্য: মহাকাব্য বলতে আমরা বুঝি সেইসব আখ্যানকাব্যকে, যার মধ্যে বিশাল কালের প্রেক্ষাপটে জাতীয় জীবনের উত্থানপতনের কাহিনি বর্ণিত হয়। মহাকাব্য দু-প্রকার : (ক) আর্য মহাকাব্য বা ধ্রুপদি মহাকাব্য। যেমন রামায়ণ, মহাভারত। (খ) সাহিত্যিক মহাকাব্য যেমন-মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য। আলংকারিকরা মহাকাব্যের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এগুলি হল-

  • মহাকাব্যে কবির ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ না ঘটে তাতে ঘটনা ও চরিত্রের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা প্রকাশিত হয়।
  • পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মহাকাব্য।
  • মহাকাব্যের নায়ক হন সুখে-দুঃখে অচল, দৃঢ়চেতা এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ।
  • আটটির বেশি সর্গে বিভক্ত মহাকাব্যের কাহিনি স্বর্গ মর্ত্য-পাতাল জুড়ে রচিত হয়।
  • গাম্ভীর্যপূর্ণ কাব্যভাষায় রচিত মহাকাব্যে বীররস ও করুণরসের প্রাধান্য থাকে।

উনিশ শতকের মহাকাব্য: উনিশ শতকে যেসব আখ্যানকাব্য সাহিত্যিক মহাকাব্যে উন্নীত হয়েছে, সেগুলি হল হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৃত্রসংহার (দুই খণ্ড ১৮৭৫ ও ১৮৭৭), নবীনচন্দ্র সেনের ত্রয়ীকাব্য—’রৈবতক’ (১৮৮৭), ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) ও ‘প্রভাস’ (১৮৯৬) এবং মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১)।

গীতিকবিতা কাকে বলে? এই ধারায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান আলােচনা করাে।

লিরিক বা গীতিকবিতা: কবি মনের আবেগ-অনুভূতি-কল্পনা ছন্দময়ভাবে প্রকাশিত হয় যেসব কাহিনিবিহীন কবিতায়, সংক্ষেপে তাই-ই হল লিরিক বা গীতিকবিতা। গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য- “বক্তার ভাবােচ্ছাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য সেই কাব্যই গীতিকাব্য।”

বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যচর্চা: আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রথম গীতিকবি হলেন ভোরের পাখি বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)। বিহারীলাল রচিত উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘সঙ্গীত শতক’ (১৮৬২), ‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০), ‘নিসর্গসন্দর্শন’ (১৮৭০), ‘বন্ধুবিয়ােগ’ (১৮৭০), ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ (১৮৭১), ‘সারদামঙ্গল’, (১৮৭৯) এবং ‘সাধের আসন’ (১৮৮৯)। ‘সঙ্গীত শতক’ কাব্যে কবি তাঁর কৈশাের ও প্রথম যৌবনের অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য ভাবনা অস্ফুটভাবে প্রকাশ করেছেন। বিহারীলাল ‘নিসর্গসন্দর্শন’ কাব্যের কবিতাগুলিতে নিসর্গ প্রকৃতিতে ব্যক্তিসত্তা আরােপ করে সচেতন কবি হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে যে নবতম কাব্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন, তা গীতিকবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জননী-জায়া- কন্যা-ভগিনী—প্রভৃতি বিবিধ মূর্তিধারিণী নারীর স্নেহ-মায়া- মমতাময় রূপ ও সৌন্দর্যের সন্ধান করেছেন কবি বঙ্গসুন্দরী কাব্যে। আর নিজের এবং বন্ধুবর্গের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে এবং নিজের প্রেমানুভূতিকে কাব্যের আকারে রূপদান করেছেন কবি তার ‘বন্ধুবিয়ােগ’ ও ‘প্রেম-প্রবাহিনী’ কাব্যদুটিতে। তবে বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘সারদামঙ্গল’, যেখানে কবির সৌন্দর্যচেতনা, গীতিবৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। ‘সাধের আসন’ কাব্যটিতে কবি সৌন্দর্যতত্ত্বের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছেন।

বাংলা গীতিকাব্যধারায় কবি বিহারীলালের কাব্যপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য

বিহারীলালের কাব্যপ্রতিভা: ‘ভােরের পাখি’ কবি বিহারীলালের উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘সঙ্গীত শতক’ (১৮৬২), ‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০), ‘নিসর্গসন্দর্শন’ (১৮৭০), ‘বন্ধুবিয়ােগ’ (১৮৭০), ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ (১৮৭১), ‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯) এবং ‘সাধের আসন’ (১৮৮৯)। ‘সঙ্গীত শতক’ কবির গানের সংকলন। ‘নিসর্গসন্দর্শন’ কাব্যে মানবিক প্রকৃতির সঙ্গে কবি-হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপন হতে দেখা যায়। প্রকৃতিকে যথাযথভাবে দেখার ফলে কবি-হৃদয়ের মুগ্ধতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে ‘সমুদ্র-দর্শন’, ‘নভােমণ্ডল’ প্রভৃতি কবিতায়। জননী-জায়া- কন্যা-ভগিনী-প্রভৃতি বিবিধ মূর্তিধারিণী নারীর স্নেহ-মায়া মমতাময় রূপ ও সৌন্দর্যের সন্ধান করেছেন কবি বঙ্গসুন্দরী কাব্যে। নিজের এবং বন্ধুবর্গের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং নিজের প্রেমানুভূতিকে কাব্যের আকারে রূপদান করেছেন কবি তাঁর বন্ধুবিয়ােগ’ ও ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ কাব্যে। বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ কাব্য হল সারদামঙ্গল’, যেখানে কবির সৌন্দর্যচেতনা ও গীতিবৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর অনুরােধে কবি বিহারীলাল ‘সাধের আসন কাব্য তার সৌন্দর্যভাবনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।

পরিশেষে বলতে হয়, বিহারীলালের কবিতার অতিআবেগ ছন্দে ও ভাষায় কিছু কিছু শিথিলতা নিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও তার কবিতা বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ আখ্যানকাব্য-মহাকাব্য ধারার পর তিনিই প্রথম বাংলা কাব্যের ইতিহাসে গীতিকবিতার উৎস-মুখ খুলে দিয়েছিলেন।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment