ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিচয় দাও?

আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবস্থা

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সর্বাধিক শোষিত ও নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে অন্যতম শৈল ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা অধিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়। সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডা, ওরাঁও, হো, ভুমিজ, খন্দ, গোণ্ড, ভরলি, নাগারা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রকৃতির কোলে বসবাস করত এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও মহাজনদের তীব্র শোষণের শিকার হয়ে তারা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। অধিবাসীদের ওপর শোষণ ও তাদের প্রতিবাদ সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো-

১. করারোপ

ভারতে অধিবাসী সম্প্রদায় বিশ্বাস করত যে, প্রাচীনকালে তারা চম্পা নামে এক স্বাধীন রাজ্যে বাস করত। এ রাজ্যে তারা কাউকে কর দিতে বাধ্য ছিল না। আদিবাসীরা ব্রিটিশ আমলে তথাকথিত সভ্য সংস্কৃতি সংস্পর্শে আসতে শুরু করলেন তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার ১৯ শতকে আদিবাসী সম্প্রদায় সরকারের আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থা আওতায় আনে। ভূমি বন্দোবস্ত করে সরকার আদিবাসীদের জমির উপর কর আরোপ করে এবং তাড়াতাড়ি বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী নিয়োগ করে। তারা আদিবাসী কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় তীব্র নির্যাতন চালায়।

২. দিকুদের ভূমিকা

সরকার ও আদিবাসী কৃষকদের মধ্যে বহিরাগত জমিদার জোতদার, বণিক, মহাজন, ঠিকাদার ও দালাল প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরে মধ্যস্বত্বভোগী আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারা ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে আদিবাসী এলাকায় ঢুকে পড়ে। আদিবাসীরা এই মধ্যস্বত্বভোগী বহিরাগতদের ‘দিকু’ বলতো। দিকুরা আদিবাসীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা ও শোষণ চালায়। আদিবাসীরা কোন সময় তাদের ওপর অত্যাচার ও শোষণের প্রতিকার পেতো না। কারণ, সরকারি থানা, পুলিশ, আইন আদালতের সঙ্গে দিকুদের গোপন যোগাযোগ থাকত।

৩. অরণ্যের অধিকার ব্যাহত

অধিবাসীরা পাহাড় ও মালভূমি অরণ্য অঞ্চলে ঝুম চাষ করে খাদ্য উৎপাদন করত এবং অরণ্য থেকে বিভিন্ন সম্পদ আহরণ। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত অরণ্য অঞ্চল ঝুম চাষ নিষিদ্ধ করে এবং অরণ্য সম্পদের ওপর সরকার একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। অরণ্য থেকে অধিবাসীদের কাট ও অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহ, পশু শিকার, গোচারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ও নানা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।

৪. সামাজিক আগ্রাসন

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সামাজিক আগ্রাসনের শিকার হয়। খ্রিষ্টান মিশনারীরা আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি তাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। নতুন প্রাশ্চাত্য খ্রিস্টান সংস্কৃতির প্রভাবে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাদী সংস্কৃত আক্রান্ত হয়।

৫. শোষণ ও বঞ্চনা

আদিবাসীরা আগে জমিতে যে যৌথ মালিকানা অধিকার ভোগ করত ব্রিটিশ শাসনকালে তারা সেই অধিকার হারায়। উনিশ শতকের ব্রিটিশ পুঁজি প্রতিরা চা কফি বাগিচা চাষ শুরু করে। অসংখ্য আদিবাসী শ্রমিককে সেখানে নিয়ে তাদের চা কফি চাষে নিয়োগ করা হয়। সেখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং সীমাহীন অত্যাচারের শিকার হয়ে বহু শ্রমিকদের মৃত্যু হয়। সারা দেশে রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু হলে প্রচুর আদিবাসী শ্রমিককে এই কাজে নিয়োগ করা হয়। কয়লা উৎপাদনের কাজেও প্রচুর সংখ্যক আদিবাসী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু ন্যায্য পারিশ্রমিক না দিয়ে দিনের পর দিন নানা ভাবে তাদের বঞ্চিত করা হয়।

৬. মুক্তির উদ্যোগ

আদিবাসীরা সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য শোষকদের হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে প্রয়াস চালায়। তারা নিজেদের সামাজিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করে। সরকারি রাজস্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। শোষণ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখা ছোটনাগপুর অঞ্চলে কল উপজাতি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এবং বিহারের সাঁওতাল উপজাতি ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার আশায় গুজরাটের এক অধিবাসী সম্প্রদায় ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ চৌকি আক্রমণ করে। দক্ষিণের রম্পা অঞ্চলে বোনের কাঠ সংগ্রহ ও চারণ ভূমির উপর অধিকার দাবিতে বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহের নেপত্বেও একই ধরনের পটভূমি কাজ করেছিল।

উপসংহার

উপনিবেশিক আমলে আদিবাসী সম্প্রদায় সর্বাধিক সামাজিক আসাম্যের শিকার হয়। ব্রিটিশ বিরোধী মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বা জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগে ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত আদিবাসী সম্প্রদায়ী প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ভিত তৈরি করে। তাদের বিদ্রোহ ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক বিদ্রোহগুলিকে শক্তি সরবরাহ করে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment